মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১
ইলিয়াস হোসেন
প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০২৪, ০৩:০৮ এএম
আপডেট : ৩০ জুলাই ২০২৪, ০১:২৬ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

‘আসলে-কিন্তু’র ঘেরাটোপে টিভি সাংবাদিকতা!

‘আসলে-কিন্তু’র ঘেরাটোপে টিভি সাংবাদিকতা!

শুরুর দিকে বেসরকারি টেলিভিশনের সংবাদ, দেশের গণমাধ্যমে বিপ্লব আনে। সিনেমা-নাটকের চেয়েও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সংবাদ ও সংবাদসংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানমালা। রিপোর্টার-উপস্থাপক তারকা খ্যাতি পেতে থাকেন। ঝকঝকে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো কর্মীদের ড্রেস কোড, পরিবহন সেবা, ক্যাটারিংয়ের ক্ষেত্রেও স্মার্টনেসের প্রতিযোগিতায় নামে। সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনে স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠায় থাকে আপসহীন। ভয়েস-কালার-সাউন্ড-গ্রাফিকস-ইফেক্ট দেখেই আলাদা করা যেত তাদের।

পত্রিকার অভিজ্ঞ, পরিশ্রমী, স্বপ্নবাজ সাংবাদিকদের নিয়েই বেসরকারি টেলিভিশনের নিউজরুম সাজানো হয়। বিটিভির সাবেক দু-চারজন ছাড়া, বেশিরভাগেরই টেলিভিশন সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা ছিল না। তবে, বিবিসি-সিএনএন দেখার অভ্যাস ছিল অনেকেরই। পত্রিকায় দীর্ঘ ক্যারিয়ার থাকার পরও সবাই ইন-হাউস টিভি সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ নেন। দেশি-বিদেশি প্রশিক্ষকের ক্লাসে ছোট-বড়, অনভিজ্ঞ-অভিজ্ঞরা পাঠ নেন পরম আন্তরিকতার সঙ্গে। দেশের প্রখ্যাত বাচিক শিল্পীদের দিয়ে কণ্ঠশীলনের ব্যবস্থা করা হয়। সবার চোখেমুখে তখন নতুন স্বপ্ন জয়ের আকাঙ্ক্ষা।

উচ্চারণ প্রমিত না হলে, বড় রিপোর্টারের স্ক্রিপ্টেও কণ্ঠ দিত অন্য কেউ। নতুন রিপোর্টার প্রথম ছয় মাস OOV (Out Of Vision) করতেন। অর্থাৎ ৩০ সেকেন্ডের নিউজে ফুটেজ দেখানো হয় আর প্রেজেন্টারের কণ্ঠ শোনা যায়। এরপর প্যাকেজ (রিপোর্টারের কণ্ঠসহ) বানানোর সুযোগ পেতেন। আর লাইভ! সে ছিল রিপোর্টিং লাইফের আরাধ্য বিষয়। প্রতিটি চ্যানেলের দু-চারজন এ সুযোগ পেতেন, যারা স্বতঃস্ফূর্ততার মূর্ত প্রতীক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। আর এ ব্যাপারগুলো রিলিজিয়াসলি মানা হতো নিউজরুমে।

দিনভর পরিশ্রমের পর সন্ধ্যার বুলেটিনে নিজের রিপোর্টটি দেখার জন্য নিউজরুমেই উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করতেন রিপোর্টাররা। অন-এয়ার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়ে যেত রিপোর্ট নিয়ে। মুক্ত আলোচনায় যোগ দিয়ে নিজেকে ঝালাই করতেন সিনিয়র-জুনিয়র সবাই। এর সঙ্গে অনিবার্যভাবে চলে আসত ভিডিও এডিটর ও ক্যামেরাপারসনের প্রসঙ্গ। কেননা, টিভি সাংবাদিকতার ৮০ শতাংশ নির্ভর করে ফুটেজের ওপর। মেকিং ভালো হলে খাওয়ানোর চাপ, মন্দ হলে মৃদু রসিকতার মধ্য দিয়ে শিখে নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যেত।

