অমিত রঞ্জন দে
প্রকাশ : ১২ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১২ জুন ২০২৩, ০৯:১৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বাজেটে উপেক্ষিত সংস্কৃতি খাত

অমিত রঞ্জন দে। পুরোনো ছবি
অমিত রঞ্জন দে। পুরোনো ছবি

সামাজিকভাবে মানুষ আজ বড় বিপন্ন। ভাবাদর্শের দিক থেকে বাংলাদেশের সমাজ ক্রমেই অন্ধকার ও অন্ধচিন্তা দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। সাম্প্রদায়িক ভেদচিন্তা ক্রমান্বয়ে মানবিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটিয়ে চলছে এবং মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। সমাজ ও রাষ্ট্রে নেতিবাচক প্রবণতা ক্রমান্বয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। একটি অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র-সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে বাংলাদেশের জন্ম হলেও তা ক্রমান্বয়ে সাম্প্রদায়িক ও লুটেরা অর্থনীতির রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। স্বাধীনতার পর এ রাষ্ট্রক্ষমতায় যেসব সরকার অধিষ্ঠিত হয়েছে, তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই তা ঘটেছে। একদিকে উন্নয়নের নামে লুটপাট বাণিজ্য, অর্থ পাচার; অন্যদিকে পুঁজিবাদী অর্থনীতির গর্ভজাত ভোগবাদ, যৌনতা, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, মৌলবাদী গোষ্ঠীর তাণ্ডব জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছে। এরকম একটা সময়ে প্রণীত হলো ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট।

এ বাজেট নিয়ে কথা বলার আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটটা ফিরে দেখতে চাই। বিগত বছরের বাজেটে সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ ছিল ৬৩৭ কোটি টাকা; যা জাতীয় বাজেটের মাত্র ০.০৯৩ শতাংশ। এটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর এবং কপিরাইট অফিসের মাধ্যমে খরচ করা হচ্ছে। গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর এবং কপিরাইট অফিসে বরাদ্দ বাজেটের সিংহভাগই উন্নয়ন বাজেট। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বাজেটের জন্য বরাদ্দে একটা অংশ শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে সাংস্কৃতিক পরিবেশনার কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে; যার মধ্যে গণহত্যার পরিবেশ থিয়েটার, পুতুল নাট্য উৎসব, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসব, যন্ত্রসংগীত উৎসব, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নাটক নির্মাণ উল্লেখযোগ্য। এখন প্রশ্ন হলো, যারা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির নির্মাতা, সেই শ্রমজীবী মানুষের উপযোগী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কী ছিল? দেখা গেছে, প্রায় সব অনুষ্ঠানই হয়েছে শিল্পকলার চৌহদ্দির মিলনায়তনের ভেতরে; যেখানে সাধারণ মানুষের যাতায়াত নেই বললেই চলে। অথচ আমাদের সংবিধানের ২৩ নম্বর অনুচ্ছেদে সর্বস্তরের জনগণ যাতে জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে এবং অংশগ্রহণের সুযোগ পায়, সে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

উন্নয়ন বাজেটে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতায় জাতীয় চিত্রশালা এবং জাতীয় সংগীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্রের সম্প্রসারণ, চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স স্থাপন, ১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের ভবন নির্মাণ, ঢাকাস্থ নজরুল ইনস্টিটিউটের নতুন ভবন নির্মাণ এবং ঢাকা, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লায় বিদ্যমান ভবনের রেনোভেশন, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের জাদুঘর ভবন নির্মাণ ও সংস্কার, মোহনগঞ্জ উপজেলায় শৈলজারঞ্জন সংস্কৃতি কেন্দ্র নির্মাণ, গণহত্যা নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র নির্মাণ এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটসহ ১৩টি নির্মাণ প্রকল্প চলমান। কিন্তু এ প্রকল্পগুলো অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন হচ্ছে না। ফলে প্রতিবছর প্রকল্প ব্যয় বাড়ছে আর তার দায় মেটাতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে অতিরিক্ত করের বোঝায় জর্জরিত হয়ে। নতুন প্রস্তাবনায় সংস্কৃতি খাতে কোনো প্রকল্পই নেই।

