একটা দেশে যে কোনো সময়, যে কোনো ইস্যুতে আন্দোলন হতে পারে। কোটা নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এমনই একটি সামাজিক ইস্যুই ছিল। ছাত্রছাত্রীরা সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করেছে এবং সেটা শেষ পর্যন্ত এত রক্তক্ষয়ী হবে, কেউ হয়তো কোনো দিন দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি।
প্রথমে এ আন্দোলন হলো ২০১৮ সালে এবং সরকারপ্রধান তখন একপর্যায়ে সব কোটাই বন্ধ করে দিয়ে পরিপত্র জারি করেছিলেন। সংস্কারের দাবি করলেও আসলে কোনো কোটা না থাকাকেই তখন অভিনন্দন জানিয়েছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। এবার হঠাৎ করে মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মের কেউ একটা রিট করে হাইকোর্টের মাধ্যমে সেই পরিপত্রকে বাতিল করে পুনরায় ২০১৮-এর সরকারি পরিপত্রের আগের অবস্থায় নিয়ে গেল। যদিও সরকার হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিল, কিন্তু তাতে ছাত্রসমাজকে শান্ত করা যায়নি। যায়নি আরও আরও সরকারি বক্তব্যের কারণেও; সেগুলো এখন আর আলোচনায় আনতে চাই না।
কিন্তু এ আন্দোলন কেন্দ্র করে এত মৃত্যু এর আগে অন্য কোনো আন্দোলনে দেশবাসী দেখেনি। শুধু সরকারি হিসাবেই মৃত্যু হয়েছে ১৪৭ জনের। বেসরকারি হিসাবে তা আরও বেশি। সরকারি হিসাবটাই যদি বিবেচনায় নিই, তাহলেও বলতে হবে যে, এত মৃত্যুর দায় প্রাথমিকভাবে সরকারের ঘাড়েই যাবে। দ্বিতীয় হলো ধ্বংসযজ্ঞ। দেশের সেরা স্থাপনাগুলো জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যেন কোনো একটা পক্ষ দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিল।
আন্দোলনের একেবারে শুরু থেকেই শাসক দল আওয়ামী লীগের নেতারা বলছিলেন, ছাত্রদের আন্দোলনের ভেতর জামায়াত-শিবির-বিএনপি ঢুকে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। প্রশ্ন হলো, এটা যদি তারা বোঝেনই তাহলে আগেভাগেই কেন ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করলেন না? শেষ পর্যন্ত তো তারা করেছেনই, কিন্তু ততক্ষণে অনেক প্রাণ নাই হয়ে গেছে, অনেক রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনাবাহিনী নামাতে হয়েছে, দেশজুড়ে কারফিউ দিতে হয়েছে।
প্রথম রাজনৈতিক ভুল ছিল আন্দোলনকে ছোট করে দেখা, উপেক্ষা করা এবং ছাত্রদের পাত্তা না দেওয়ার মানসিকতা। তবে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ব্লান্ডার ছিল আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা কর্তৃক সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ লেলিয়ে দেওয়া। তিনি যেই না বললেন, আন্দোলনকারীদের দমাতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট, সঙ্গে সঙ্গেই ছাত্রলীগ পেটোয়া বাহিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর। ছাত্ররা তো আছেই, ছাত্রীদের ওপরও ভয়ংকর এবং নিষ্ঠুর হামলার দৃশ্য দেখে সারা দেশের মানুষ এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা জ্বলে ওঠে; যার মাশুল পরে ছাত্রলীগকে দিতে হয়েছে সব ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হয়ে। তিনি কি তাহলে এখন বলবেন যে, ছাত্রলীগই যথেষ্ট ছিল নাকি যথেষ্ট প্রয়োজন ছিল সাধারণ শিক্ষার্থীদের এতটা উপেক্ষা না করা?
