শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
মুফতি আরিফ খান সাদ
প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০২৪, ০৩:৫৭ এএম
আপডেট : ০২ আগস্ট ২০২৪, ০৭:৩১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মানুষের পাপ গোপন রাখার নির্দেশনা

মানুষের পাপ গোপন রাখার নির্দেশনা

পাপ ও পুণ্য মানুষের সহজাত প্রবণতা। প্রতিটি মানুষের ভেতরেই রয়েছে পাপ ও পুণ্য, ভালো ও মন্দ, দোষ ও গুণ বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি। সৃষ্টিজগতে আল্লাহ ফেরেশতা সৃষ্টি করেছেন, যারা নিষ্পাপ ও নিষ্কলুষ জীবনযাপনে সতত ঊর্ধ্বারোহী। একই সঙ্গে আল্লাহ শয়তান সৃষ্টি করেছেন, যারা পাপের অতল তলে নিজেরাও সদা নিম্নগামী, মানুষকেও পাপের আঁধারে নিমজ্জিত করতে সদা তৎপর। দ্বিমুখী চরিত্রের এ দুই সৃষ্টির মধ্যখানে মানুষকে বানানো হয়েছে মধ্যবর্তী সৃষ্টি; যারা পাপ ও পুণ্য— উভয় কর্ম সম্পাদনের যোগ্যতা রাখে। যারা পুণ্যের পথে চলবে তারা হবে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’, ফেরেশতাদেরও ওপরে হবে তাদের মর্যাদা। আর যারা পাপে লিপ্ত হবে, তাদের প্রতি ঘোষণা করা হয়েছে, তারা পশুর চেয়ে অধম বলে। তাই মানুষকে চেষ্টা করতে হবে ভালো ও সৎ হওয়ার জন্য। পুণ্যের পথে জীবন পরিচালনা করা পাপ থেকে বিরত থাকা; কখনো পাপ হয়ে গেলে ক্ষমাপ্রার্থনা করে ফের পুণ্যের পথে ফিরে আসা এবং যাবতীয় পাপ ও দোষ আলোচনা থেকেও বিরত থাকা ইসলামের শিক্ষা। কারণ পাপ ও দোষ আলোচনা করলে সমাজে সেটার প্রচার পায় ও মন্দ প্রভাব পড়ে।

ইসলাম নেতিবাচক বিষয় প্রকাশ করা পছন্দ করে না। দোষ, পাপ ও অপরাধ নিজের হোক বা অন্যের—তা আলোচনা করা অনুচিত। নিজের অন্যায় কর্ম অন্যদের সামনে প্রকাশ করা সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার উম্মতের সব ব্যক্তির গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে, তবে ওইসব লোক ছাড়া, যারা নিজেদের পাপ ও অপরাধ জনসমক্ষে প্রকাশ করে। নিজেদের অপরাধ প্রকাশ করার অর্থ হচ্ছে, কেউ রাতে কোনো গুনাহ করে, অতঃপর যখন সকাল হয় সে নিজেই তা মানুষকে বলে বেড়ায়, গত রাতে আমি এই এই কাজ করেছি। অথচ রাতে তার প্রতিপালক সেটাকে গোপন রেখেছেন এবং অবিরত তার প্রতিপালক তা গোপন রাখছিলেন এবং সে দিনের বেলায় কোনো গুনাহের কাজ করে আর যখন রাত হয় সে তা মানুষকে বলে বেড়ায়, যদিও আল্লাহ তা গোপন রেখেছিলেন।’ (মুসলিম: ২৯৯০)। নিজের কোনো পাপ হয়ে গেলে তা তো গোপন করতেই হবে, অন্য কোনো ব্যক্তির পাপ ও অপরাধও যদি চোখে পড়ে যায় সেটাও গোপন করা উচিত। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের গোপন (অপরাধের) বিষয় গোপন রাখবে, আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার গোপন (অপরাধের) বিষয় গোপন রাখবেন। আর যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের গোপন বিষয় ফাঁস করে দেবে, আল্লাহ তার গোপন বিষয় ফাঁস করে দেবেন, এমনকি এ কারণে তাকে তার ঘরে পর্যন্ত অপদস্থ করবেন।’ (ইবনে মাজা: ২৫৪৬)

