বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হলেও এ দেশের কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন আজও প্রত্যাশিত পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, প্রত্যাশার ধারেকাছেও পৌঁছায়নি। অথচ যুগ যুগ ধরে দেশের অর্থনীতিতে এ শ্রেণির মানুষের অবদান বিশাল। অথচ এ কৃষকরা বিভিন্ন সময় নানাভাবে হয়রানির শিকার হন। নানা ফন্দিতে সহজ-সরল-সাধারণ ও অসহায় এ কৃষকদের নামে সরকারি বরাদ্দের টাকা, কৃষি সরঞ্জাম চুরি করে নেওয়া হয়। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক।
দেশে কৃষি উন্নয়ন ও কৃষক কল্যাণে বিভিন্ন সময় নেওয়া হয় নানা উদ্যোগ ও পদক্ষেপ। যদিও এসব উদ্যোগের পর্যাপ্ততা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। আবার কিছু ক্ষেত্রে রয়েছে নিজেদের অর্থনৈতিক অসক্ষমতার বাস্তবতাও। একই সঙ্গে রয়েছে এ খাতে সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার অভাব। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে দেখা যায় নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ। কৃষকের কল্যাণে এমনই একটি প্রকল্পের নাম ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্প। পাঁচ বছরমেয়াদি এ প্রকল্পে কৃষকদের জন্য ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি সহায়তা দিচ্ছে সরকার। কৃষি মন্ত্রণালয়ের এ প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। এ অধিদপ্তরের মাধ্যমে কৃষকদের সরবরাহ করা হয় চাষাবাদের আধুনিক বিভিন্ন যন্ত্র। সরবরাহের তালিকায় রয়েছে কম্বাইন্ড হারভেস্টার, রিপার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ইত্যাদি। এসব যন্ত্রের মোট দামের ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকিও দিচ্ছে সরকার। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এ কৃষিযন্ত্রগুলো সরবরাহের ক্ষেত্রেও নানা অনিয়ম, দুর্নীতি কৃষকের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে; যা সরকারের এ ইতিবাচক উদ্যোগকেই প্রশ্নবিদ্ধ ও ব্যর্থতায় পর্যবসিত করেছে। কালবেলায় প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্প অনুমোদিত কিছু কোম্পানি টেকসই হারভেস্টার আমদানি না করে চীন থেকে কম দামে কিনে তা সরবরাহ করে কৃষক ও প্রকল্পের ভর্তুকির টাকা তুলে নিচ্ছে। অন্যদিকে ফসল কাটার মৌসুমে যন্ত্র সচল না থাকায় লোকসানে পড়ে কোম্পানির ঋণের জালে আটকা পড়ছেন সাধারণ উদ্যোক্তারা। ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে সে সুযোগে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই অপমান-অপদস্থ করে যন্ত্রটি নিয়ে যাচ্ছে কোম্পানির লোকেরা। এরপর একই যন্ত্র অন্য কৃষকের কাছে বিক্রি করে সরকারের কাছ থেকে আরেক দফা ভর্তুকির টাকা তুলে নেওয়া হচ্ছে। যন্ত্র সরবরাহকারী কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভুয়া কৃষি উদ্যোক্তা দেখিয়ে ভর্তুকির টাকা তুলে নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এ যেন ‘হরিলুট’!
করোনা-পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে ইউক্রেন সংকটের প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে যখন বিশাল ধাক্কা এসে লাগল, তখন ‘খাদ্য জাতীয়তাবাদ’ ধারণাটি বিশেষভাবে আলোচনায় আসে। কারণ তখন বিশ্বে সরবরাহ চেইন প্রায় ভেঙে পড়েছিল। সেই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় ছিল খাদ্যে জাতীয় সক্ষমতা অর্জন। আর তার জন্য নিজ নিজ দেশের কৃষিনির্ভরতাই ছিল একমাত্র বিকল্প। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও চাষযোগ্য জমি যেন পতিত না থাকে, এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বারবার বক্তব্য দিয়েছেন। তবে সেই সংকটাবস্থা এখনো কাটেনি।
আমরা মনে করি, বিদ্যমান বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকটের এ সময়ে জাতীয় সক্ষমতা অর্জনের বিকল্প নেই। সে জন্য সবার আগে দরকার কৃষক ও কৃষিকে বাঁচানো। পাশাপাশি উল্লিখিত প্রকল্পের আওতায় সংঘটিত সব অনিয়ম-দুর্নীতি বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং কৃষকের হয়রানি লাঘবে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।
মন্তব্য করুন