মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫, ৯ বৈশাখ ১৪৩২
প্রভাষ আমিন
প্রকাশ : ৩১ জুলাই ২০২৪, ০২:৪১ এএম
আপডেট : ৩১ জুলাই ২০২৪, ০৮:৫৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

…এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়

…এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর এসে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের ইতিহাস অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে। আমরা ভুলতে বসেছি, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের গল্প। মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধ করেছিলেন বলেই আমরা একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। কিন্তু স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধারা প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান পাননি। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ২১ বছর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ছিল বিকৃত, মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন অবহেলিত। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে মুক্তিযোদ্ধাদের নানা সুযোগ-সুবিধা দেয়। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনে তরুণ প্রজন্মকে ভুল বুঝিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজপথে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে স্লোগান উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধে স্লোগান ছিল—‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি’। সেই স্লোগান বিকৃত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্লোগান উঠেছে—‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’। নব্বইয়ের দশকে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার হ‍ুমায়ূন আহমেদের একটি নাটকের সংলাপ ‘তু্ই রাজাকার’ দেশজুড়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ‘রাজাকার’ ছিল বাংলাদেশে একটা গালি। কিন্তু মাত্র তিন দশকেই অদ্ভুতভাবে পাল্টে গেছে সেই ন্যারেটিভ। ‘তুই রাজাকার’-এর জায়গা নিয়েছে ‘আমি রাজাকার’। স্বাধীন বাংলাদেশে এটা অনাকাঙ্ক্ষিত, বেদনাদায়ক। কোটা সংস্কারের দাবিতে যারা আন্দোলনে নেমেছিল, সেই তরুণ প্রজন্ম দেশকে ভালোবাসে, বাংলাদেশের ভালো চায়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি, স্বাধীনতাবিরোধী মহলটি কৌশলে মুক্তিযুদ্ধকে সেই তরুণ প্রজন্মের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। এটা আসলে তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ।

