দুই বছরের অধিক সময় ধরে আর্থিক খাতের দুরবস্থা, উচ্চমূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার মতো বিষয়গুলো আমাদের অর্থনীতিকে চাপের মধ্যে রেখেছে। কিন্তু জুলাই মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে অনাকাঙ্ক্ষিত সহিংসতা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে দেশের অর্থনীতিসহ সার্বিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়ে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাবমতে, ১৮ জুলাই থেকে চলমান সহিংসতায় ১৫০ জনের প্রাণহানি হয়। কয়েকটি সংবাদপত্রের হিসাব অনুযায়ী, আড়াই শতাধিক লোকের মৃত্যু হয়েছে এবং বেশ কয়েক হাজার ছাত্র-জনতা আহত হয়েছে। ছাত্র আন্দোলনসহ দুষ্কৃতকারীদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ ও শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কারফিউ জারি ও সেনাবাহিনী তলব করতে হয়েছে। ফলে কলকারখানার উৎপাদন বন্ধ, ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থাৎ আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া, ইন্টারনেট সেবা বন্ধ, অফিস-আদালত বন্ধ প্রভৃতি কারণে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে দেশে অলিখিত ‘লকডাউন’ অবস্থা বিরাজ করে।
এ অবস্থায় অর্থনীতির যে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা নিরূপিত না হলেও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের ভাষ্যমতে, সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান জাভেদ আখতারের মতে, শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ও উদ্ভূত সহিংসতার কারণে ১০ বিলিয়ন ডলারের বা ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রতিদিন ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে বলে তাদের অভিমত।
অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশে ঘটে যাওয়া সহিংসতা ও কারফিউতে আমাদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে—আস্থাহীনতার সংকট। যতদিন পর্যন্ত দেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে না আসবে ততদিন অর্থনীতির ক্ষতি চলতেই থাকবে। ১৮ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত শিল্পকারখানা বন্ধ থাকার কারণে সব ধরনের উৎপাদন বন্ধ থাকে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রপ্তানি খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্প। বিদেশি ব্র্যান্ড ক্রেতাদের সঙ্গে রপ্তানি চুক্তি অনুযায়ী, নির্ধারিত সময়ে পণ্য জাহাজীকরণ সম্ভব হয়নি। নতুন রপ্তানি আদেশ আসছে না। কোনো কোনো ক্রেতা বিলম্বের কারণে চুক্তিমূল্যের চেয়ে কমমূল্য দিতে চাচ্ছেন, আবার কেউ কেউ পণ্য না নেওয়ার কথা বলছেন। আমদানি বন্ধ থাকার কারণে উৎপাদনের উপকরণ আসছে না। ফলে সময়মতো উৎপাদন করে রপ্তানিদ্রব্য সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। আশঙ্কার বিষয় হলো, বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশ বাদ দিয়ে অন্য দেশ থেকে সোর্সিং করতে পারেন।
সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট। গত দুই বছর আশানুরূপ বিদেশি বিনিয়োগ হয়নি। ২০২২ সালে এফডিআই আসে ৩ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার, ২০২৩ সালে আসে ৩ বিলিয়ন ডলার। তথ্য বিপর্যয়ের কারণে ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ সালের রপ্তানি আয় থেকে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার কমে গেছে। বহুজাতিক সংস্থা থেকে প্রাপ্ত বৈদেশিক সহায়তা ও বছর বছর কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে বিদেশি ঋণের সুদাসল পরিশোধ বছর বছর বেড়ে যাচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের সুদাসল রেকর্ড ৩ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে।
বিদেশি রেমিট্যান্স বা প্রবাস আয় বিগত অর্থবছরে ইতিবাচক ধারায় চলে এসেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের প্রবাস আয় আসে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবাস আয় এসেছে ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার; অর্থাৎ বিগত অর্থবছরে গড়ে প্রতি মাসে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে। কিন্তু বর্তমান অর্থবছরের জুলাই মাসের ২৪ তারিখ পর্যন্ত ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। জুন মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ২ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার, যা ছিল গত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। দেশের সাম্প্রতিক সহিংসতা, হত্যাকাণ্ড ইত্যাদির ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক ধারা চলে এসেছে। অনেক প্রবাসী বৈধপথে রেমিট্যান্স না পাঠানোর প্রচারণা চালাচ্ছে। এত অধিকসংখ্যক ছাত্র-জনতার মৃত্যুতে তাদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। আবার হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবণতা বাড়ছে, যা দেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ বৃদ্ধির উপাদানগুলো হচ্ছে রপ্তানি আয়, প্রবাস আয়, এফডিআই এবং বৈদেশিক সহায়তার নগদায়ন। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রবাস আয় বর্তমানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু অন্যান্য উৎস থেকে বৈদেশিক মুদ্রা প্রাপ্তি ক্রমান্বয়ে কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত জুন সমাপ্তিতে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার, নিট রিজার্ভ ছিল ১৬ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। জুলাই মাসের নিট রিজার্ভ ১৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
ইন্টারনেট না থাকার কারণে ই-কমার্স, আউটসোর্সিংসহ সব খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এদিকে দেশের বাজারে দ্রব্য সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মূল্যস্ফীতিরও ঊর্ধ্বগতির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যা অচিরেই ১০ শতাংশ অতিক্রম করতে পারে। গত ২৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর বিনিয়োগ উপদেষ্টার সঙ্গে এক বৈঠকে ব্যবসায়ীরা বন্দরে পণ্য খালাসে জটিলতা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হয়রানি, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট, ব্যাংক থেকে ঋণ প্রাপ্তির সমস্যা ও নির্বিঘ্ন ইন্টারনেট সেবা না পাওয়ার সমস্যা তুলে ধরেন।
আন্তর্জাতিক অবস্থার ওপর নির্ভরশীল সূচকগুলো আরও চাপের সম্মুখীন হওয়ার আগেই দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর সমাধানে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি। দেশবাসীর প্রত্যাশা জনজীবনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য যা যা করা প্রয়োজন, সরকার যেন তা-ই করে। সবকিছু স্বাভাবিক হলে সামগ্রিক অর্থনীতির গতিধারাও স্বাভাবিক হবে। কতিপয় অর্থনৈতিক সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য রাজনৈতিক উদ্যোগের প্রয়োজন হতে পারে।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সততা, সদিচ্ছা ও দেশপ্রেম। দেশের সব মানুষ, সরকারি কর্মচারী, পেশাজীবী, রাজনৈতিক দল ও সরকারের কাছ থেকে এসবই কাম্য। ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে প্রবাসীরা যদি বৈধপদে রেমিট্যান্স প্রেরণ না করেন, কিংবা রপ্তানিকারকরা সময়মতো রপ্তানিমূল্য দেশে না আনেন এবং এর ফলে অর্থনীতি যদি বিপর্যয়ের মুখে পতিত হয়, তা হবে আত্মঘাতী। আশা করি দেশের এ সমস্যাসংকুল পরিস্থিতিতে দেশ-বিদেশে বসবাসকারী সব বাংলাদেশির শুভবুদ্ধি কাজ করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, যেন নতুন করে এগুলোর অবনতি না হয়।
লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্টদূত