ধান, গম ও ভুট্টা মিলিয়ে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট উৎপাদন দাঁড়ায় ৪ কোটি ৪৩ লাখ ৫৯ হাজার টনে। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৪ কোটি ৬৫ লাখ ৮৭ হাজার টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন ছিল ৪ কোটি ৩০ লাখ ৩৬ হাজার টন। অর্থাৎ খাদ্যের উৎপাদন বাড়ছে। আমরা এখন ‘আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে দাবি করতে পারি। আমাদের জনগোষ্ঠীর খাদ্যচাহিদা আমরা মেটাতে পারব। কোনো ঘাটতি দেখা দেবে না।’ ‘খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলছি এ ধারণা থেকে যে, আমাদের প্রায় ৩৭ লাখ গরু রয়েছে। জনসংখ্যার তুলনায় যা যথেষ্ট। আর বিশ্বের মাছ উৎপাদন বাড়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়তে রয়েছে বাংলাদেশ। আমাদের গবাদি পশুর জন্য দেড় থেকে দুই কোটি মেট্রিক টন দানাদার খাদ্যশস্য লাগে। সে কথা বিবেচনা করলে বিপুল এ পরিমাণ গবাদি পশু ও মানুষের খাবারের পুরোটাই আমরা উৎপাদন করছি।’
‘বিশ্বজুড়ে মন্দার কথা হচ্ছে; কিন্তু বড় কোনো জলবায়ু বিপর্যয় দেখা না দিলে বাংলাদেশে কোনো সমস্যা হবে না। নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমরা নিজেদের চাহিদা পূরণ করে প্রতিবেশী দেশগুলোকেও সহায়তা করতে পারব।’ বিগত দিনে ৭ কোটি থেকে ১৭ কোটিতে। আর প্রবৃদ্ধির হার হলো বার্ষিক ১.৯ শতাংশ। অর্থাৎ জনসংখ্যার চেয়ে খাদ্যশস্যের প্রবৃদ্ধির হার বেশি, যা ‘খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ’ বলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দাবিরই সত্যতা প্রমাণ করে।
ধানের বীজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ছয় লাখ বিঘায় এবার বোরো ধানের প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এবার আউশ-আমন-বোরো মিলে চার কোটি মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হবে। আমাদের মোট ৩ কোটি ৯৮ লাখ মেট্রিক টন ধান দরকার। যুদ্ধ-মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে দাবি করে তিনি বলেন, ‘সংকট সামাল দেওয়ার জন্য আমরা পরিপূর্ণ প্রস্তুত।’
কৃষকরা এখন তিন ব্যাচে বীজ মজুত রাখেন, যাতে একটি মার খেলে আরেকটি দিয়ে তা পূরণ করা সম্ভব হয়। কৃষকরা বলছেন, ‘আমাদের বীজ সহায়তা দরকার নেই।’ আমাদের এখানে খাদ্য ঘাটতির বা দুর্ভিক্ষের কোনো শঙ্কা নেই। যদিও গম উৎপাদন একটু কম; কিন্তু এটি আমাদের দেশের ফসল নয়।
করোনা সংক্রমণের কারণে দেশের সবকিছু যখন স্থবির, তখনো সচল ছিল কৃষির চাকা। এরই মধ্যে চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ দুঃসময়ে কৃষিই সম্ভাবনার পথ দেখাচ্ছে। শুধু করোনা সংকটে নয়; গত এক দশকে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলে কৃষি বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ধান, গম, ভুট্টা, আলু, সবজি ও মাছ উৎপাদনে শীর্ষ কাতারে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে পেঁয়াজের উৎপাদন ছিল ৩৫ লাখ টন, যা আগের অর্থবছরে ছিল ২৫ লাখ ৬০ হাজার টন। বাজারে দামের বিচারে পেঁয়াজ সবসময় আলোচনায় থাকে। আমাদের একটি গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের জাত বারি-৫ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট আবিষ্কার করেছে। এ ছাড়া ভারত থেকে এম-১৫ জাতের গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের বীজ এনে চাষ করা হয়েছে।
বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে তাচ্ছিল্য করা হয়েছিল। সেই বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি ছিল একসময় এ অঞ্চল। কিন্তু কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসে শিল্প ও সেবা খাতমুখী হয়েছে অর্থনীতি। সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেছে অর্থনৈতিক কাঠামোও। বিশাল জনসংখ্যার দেশে কৃষিজমি কমলেও কৃষি এখনো অর্থনীতির প্রাণ। প্রযুক্তির ছোঁয়া পেয়েছে কৃষি। বদলে যাওয়া এ সময়ে কৃষিতে যুক্ত হচ্ছেন শিক্ষিত তরুণরাও। ফলে খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে অনন্য উদাহরণ। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের অগ্রগতিতে প্রধান ভূমিকা কৃষক, কৃষিবিজ্ঞানী ও উদ্যোক্তাদের। তাদের সাফল্যের কারণে খাদ্য ঘাটতি থেকে আজ খাদ্যে অনেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। কৃষি বিজ্ঞানীদের খাদ্যশস্যের নতুন নতুন জাতের উদ্ভাবন, ভর্তুকি দিয়ে সার ও সেচের পানিপ্রাপ্তি সহজ করা, বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগসহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবন, ১ কোটি ৮০ লাখেরও বেশি কৃষকের মধ্যে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড বিতরণ, ১০ টাকার বিনিময়ে কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলাসহ নানা রকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে গত ১৪ বছরে।
যে কারণে বাংলাদেশ কৃষিতে পেয়েছে অভাবনীয় সফলতা। প্রতি বছরই বাংলাদেশে আবাদি জমি কমছে। শহরায়ণ ও নগরায়ণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন তৎপরতার কারণে বছরে দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ জমি কমছে। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এ জমি কমলেও আমাদের গবেষকরা এমন সব ধান, গম ও শস্যের জাত আবিষ্কার করছেন, যার ফলে এ স্বল্প জমিতেও আমরা সাফল্য ধরে রাখতে পেরেছি।
২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে রেকর্ড ৩ কোটি ৮৯ লাখ টন চাল উৎপাদন করে ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে দেয় বাংলাদেশ। আর চাল উৎপাদনকারী শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে দেশটি। এ ছাড়া ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম, পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, মৎস্য উৎপাদনে তৃতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম এবং আলু উৎপাদনে সপ্তম স্থানে রয়েছে। এ ছাড়া কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বের দ্বিতীয় এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে বাংলাদেশ। অন্যদিকে কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, বছরে ১০ শতাংশ হারে ফল চাষের জমি বাড়ছে। এক দশকে দেশে আম উৎপাদন দ্বিগুণ, পেয়ারা দ্বিগুণের বেশি, পেঁপে আড়াই গুণ এবং লিচু উৎপাদন ৫০ শতাংশ হারে বেড়েছে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চার গুণ, গম দুই গুণ, ভুট্টা ১০ গুণ ও সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। খাদ্যশস্য ছাড়াও মাছ উৎপাদনেও বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে মাছ রপ্তানিও বাড়ছে। আলু উৎপাদনে উদ্বৃত্ত। তাই দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা আর ক্ষুধার দেশে এখন ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহে। গবেষণা করে বিভিন্ন ফসলের ৯৭২টি জাত ও ১৩৯২টি উন্নত কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন কৃষিবিজ্ঞানীরা। দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতে এটি বড় ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে মুখ্য ভূমিকা রেখে চলেছে এ প্রযুক্তি। বিশেষ করে বিনা ১৬, বিনা ১৭ ধান ব্যাপক ভালো হচ্ছে; কৃষকরাও সুফল পাচ্ছেন। বিনা ধান-১৭ খরাসহিষ্ণু স্বল্পমেয়াদি। সার কম লাগে উন্নত গুণাগুণ সম্পন্ন আমন ধানের এ জাতটিতে। লবণাক্ত এলাকা ছাড়া দেশের সব রোপা আমন অঞ্চল বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে জাতটির অধিক ফলন পাওয়া যায়। সার্বিক অর্থে আমাদের দেশে কৃষি উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে, যা সম্ভব হয়েছে কৃষি খাতে আধুনিকায়নের ফলে।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক-বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.