২৩ বছরের মুক্তিসংগ্রামের পর ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে এসেছিল স্বাধীনতা। কিন্তু সেই যুদ্ধটা অত সহজ ছিল না। ৯ মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। অস্ত্র হাতে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তাদের পাশে ছিলেন এ দেশের সাধারণ মানুষ। মুক্তিযুদ্ধ ছিল আসলে একটি জনযুদ্ধ। কিন্তু এ দেশেরই কিছু ব্যক্তি ও সংগঠন পাকিস্তানি হানাদারদের সহায়তা করেছে। স্বাধীনতাবিরোধীদের মধ্যে দুটি ধরন আছে। কিছু ব্যক্তি আছে, যারা আদর্শিক কারণে স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে বটে, কিন্তু কোনো অপরাধে অংশ নেয়নি। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধীদের একটা বড় অংশ স্বাধীনতার বিরোধিতা করেই বসে থাকেনি; তারা পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হিসেবে অস্ত্র হাতে দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তর করা—হেন কোনো যুদ্ধাপরাধ নেই, যা তারা করেনি। এই স্বাধীনতাবিরোধী দেশের শত্রুরা পাকিস্তানি হানাদারদের পাশে থেকে যুদ্ধে তাদের সহায়তা করত। মুক্তিযোদ্ধাদের খবর, তাদের বাড়িঘর, আত্মীয়স্বজনদের চিনিয়ে দেওয়ার কাজটা করত এ স্বাধীনতাবিরোধীরা। পাকিস্তানি হানাদারদের সরাসরি হস্তক্ষেপে তাদের এ দেশীয় দিয়ে গঠন করা হয় শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামসের মতো সংগঠন। নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে দাঁড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করতে তালিকা করে করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মিশন বাস্তবায়ন করেছে আলবদর, আলশামসরাই। একাত্তরে মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী, পিডিপির মতো আরও কিছু সংগঠন স্বাধীনতার বিরোধিতা করলেও তাদের নেতৃত্ব ছিল জামায়াতে ইসলামীর হাতে। জামায়াতের আমির গোলাম আযম ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধীদের মূল নেতা। জামায়াতে ইসলামীর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ যুদ্ধাপরাধে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের মূলনীতির অন্যতম ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাও ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়া। সেই চেতনার আলোকেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি তখন গর্তে লুকিয়ে ছিল। কিন্তু ৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে স্বাধীনতাবিরোধীদের কাছে টেনে নেন, প্রধানমন্ত্রী বানান রাজাকার শাহ আজিজকে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের সুযোগ উন্মুক্ত করা হয়। এই সুযোগে আবার মাঠে নামে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির নামে পুনর্গঠিত হয় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ। দেশে ফিরে আসেন পাকিস্তানি নাগরিক রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযম। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দাপটের সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশে মাঠে নামে জামায়াত-শিবির। আশির দশকে আমরা স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। কিন্তু তখন মাঠে আমাদের লড়াই ছিল দ্বিমুখী। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পাশাপাশি আমাদের লড়তে হয়েছে ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধেও। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসলামী ছাত্র সংঘের নৃশংসতার ধারাবাহিকতা বজায় রাখে ইসলামী ছাত্রশিবির। হাত কেটে দেওয়া, রগ কেটে দেওয়া, হত্যা—ছাত্রশিবির ছিল এক আতঙ্কের নাম। আশির দশকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ছাত্রশিবির ক্যান্টনমেন্ট বানিয়ে ফেলেছিল। ছাত্রজীবনে আমাদের নিত্য স্লোগান ছিল ‘জামায়াত-শিবির রাজাকার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’। কিন্তু বাংলা ছাড়া তো দূরের কথা, ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতায় স্বাধীনতাবিরোধীরা আরও হৃষ্টপুষ্ট হয়। স্বৈরাচার পতনের পর বিএনপি ক্ষমতায় এলে জামায়াতে ইসলামী আরও সংগঠিত হয়। ’৯১ সালে গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হলে দেশজুড়ে তীব্র প্রতিবাদ গড়ে ওঠে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিতে অভাবনীয় গণজাগরণ ঘটে দেশে। কিন্তু বিএনপি সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বা জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ তো করেইনি, বরং শহীদ জননী জাহানারা ইমামসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করে। বিএনপি জামায়াতকে আরও কাছে টেনে নেয়। ২০০১ সালে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার দুই যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দেয়। স্বাধীনতাবিরোধীদের গাড়িতে আবার ওঠে জাতীয় পতাকা।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেয়। গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বিচারে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই দণ্ডিত হয়, অনেকের ফাঁসি কার্যকর হয়। তখন আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ে সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকেও অভিযুক্ত করা হয়। ২০১৩ সালে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করা হয়। তবে জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি সত্ত্বেও জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। নিষিদ্ধ না হলেও জামায়াত-শিবিরের তৎপরতা সব নিষিদ্ধ সংগঠনের মতোই। ২০১৩-১৪ সালে দেশজুড়ে অগ্নিসন্ত্রাসের মূল কারিগর জামায়াত-শিবির। সর্বশেষ কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ১৬-২০ জুলাই ঢাকাসহ সারা দেশে যে তাণ্ডবলীলা চালানো হয়েছে, তার পেছনেও জামায়াত-শিবিরই মূল বলে তদন্তে বেরিয়ে আসছে। অবশেষে টনক নড়েছে আওয়ামী লীগেরও। ২৯ জুলাই রাতে গণভবনে ১৪ দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছে। আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, বুধবারের মধ্যেই জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এতদিন জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ না করার ব্যাপারে ক্ষসতাসীনদের যুক্তি ছিল, নিষিদ্ধ করলে তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে আরও সন্ত্রাস করবে। তবে ‘আরও সন্ত্রাস করবে’ এ ভয়ে জামায়াত-শিবিরের মতো ভয়ানক কালসাপকে নির্বিঘ্নে চলতে দেওয়ার কোনো অর্থ নেই। বিশ্বের কোনো দেশেই স্বাধীনতাবিরোধীরা রাজনীতি করার সুযোগ পায় না। জার্মানিতে এখনো হিটলারের দল নাৎসি পার্টির রাজনীতি করার অধিকার নেই। তবে এটা ঠিক, নিষিদ্ধ করলেই জামায়াত-শিবির ভালো হয়ে যাবে না, দেশও ছাড়বে না, হাওয়ায় মিলিয়েও যাবে না। তাই নির্বাহী আদেশে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। চালাতে হবে আদর্শিক লড়াই। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় থাকলেও রাজপথে আজ মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে স্লোগান ওঠে। এ ব্যর্থতার দায় অবশ্যই আওয়ামী লীগকে নিতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানাতে হবে, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের গল্প শোনাতে হবে। স্বাধীনতাবিরোধীদের নৃশংসতার কথা জানাতে হবে। আমার সবচেয়ে বড় শঙ্কা হলো, নিষিদ্ধ হলে জামায়াত-শিবির ভোল পাল্টে মূলধারার অন্য রাজনৈতিক দলে ঢুকে যেতে পারে। গত ১৫ বছরে জামায়াত-শিবিরের অনেকে আওয়ামী লীগেও ঢুকে পড়েছে বলে প্রায়ই অভিযোগ শোনা যায়। তাই জামায়াত-শিবির যাতে পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ না পায়, তাও নিশ্চিত করতে হবে। শুধু নিষিদ্ধ করাই যথেষ্ট নয়, জামায়াত-শিবিরকে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করতে হবে, তাদের আদর্শের শিকড় উপড়ে ফেলতে হবে।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি মডেল ইউনাইটেড নেশনস অ্যাসোসিয়েশনের ১০ বছর পূর্তি