পুলিশ যে অতি প্যানিকড হয়েছিল সেটা বোঝা গেছে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায়। খুব কাছ থেকে যে তাকে গুলি করা হয়েছে, তা লুকানো খুব কঠিন হবে অন্য কোনো কারণ দেখিয়ে। এ ছবিটি এখন আইকনিক ছবি হয়ে উঠেছে সব শিক্ষার্থীর কাছে। কেন এত মানুষ মারা গেল তার কারণ কি কোনো দিন বের হবে? বাস্তবতা হলো—হবে না।
বাংলাদেশে যে কোনো আন্দোলন—সেটা ছাত্র বা শ্রমিক বা নারী যারই হোক না কেন, সেগুলোতে রাজনৈতিক শক্তি ঢুকে পড়ে। তারা এদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে চেষ্টা করে সরকার উৎখাতের। এটাই রাজনীতি। আমাদের সমাজ অতিরাজনীতি-আক্রান্ত এবং যে কোনো পরিস্থিতিতেই নাগরিক সমাজকে গ্রাস করে নেওয়ার ক্ষমতা আছে রাজনৈতিক শক্তির। সেটা তারা করবেই। কিন্তু সরকারের ভূমিকাটি তো এ ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সরকার যদি নাগরিক আন্দোলন সামলাতে গিয়ে উল্টো সেটাকে বিষাক্ত করে তোলে, তাহলে কারও সাধ্য নেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের।
তাই প্রতিটি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ভুলকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে আগামীর পথে হাঁটতে হবে। মনে রাখা দরকার, আওয়ামী লীগ দল হিসেবে বহু ছাত্র-আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে, অংশ নিয়েছে। সেই দলের সরকারও যদি এভাবে ছাত্রছাত্রীদের ওপর দমনপীড়ন-নির্যাতনের অভিযোগে দেশ-বিদেশে অভিযুক্ত হয়, তাহলে সেটা নিশ্চয়ই ঐতিহাসিক অন্যায়। এ স্বীকারোক্তিটা দরকার আগে।
প্রতিটি দিন নানা পরিবারের খবর আসছে যারা স্বজন হারিয়েছে। এতে করে সংবেদনশীল মানুষ মাত্রই মন খারাপ হবে। আমি কোটা আন্দোলনের শুরু থেকে বলে আসছিলাম, পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে আলোচনা করে। কিন্তু তা করা হয়নি। রাজনৈতিকভাবে নিজস্ব অবস্থানে থেকেও যে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা যায়, সেই সংস্কৃতিই নেই আমাদের দলীয় ক্ষমতা চর্চায়। সমাজ ও শাসনের প্রতিটি পরিসরে জনপ্রিয় হয়ে থাকার লালসা, বহুমতকে পাত্তা না দেওয়া, সবকিছুকেই একজনের কাছে ঠেলে দেওয়ার প্রবণতা ভয়ংকর ক্ষতি করেছে আমাদের।
কোনো সুপরামর্শ গ্রহণ না করাই এই রাজনীতি। দলীয় মতাদর্শের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য প্রদর্শনকারীদের তোষণই সব সর্বনাশের মূল। এসবই আমরা প্রতিনিয়ত দেখি এবং এড়িয়ে যাই আর ছোট থেকে বড় সবার হাত ধরে বিচরণ করতে থাকে আমাদের কাপুরুষতা। আসলে ন্যায্য-অন্যায্যের বোধটুকুই হারিয়ে গেছে। সংগঠিত নৈরাজ্যকে তারা ভয় পায় এবং সেটা বড় আকারেই হয়েছে। নৈরাজ্য, মৃত্যু আর ধ্বংস কারও কাম্য নয়, কিন্তু কেন এমন হলো সেটাও নির্মোহভাবে বিবেচনা করতে হবে।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস আজকের নয়। স্বাধিকারের আন্দোলন, সামরিক সরকারবিরোধী আন্দোলন, নাগরিক অধিকার আন্দোলন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন বা যুদ্ধাপরাধের বিচারের আন্দোলন—প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ছিলেন পুরোভাগে। কিন্তু এবারের আন্দোলনটি ছিল একেবারেই তাদের নিজস্ব রুটি-রুজির আন্দোলন। ছাত্রছাত্রীদের দাবিগুলো লক্ষ করলেই তা বোঝা যায় তারা ন্যায্যতা চেয়েছিল। অথচ তাদের সেটা না দিয়ে বলপ্রয়োগের মানসিকতা ছিল সরকার ও সরকারি দলের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যুগে যুগে মুক্তবুদ্ধি ও প্রতিবাদী চেতনার গর্ভগৃহ। সেটা অস্বীকার করার মানসিকতাই বাস্তবতা পরিপন্থি। ছাত্রলীগসহ সব গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠন ক্ষমতার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে প্রতিষ্ঠা দিতে সর্বদা পথ দেখিয়েছে অতীতে। দেশের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকসমাজ, গড়ে তুলেছে ক্যাম্পাস আন্দোলন; সাধারণ মানুষ তাতে শামিল হয়েছে। ছাত্রলীগ কোনো উসকানি বা প্ররোচনায় এ থেকে দূরে তো থাকলই, উল্টো নিপীড়কের ভূমিকায় নেমেছিল; তার একটা রাজনৈতিক বিশ্লেষণ দরকার শাসক দলের ভেতরে।
গত ১৫ বছরে নানা সময় আমরা দেখেছি ক্যাম্পাসে ছাত্র আন্দোলন তো দূরস্থান, বিক্ষোভ দানা বাঁধলেই নেমে আসে ছাত্রলীগের ক্ষমতার খড়গ। ক্ষমতার প্রতিস্পর্ধী, সচেতন, সরব বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস কী করে জনচেতনা জাগাতে পারে, সেই পথটা তো এবার দেখল ছাত্রলীগ। প্রতিটি নেতিবাচক ঘটনাই ইতিবাচক, যদি সেখানকার ভুলগুলো থেকে শেখার আগ্রহ থাকে। জানি না এবার সেই বোধোদয় হবে কি না।
ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে পরিস্থিতি। বুধবার থেকে নিয়মিত হয়েছে অফিস-আদালতের কার্যক্রম। কিছু রেলও চলাচল শুরু করেছে। জীবনের ক্ষয়ক্ষতি যা হয়েছে, তা পূরণ করা আর সম্ভব হবে না। যারা স্বজন হারিয়েছেন তাদের কথা একদিন সবাই ভুলে যাবে। সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিও কাটিয়ে ওঠা এত সহজ হবে না। তবুও বাংলাদেশকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে, শাসনব্যবস্থায় মানবিক ভাবনাটা নিশ্চিত করে এগোতে হবে সামনের পথে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, ঢাকা জার্নাল