চলমান প্রকল্পগুলোর মধ্যে একটিও উন্মুক্ত মঞ্চ তৈরি, সংরক্ষণ বা পুনর্গঠনের বা সর্বসাধারণের সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তোলার বাজেট বরাদ্দ বা পরিকল্পনা নেই। বরং যে ক্ষেত্রগুলো রয়েছে, সেখানে রয়েছে নানা প্রতিকূলতা। এরই মধ্যে সিলেটের মেয়র সেখানকার শহীদ মিনার থেকে ভাড়া আদায় করা শুরু করেছেন। ঢাকার রবীন্দ্র সরোবরে অনুষ্ঠান করতে গেলে গুনতে হয় ৫৫ হাজার টাকা। মিরপুরের ১০ নম্বর গোলচত্বরের কাছে যে মুক্তমঞ্চটি ছিল, সেটি দীর্ঘদিন সিটি করপোরেশনের দখলে এবং সেখানে মার্কেট করার পরিকল্পনা চলছে। বাহাদুর শাহ পার্ক সম্প্রতি একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ইজারা নিয়ে ক্যাফেটেরিয়া তৈরি করছে। মুক্তাঙ্গনে দীর্ঘদিন ধরে সিটি করপোরেশন ময়লা ফেলে আসছে। ক্রমান্বয়ে সারা দেশে মুক্তভাবে সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রগুলো ভাগাড়ে পরিণত করছে ক্ষমতাসীনরা।

আমাদের উন্নয়ন চিন্তা মূলত প্রবৃদ্ধি, দৃশ্যমান উন্নয়নের নামে ইট-কাঠ-পাথরের স্তূপ আর জিডিপির মতো কিছু শব্দের বেড়াজালে আবদ্ধ; সেখানে শিশুর মানবিক বিকাশ, পারস্পরিক সৌহার্দ্য, শ্রদ্ধাবোধ, মমত্ব, স্নেহ, প্রেম ইত্যাদি বিষয় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। ঢাকা পড়ে যাচ্ছে প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষার বিষয়সমূহ। প্রজন্ম ক্রমান্বয়ে স্বার্থান্বেষী মনোবৃত্তি ধারণ করছে, অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে। এমনকি প্রেমের পরিণতি পর্যবসিত হচ্ছে হিংস্রতায়। বেশিরভাগ যুব-পুরুষের মানসিকতায় নারী পরিণত হয়েছে ভোগের বস্তুতে। সমাজে এক ধরনের বিকৃত চিন্তা ও মানসিকতার জন্ম নিয়েছে, বৃদ্ধি পেয়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা। একের পর এক তৈরি হচ্ছে পর্নো ছবি। শিক্ষকের সঙ্গে ভিন্নমত হলে তাকে পিটিয়ে হত্যা, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ফাঁদে ফেলে তার ঘরবাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে। নেই কোনো প্রতিকার। সরকারি প্রতিটি দপ্তরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছেয়ে আছে ঘুষ-দুর্নীতিতে।

সমাজের অভ্যন্তরে জন্ম নেওয়া এসব অপতৎপরতা রোধ এবং সামাজিক সংকট মোকাবিলা করে দেশকে অসাম্প্রদায়িক, মৌলবাদমুক্ত, মানবচেতনার ধারায় পরিচালনা করা এবং প্রজন্মের মানবিক গুণাবলির উৎকর্ষ সাধনে সংস্কৃতির অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। একটি রুচিশীল, সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণে ইট-কাঠ-পাথরের উন্নয়নের পাশপাশি মানুষের মানবিক বোধ তৈরি করা এখন সমধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। আমরা যদি সংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনের ব্যর্থ হই, তাহলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যতই হোক না কেন, তা একসময় বালুর বাঁধের মতো ভেঙে পড়বে। সুতরাং সবার আগে এ খাতকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিতে হবে। অথচ এবারের প্রস্তাবিত বাজেটেও সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাত্র .০৯১ শতাংশ। এ বাজেট থেকে উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয়, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ আর শিল্পকলা একাডেমিকেন্দ্রিক শহুরে মানুষের চিত্তবিনোদনের খরচ মেটানোর পর গ্রামীণ জনপদের মানুষ বা শ্রমজীবী মানুষের সংস্কৃতি বিকাশে কণামাত্র অর্থও অবশিষ্ট থাকবে না।