ছাত্রলীগ কর্মীকে পিটিয়ে রিকশায় ঘোরানো ছাত্রদল নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা

নারায়ণগঞ্জে চাঞ্চল্যকর সোহান হত্যা মামলার প্রধান আসামি গ্রেপ্তার

আ.লীগের হাতে গত ১৫ বছর আলেম সমাজ লাঞ্ছিত হয়েছে : রহমাতুল্লাহ

চট্টগ্রামে পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীরা এবার বসলেন আমরণ অনশনে

বগুড়ায় ৫ ইউএনওর মোবাইল নম্বর ক্লোন করে চাঁদা দাবি

৩ মিনিটের ঝড়ে লণ্ডভণ্ড ফরিদপুর

ইরান নিয়ে ইসরায়েলের সামনে এখন ‘প্ল্যান বি’

আ.লীগের মিছিলের প্রস্তুতির সময় বিএনপি নেতার ছেলে গ্রেপ্তার

১০০ আসনে নারীদের সরাসরি নির্বাচন চায় এনসিপি

১০

সরিয়ে দেওয়া হলো স্বাস্থ্য উপদেষ্টার এপিএসকেও

১১

রেকর্ড ভেঙে সোনার দামে নতুন ইতিহাস

১২

আরেক দেশকে নিয়ে ‘বিশাল যুদ্ধ মহড়ায়’ যুক্তরাষ্ট্র

১৩

বাকেরগঞ্জে কারখানা নদীর বালুমহাল ইজারা বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন

১৪

টানা পাঁচ দিন ঝরবে বৃষ্টি    

১৫

কালবৈশাখী ঝড়ে লণ্ডভণ্ড মিরসরাই

১৬

মেজর সিনহা হত্যা মামলার আপিল শুনানি বুধবার

১৭

লেভানডভস্কির চোটে বার্সা শিবিরে দুঃশ্চিন্তা

১৮

ডিসি শাকিলাকে রেলওয়ে পুলিশে বদলি

১৯

ছাত্রদলে পদ পেতে স্ত্রীকে তালাক, ফয়সাল রেজার অব্যাহতি

২০
X