প্রকাশ্যে বা গোপনে পাপ করা যেমন উচিত নয়, তেমনি কখনো গোপনে পাপ হয়ে গেলে তা লোকসমাজে প্রকাশ করাও উচিত নয়। এতে সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সাধারণত সামাজিকতা, চক্ষুলজ্জা ও অপমানের ভয় অনেক সময় মানুষকে অনেক খারাপ কাজ করা থেকে বিরত রাখে। হতে পারে এ ভয়টাই একদিন তাকে আল্লাহর দিকে নিয়ে যাবে, যখন সে তার ভুল বুঝতে পারবে এবং তার কৃত অপরাধের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে। কিন্তু যখন তার অপরাধ জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেওয়া হয় তখন সেই ভয় বা চক্ষুলজ্জা আর তার মধ্যে কাজ করে না। সে তখন ভাবতে থাকে, কী হবে আর ভালো থেকে, ক্ষতি যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে, লোকজন তো জেনেই গেছে এরই মধ্যে, তখন সে প্রকাশ্যে পাপ কাজে লিপ্ত হতে থাকে। তা ছাড়া বারবার পাপের কথা বলতে থাকলে মানুষের অন্তর থেকে পাপের ভয় দূর হয়ে যায়। তখন পাপকে আর পাপ বলে মনেই হয় না। যে পাপের কথা বলে বেড়াতে লজ্জাবোধ করে না, একই পাপে লিপ্ত হওয়া তার জন্য অসম্ভব কিছু নয়। আর এভাবেই সমাজে পাপ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আল্লাহ কোনো মন্দ বিষয় প্রকাশ করা পছন্দ করেন না। তবে কারও প্রতি জুলুম হয়ে থাকলে সে কথা আলাদা। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্ববিষয়ে জ্ঞাত।’ (সুরা নিসা: ১৪৮)

অন্যের পাপ ও দোষ অনুসন্ধান করতেও কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে ইসলামে। কোনো মানুষই চায় না, তার গোপনীয় বিষয়গুলো অন্য কেউ খুঁজে বের করে মানুষের কাছে তা প্রকাশ করুক। বরং সবাই চায়, তার গোপনীয় বিষয়গুলো যেন প্রকাশ না পায়। তাই অন্যের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়ানো মানুষের কাছে একটি নিন্দনীয় স্বভাব। শুধু তাই নয়, এমন স্বভাব মহান আল্লাহর কাছেও অপছন্দনীয়। এজন্য পরের দোষ খুঁজে বেড়ানো ইসলামে সম্পূর্ণরূপে নিষেধ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদাররা! তোমরা একে অন্যের গোপনীয় বিষয় সন্ধান কোরো না।’ (সুরা হুজরাত: ১২)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা মুসলমানদের দোষত্রুটি, ভুলভ্রান্তি খুঁজে বের কোরো না। যে ব্যক্তি অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ায় ও প্রকাশ করে, স্বয়ং আল্লাহ তার দোষ প্রকাশ করে দেন। আর আল্লাহ যার দোষত্রুটি প্রকাশ করেন তাকে নিজের বাড়িতেই লাঞ্ছিত করেন।’ (আবু দাউদ: ৪৮৮০)। রাসুল (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে অন্যের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার দোষ ঢেকে রাখবেন।’ (বোখারি: ২৪৪২)