টিভি সাংবাদিকতা আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর পতনও লেখা হতে থাকে ভেতরে ভেতরে। পত্রিকার চেয়ে ভালো বেতন ও চেহারা প্রদর্শনের সুযোগ থাকায় তরুণদের মধ্যে টিভি সাংবাদিক হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। সিনেমার অবস্থা পড়ে যাওয়ায়, ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ প্রকল্পে নাম না লিখে টেলিভিশন সাংবাদিকতায় চলে আসেন অনেকে। কালো টাকা সাদা ও সামাজিক প্রতিপত্তির মোহে অনেক উদ্যোক্তা এগিয়ে আসেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় বেসরকারি টেলিভিশনের সংখ্যাও বাড়তে থাকে।

দ্রুত চাহিদা পূরণে রাতারাতি যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত করা হয় না নতুন নেওয়া কর্মীদের। প্রথম বেসরকারি টিভি চ্যানেলের রিপোর্টাররা তারকাখ্যাতি পেলেও পরের ছয়টি টিভির রিপোর্টাররা পান শুধু পরিচিতি। তারও পরে আসা চ্যানেলগুলোর রিপোর্টারদের মোহভঙ্গ হতে থাকে। সেলিব্রেটি হয়ে ওঠার চিন্তা বাদ দিয়ে নিজেকে শুধু চাকরিজীবী ভাবতে থাকেন। ফলে শেখার আগ্রহ, পেশার প্রতি ডেডিকেশন, দেশের প্রতি কমিটমেন্ট, সহকর্মীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকার বিষয়গুলো তাদের কাছে সেকেলে মনে হতে থাকে। বাইরের রাজনৈতিক ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক কেউ কেউ নিউজরুম পর্যন্ত নিয়ে আসেন। এর সঙ্গে যোগ হয় কর্তৃপক্ষের সুনজরের প্রভাব। এতে করে নিউজরুমের ধ্রুপদি চাঞ্চল্য ম্লান হতে থাকে প্রতিদিনের নিয়মিত রুটিনের অভ্যাসে।

ছোট্ট বাজারে সংখ্যায় বেশি হওয়ায় চ্যানেলগুলোর বাণিজ্যে টান পড়ে। একসময় প্রচুর আয় করলেও, ইকুইপমেন্ট (যন্ত্রপাতি) হালনাগাদে আগ্রহ দেখান না মালিকরা। জোড়াতালি আর খরচ কমিয়ে স্টেশন চালানোর পাঁয়তারা শুরু করেন। জনপ্রিয় মজলুম হিসেবে বহুল পরিচিত সাংবাদিকদের কেউ কেউ বার্তা বিভাগের প্রধান হয়ে একেকটি টেলিভিশন পরিচালনা শুরু করেন। এটা করতে গিয়ে কেউ কেউ পুরোদস্তুর আমলা বনে যান। বার্তাপ্রধান বা প্রধান সম্পাদক হয়েও মন ভরে না। তারা সিইও, ইডি নানা মাথাভারী পদে নিজেকে বন্দি করেন। নিজের প্রশংসা শুনে চিহ্নিত ফাঁকিবাজকেও পুরস্কৃত করেন। গদি রক্ষায় অযোগ্যদের কানকথা শুনে অফিসে ক্ষতিকর গ্রুপিং চর্চাকে উৎসাহ দেন। বিপরীত লিঙ্গের অধস্তন সহকর্মীকে মনের কথা বলতে চান। সরাসরি না নিয়ে, নিজের এজেন্সিতে পার্সেন্টেস রেখে কর্মস্থল চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেন কেউ কেউ। নিজের অর্জিত দুর্বলতায় মালিকের দুরভিসন্ধি বুঝেও হাত মেলান তারা। নিজের বেতন-সুবিধা অক্ষুণ্ন রেখে বেশি খরচের অজুহাতে দক্ষ কর্মী বাদ দেন। বাদ দেওয়ার কারণ নিয়েও নানারকম ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেন। অমুকরা চায় না, তমুকের সঙ্গে বেয়াদবি করেছে—এরকম অপবাদ দেওয়া হয়। একজনের বেতনে তিনজন নিয়ে মালিকের লাভ (!) করে দেন তারা। এই প্রভাব-প্রতিপত্তি বজায় রাখতে মন্ত্রী-আমলাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখেন। কোনো কোনো সময় সে সম্পর্ক নীতি-নৈতিকতা প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। এতে আখেরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে টেলিভিশনসহ সবাই। যদিও কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে পদত্যাগ করতে দেখা গেছে দুয়েকজনকে। ব্যতিক্রম অবশ্য উদাহরণ নয়।

টেলিভিশনগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে এখন কোটার কাছে মেধা মার খাচ্ছে। বর্তমানে মালিক-রাজনীতিবিদ-আমলা-বিজ্ঞাপনদাতাদের নামে কোটা দাঁড়িয়ে গেছে। আজকাল বাম হাতের কারবার করে ঢোকার কথাও শোনা যায়। একজন রিপোর্টারের বেতনে আসা তিনজনের অবস্থা বেশ করুণ। তারা শেষ পর্যন্ত রিপোর্টার নাকি সাপোর্টার, এ দ্বান্দ্বিক পরিচয়ে ভোগেন। যোগাযোগ ভালো থাকলে এর মধ্য থেকেও সত্যিকারের মেধাবীরা জায়গা করে নেন। অন্যরা বাজে রিপোর্টিং ও ভুলভাল উচ্চারণে দর্শকদের যন্ত্রণা দেন। প্রস্তুতি ছাড়াই লাইভে গিয়ে ‘অ্যা-উঁ-আসলে-কিন্তু’ নানা শব্দের সমাহার ঘটিয়ে বিষয়টি জটিল করে তোলেন। একই কথা একই শব্দ বারবার বলে দর্শককে জব্দ করেন। যে কোনো বিষয় অহেতুক ফেনায়িত করায়, ওই বিষয়ে রিপোর্টারের অন্তঃসারশূন্যতা প্রকাশ পায়। প্রতিবাক্যে ‘আসলে-কিন্তু’ বলে তথ্যের অর্থ বিকৃতি ঘটায়। আমতা আমতা করায় নিউজের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়ে। বিশেষ ঘটনার দিনে ব্যাপারটি বেশি চোখে পড়ে, কানে লাগে। এমনিতেই নানা কারণে আজকাল গণমাধ্যমকে বিশ্বাস করতে চান না সাধারণ মানুষ। অবিশ্বাসের তালিকায় বোধকরি টেলিভিশন সাংবাদিকতাকেই এগিয়ে রেখেছেন জনগণ।

বাহুল্য বর্জন, সঠিক শব্দচয়ন ও প্রাণবন্ত উপস্থাপন চর্চার বিষয়। আজকাল সেই সময় ও ধৈর্য কোনোপক্ষের মধ্যেই দেখা যায় না। সবাই কেমন কাঁধ ঝাঁকান। ব্যাপার না, এত খেয়াল করে কে, এখন এই সব চলে... এরকম আপ্তবাক্য দিয়ে দিন পার করে দেন অদক্ষ সংবাদকর্মীরা। কিন্তু দিনশেষে ক্রমাবনতি দেখে দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। টিকার বা স্ক্রলের বানান দেখে লোক হাসাহাসি করে। অথচ নিউজরুমের সবচেয়ে নবীন ও অযোগ্য লোকটিকে এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়।

মাত্র দুই দশকে দেশের অপার সম্ভাবনাময় বেসরকারি টেলিভিশন শিল্পে বার্ধক্য নেমে এসেছে। নতুন প্রযুক্তি তথা বিনিয়োগে আগ্রহ নেই মালিকের। বেতন বকেয়া রাখা আর ইনক্রিমেন্ট না দেওয়াটা স্বাভাবিক রীতি হয়ে যাচ্ছে। হতাশায় বেশিরভাগ কর্মীরই প্রেম নেই স্টেশনের প্রতি। অ্যাসাইনমেন্টে গিয়ে নিজের ইউটিউব চ্যানেলের কাজে ব্যস্ত থাকেন অনেক রিপোর্টার-ক্যামেরাপারসন। ফলে, অফিসের কাজটি ঠিকমতো হয় না। মালিক মনে করেন, কর্মীদের পাওনা না দিয়ে লাভ করছেন। কর্মীরা মনে করছেন, অফিসকে ঠকাচ্ছেন। আসলে ঠকছে গণমাধ্যম, ঠকছে মানুষ, সর্বোপরি দেশ।