অথচ দীর্ঘদিন ধরে এ ভূখণ্ডের সংস্কৃতি বিনির্মাণে বিশেষ করে আমাদের লোকঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি নির্মাণে গ্রামীণ জনপদের মানুষের ভূমিকাই অগ্রগণ্য। শুধু তাই নয়, সংস্কৃতি এবং সংস্কৃতিকর্মীরাই রাষ্ট্রের বহুমাত্রিক সংকটে গণমানুষের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করে থাকেন। প্রেরণা জোগান ঘুরে দাঁড়াতে। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ আমাদের গণসংগ্রামগুলো তারই সাক্ষ্য বহন করে থাকে। এ সংস্কৃতিকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে সংস্কৃতি খাতে জাতীয় বাজেটের ন্যূনতম এক শতাংশ বরাদ্দ দেওয়ার যৌক্তিক দাবি করে আসছে। তাদের সেই দাবি বারবার উপেক্ষা করা হচ্ছে, যা আমাদের বাজেট ভাবনা এবং দর্শনের সীমাবদ্ধতা ছাড়া আর কিছু নয়।

এ সীমাবদ্ধতা থেকে বের হতে না পারলে আজকে যে লুটপাটের অর্থনীতি আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরেছে, তা থেকে কারও মুক্তি নেই। এভাবেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়া-কমা হতে থাকবে সিন্ডিকেটের ইশারায়, শিক্ষক লাঞ্ছিত হবে, তারুণ্য বিগড়ে গিয়ে কুরুচির জন্ম দিতে থাকবে, কিশোর গ্যাং তৈরি হবে, তৈরি হতে থাকবে পর্নোগ্রাফি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যে জীবনের ধারাপাত বন্দি হবে হাতের মুঠোয়। এরকম একটা হতশ্রী অবস্থার শ্রী ফেরাতে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত একটি মানবিক, বিজ্ঞানমনস্ক, কল্যাণমুখী বিশ্বমানসসম্পন্ন, দেশাত্মবোধ ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিতে উদ্বুদ্ধ জাতি গঠনে এবং মানুষকে উজ্জীবিত করতে সংস্কৃতিকর্মীদের দীর্ঘদিনের কাঙ্ক্ষিত ১ শতাংশ বাজেট বরাদ্দ এখন সময়ের দাবি।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মিছিলে বিএনপি নেতার গুলির প্রতিবাদে বিক্ষোভ

রৌমারীতে ব্যবসায়ীদের আহ্বায়ক কমিটির শপথ অনুষ্ঠিত

৬৫ ভরি স্বর্ণ ছিনিয়ে নেয়ায় মামুনের বিরুদ্ধে যুবদলের মামলা

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ইসলামী আন্দোলনে যোগদান

ক্ষমা পেয়ে আমিরাত থেকে ১২ জন ফিরছেন চট্টগ্রামে

‘ছাত্র জনতার আন্দোলনে হাসিনা সরকার দুই ভাবে পরাজিত’

মহানবীকে (সা.) কটূক্তিকারী সেই যুবকের বিরুদ্ধে মামলা

শিবচর আঞ্চলিক সড়কে গ্রামবাসীর বৃক্ষরোপণ

মাদ্রাসাছাত্রকে বলাৎকার চেষ্টার অভিযোগ ধামাচাপা, ৭ দিন পর ফাঁস

১২ দিনেও মেলেনি রানীনগরে নিখোঁজ নার্গিসের সন্ধান

১০

দায়িত্বশীলদের নিয়ে সাতক্ষীরায় ছাত্র শিবিরের সমাবেশ

১১

আযহারী শিক্ষার্থীরা হবে বাংলাদেশ ও মিশরীয় ঐতিহ্যের সেতুবন্ধন : মিশরীয় রাষ্ট্রদূত

১২

রাজশাহীতে বস্তাভর্তি দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার

১৩

আন্দোলনের ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ছাত্রলীগ কর্মীকে গণধোলাই

১৪

আশুলিয়ায় গার্মেন্টস শ্রমিক অসন্তোষ ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে শ্রমিক সমাবেশ

১৫

কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি

১৬

পাকিস্তানের জলসীমায় বিপুল তেল-গ্যাস মজুতের সন্ধান

১৭

বিসিবির দুর্নীতির তদন্ত দাবি সাবেকদের

১৮

পাবিপ্রবি ছাত্রলীগ কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ

১৯

জেল খেটেছি তবু শেখ হাসিনার মতো পালিয়ে যাইনি : সাবেক এমপি হাবিব

২০
X