আমরা যদি সোনালি যুগের সোনালি মানুষ সাহাবিদের দিকে তাকাই, তাহলে আমরা এ ব্যাপারে তাদের জীবনের বাস্তব আমল সম্পর্কে জানতে পারব। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.) একদিন কোনো কাজে এক রাতে বাইরে বের হলেন। তার সঙ্গে ইবনে মাসউদ (রা.) ছিলেন। এক জায়গায় তারা আগুনের আলো দেখতে পেলেন। বিষয়টি তদন্ত করতে উভয়ই সেদিকে চলতে লাগলেন। একসময় তারা আগুনের উৎসস্থান খুঁজে পেয়ে এক ঘরের সামনে উপনীত হলেন। ইবনে মাসউদ (রা.)-কে বাইরে রেখে উমর (রা.) ভেতরে প্রবেশ করলেন। তখন গভীর রাত। ভেতরে গিয়ে দেখলেন, ঘরে প্রদীপ জ্বলছে। সেখানে এক বৃদ্ধ বসে আছেন। তার সামনে পান করার মতো কিছু একটা রাখা আছে। আর এক দাসী তাকে গান শোনাচ্ছে। বৃদ্ধ লোকটি তাদের প্রবেশের বিষয়টি টের পাননি। যখন টের পেলেন ততক্ষণে উমর (রা.) তার একেবারে কাছে পৌঁছে গেছেন। তিনি বললেন, ‘আজ রাতের মতো এমন খারাপ দৃশ্য আমি আর কখনো দেখিনি। একজন বৃদ্ধ মানুষ, যে বলতে গেলে মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, সে এমন মন্দ কাজে লিপ্ত!’ বৃদ্ধ লোকটি মাথা তুলে বললেন, ‘আপনি যা বলেছেন, সেটা সঠিক। কিন্তু আপনি নিজে যা করেছেন তা এর চেয়েও জঘন্য। আপনি অন্যের ঘরে ঢুকে দোষ সন্ধান করেছেন। অথচ আল্লাহতায়ালা এ ধরনের দোষ খুঁজে বেড়াতে নিষেধ করেছেন। তা ছাড়া আপনি অনুমতি ছাড়াই ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন।’ উমর (রা.) নিজের ভুল বুঝতে পারলেন এবং চোখ থেকে অনুতাপের অশ্রু ঝরল। তিনি সেখান থেকে চলে গেলেন।

দীর্ঘদিন পর দেখা গেল, ওই বৃদ্ধ লোকটি উমর (রা.)-এর দরবারে এসে মজলিসের শেষপ্রান্তে কিছুটা আড়াল হয়ে বসে পড়লেন। হজরত উমর (রা.) তাকে দেখে ফেললেন এবং বললেন, ‘বৃদ্ধ লোকটিকে আমার কাছে নিয়ে এসো।’ এদিকে বৃদ্ধ লোকটি ধরে নিলেন যে, সেদিন উমর (রা.) নিজের চোখে যা দেখেছেন, তার জন্য আজ শাস্তি অবধারিত। বৃদ্ধ লোকটিকে তার কাছে নিয়ে আসা হলে উমর (রা.) তার একেবারে বাহুসংলগ্ন করে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, ‘ভালো করে শুনে রাখো, আল্লাহর শপথ করে বলছি, সে রাতে আমি তোমাকে যা করতে দেখেছি তা অদ্যাবধি কাউকে বলিনি। তোমার দোষ গোপন করে রেখেছি। এমনকি ইবনে মাসউদ আমার সঙ্গে ছিল, তাকেও না।’ বৃদ্ধ লোকটি উমর (রা.)-এর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, ‘সেই সত্তার শপথ, যিনি মুহাম্মদ (সা.)-কে সত্যসহ রাসুল করে পাঠিয়েছেন, আমিও সেই কাজ আর কখনো করিনি।’ তখন উমর (রা.) জোর আওয়াজে আল্লাহু আকবর বলে উঠলেন। কিন্তু আশপাশের কারও জানা ছিল না যে কেন হঠাৎ তিনি তাকবির ধ্বনি দিলেন। (হায়াতুস সাহাবা: ২/৫৩৮৮)