নবম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নের ফলে এখন কোনো কোনো পত্রিকার রিপোর্টাররা বেশ হ্যান্ডসাম স্যালারি পান। এ ছাড়া নতুন নতুন পত্রিকা ও অনলাইন বাজারে আসায় ওয়েজ বোর্ড অনুযায়ী দরকষাকষির সুযোগ পাচ্ছেন তারা। কিন্তু টেলিভিশনে চাকরির বাজারে ক্রমাবনতি। এমনকি কোনো কোনো বেসরকারি চ্যানেলের ড্রাইভারের চেয়েও কম বেতন ধরা হয় নবীন রিপোর্টারের জন্য।

অভ্যন্তরীণ এসব নেতিবাচক চর্চাকে উসকে দিয়েছে রাষ্ট্রীয় অনাচার, প্রশ্নবিদ্ধ গণতন্ত্র আর সর্বগ্রাসী দুর্নীতি। বিতর্কিত ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন ধরনের সম্পদ রক্ষায়ও ব্যবহৃত হচ্ছে কোনো কোনো টেলিভিশন চ্যানেল।

যার যে কাজ, তাকে তাই করতে দিতে হবে। জায়গার জিনিস জায়গায় ফেরাতে হবে। আলু-পটোল, আদম বা নিরাপত্তা ব্যবসায় অভিজ্ঞদের দিয়ে সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ ঠিক করা যাবে না। সাংবাদিকতায় শিক্ষা-গবেষণা-চর্চার বিকল্প নেই। বিরাট ধনী হওয়ার জন্য সাংবাদিকতা পেশা নয়। যারা সাংবাদিকতা পুঁজি করে ধনী হয়েছেন, তারা কোনো না কোনোভাবে সাংবাদিকতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। সাংবাদিকতা হোক সাহসী, মননশীল ও রুচিশীল মানুষের পবিত্র পেশা।

লেখক: যুগ্ম সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কালবেলায় সংবাদ প্রকাশের পর প্রতিবন্ধী রনি পেল হুইলচেয়ার

শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে : আবু হানিফ

ক্রীড়াবিদ শওকত আলীর স্মরণে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল

শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

রাসূল (স.) আদর্শ ধারণ করে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে

ঝিনাইদহে নাশকতা মামলায় ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী সুজনের গ্রেপ্তারের খবরে বিএনপির আনন্দ মিছিল

মানিকগঞ্জে ধলেশ্বরী নদী থেকে অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার

ভূমি উপদেষ্টার পরিদর্শন, হয়রানি ছাড়া নামজারি খতিয়ান পেয়ে উৎফুল্ল নাজিম  

১০

চট্টগ্রামে জশনে জুলুশে মানুষের ঢল  

১১

বন্যা পরবর্তী প্রাণী চিকিৎসায় বাকৃবি শিক্ষার্থীরা

১২

‘দুনিয়া ও আখিরাতে মুক্তির জন্য রাসুল (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করতে হবে’

১৩

নার্সের ভুলে ৩ দিনের শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ

১৪

‘স্মরণকালের সবচেয়ে বড় গণসমাবেশ’ করার প্রস্তুতি বিএনপির

১৫

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালিত

১৬

রাত ১টার মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের আভাস

১৭

সিরাজগঞ্জে কবরস্থানে মিলল অস্ত্র ও গুলি

১৮

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে জামায়াতের নায়েবে আমিরের মতবিনিময়

১৯

২৮ থেকে ৪২তম বিসিএসের বঞ্চিত সেই ক্যাডাররা ফের বঞ্চনার শিকার

২০
X