এ ঘটনায় আমাদের জন্য দুটি শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে—এক. অন্যের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়ানো যাবে না। যদি সে শাসকও হয়। আর অনিচ্ছাসত্ত্বেও যদি চোখে পড়ে, তাহলে সেটা গোপন রাখতে হবে। দুই. অন্যের ঘরে প্রবেশ করার আগে অবশ্যই তার অনুমতি নিতে হবে।

আমরা যদি নিজেরাই নিজেদের আমল সম্পর্কে একটু চিন্তা করি, তাহলে দেখা যাবে আমরা প্রত্যেকেই রাতের আঁধারে অথবা একা নিরালায় শয়তানের খপ্পরে পড়ে কমবেশি অনেক বড় অপরাধ করে ফেলেছি, যে অপরাধের কথা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউই জানে না। তাই তো বলা হয়, পিতামাতার গোপনীয় অপরাধের কথা যদি সন্তান জানত, তাহলে কোনো সন্তানই পিতামাতাকে ঘৃণায় সম্মান করত না। আবার সন্তানের গোপনীয় অপরাধের কথা যদি কোনো পিতামাতা জানতেন, তাহলে কখনো তাকে সন্তান বলে পরিচয় দিতেন না। সুতরাং কেউ যদি চায় তার দোষগুলো যেন আল্লাহতায়ালা গোপন করে রাখে, তাহলে সে যেন অন্য মুসলমান ভাইয়ের দোষগুলো গোপন করে রাখে। এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ গোপন করে রাখবে, মহান আল্লাহতায়ালা দুনিয়া ও পরকালে তার দোষ গোপন করে রাখবেন।’ (মুসলিম: ৬৪৭২)

আমাদের শিক্ষা হচ্ছে, আমরা কখনো আমাদের কৃত অপরাধগুলো অন্যের কাছে অযাচিতভাবে প্রকাশ করব না। অন্যের কোনো দোষ-দুর্বলতাও মানুষের সামনে প্রকাশ করব না। আল্লাহ আমাদের সব গোপনীয় অপরাধমূলক কাজ থেকে বিরত থাকার তওফিক দান করুন।

লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

প্রথম দিনে উইন্ডিজ তুলল ২৫০ রান

গাঁজা-জাল নোটসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের শীতবস্ত্র বিতরণ

উইন্ডিজের প্রতিরোধ ভেঙে বাংলাদেশের স্বস্তি

টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস / ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়িক অংশীদার চাই

২০২৪ সালের হাইয়েস্ট কালেকশন দরদের : শাকিব 

নায়িকা পরীমনির প্রথম স্বামী নিহত

রাজনীতিতে আ.লীগের পুনর্বাসন ঠেকাতে হবে: নুর

নির্বাচন যত দ্রুত হবে, সমস্যা তত কমে আসবে : মির্জা ফখরুল

খাসজমির দখল নিয়ে সংঘর্ষে দুজন নিহত

১০

মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ক্রীড়াঙ্গন অন্যতম একটি মাধ্যম : আমিনুল হক 

১১

তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল

১২

আহত রানার পাশে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’

১৩

ফেসবুকে দাবি ‘মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ একই ব্যক্তি’, যা বলছে ফ্যাক্ট চেক

১৪

একদিকে প্রশান্তি, অশান্তিও বিরাজ করছে: শামা ওবায়েদ

১৫

চোর সন্দেহে খুঁটিতে বেঁধে যুবককে নির্যাতন

১৬

র‍্যানকন মটরসের সঙ্গে ক্র্যাক প্লাটুন চার্জিং সলুশনের চুক্তি

১৭

জনকল্যাণে কাজ করাই বিএনপির মূল লক্ষ্য : নয়ন

১৮

‘এক ফ্যাসিস্টকে হটিয়ে আরেক ফ্যাসিস্টকে ক্ষমতায় দেখতে চাই না’

১৯

জুলাই বিপ্লবে আহত মুক্তিযোদ্ধার ছেলে বাবুকে নেওয়া হচ্ছে থাইল্যান্ড

২০
X