একটি সার্বভৌম দেশের সরকার এবং রাষ্ট্রের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য আছে, এটা বুঝতে কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হতে হয় না। রাষ্ট্র একটি দেশে জন্মগ্রহণকারী সব নাগরিকের। কিন্তু সরকার গঠিত হয় একটি অংশের বিবেচনায়, পছন্দে। সেই সরকার একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনার ভার গ্রহণ করে অনেকটা ঠিকাদার হিসেবে। দরিদ্র দেশগুলোতে বেশিরভাগ সময়ে ভোট কারচুপি হয়, যেহেতু রাষ্ট্রের অর্গান, মেশিনারিজগুলো সরকার পরিচালনার দায়িত্বে থাকা দলের নিয়ন্ত্রণে থাকে। তখন বিরোধী দলগুলো আন্দোলন করে। কখনো তারা আন্দোলন জমিয়ে তুলতে পারে জনগণের প্রত্যক্ষ সমর্থনে, আবার কখনো জনগণকে সম্পৃক্ত করতে না পেরে আন্দোলন জমাতে পারে না এবং সরকারের সমালোচনায় মুখর থাকে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা শুরুর পর থেকেই এ ধারা চলে আসছে বিশেষ করে অনুন্নত দেশগুলোতে। কিন্তু বাংলাদেশে জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে সরকারবিরোধীদের সহিংস আন্দোলনের যে চেহারা আমরা দেখতে পেলাম তাতে এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, এই আন্দোলনটি কি সরকারের বিরুদ্ধে নাকি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে?
একটি ছাত্র আন্দোলন শুরু হলো কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে। সেই কোটাব্যবস্থার সিদ্ধান্তটি সরকারের নয়, দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। অফিসিয়ালি সরকার নিজেও ছিল কোটা সংস্কারের পক্ষেই। কিন্তু শিক্ষার্থীসমাজ যথার্থই ধারণা করল, সরকার আসলে কোটা সংস্কার চায় না। আন্দোলনের প্রাথমিক অবস্থায় দেখা গিয়েছিল, সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অনেক কর্মীও এই কোটাবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। অথচ দুটি কারণে এ আন্দোলন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হলো। প্রথমত, যে বিরোধী দলগুলো শতচেষ্টা করেও সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন জমাতে ব্যর্থ হচ্ছিল, তারা ছাত্রদের পেছনে এসে দাঁড়াল। আর যখনই সরকার তাদের দেখতে পেল, তখন মাথা ঠান্ডা রাখতে না পেরে বিরোধী দলের ফাঁদে পা দিয়ে বসল। কোনো অ্যাকশনের মাধ্যমে নয়, সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল বক্তব্যের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের ঠেলে দিল বিরোধী দলের কোর্টে। আর তখনই শিক্ষার্থীদের ব্যানারে সরকারবিরোধীরা নেমে পড়ল শুধু সরকার নয়, রাষ্ট্রকে অকার্যকর করে ফেলার জন্য!
কিন্তু এবার রাস্তায় প্রতিবাদের যে নিষ্ঠুর পথ বেছে নেওয়া হয়েছে, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনোই দেখা যায়নি। লক্ষ করুন, ধ্বংস করতে চেষ্টা করা হয়েছে বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং তা আংশিক ধ্বংসও হয়েছে। বিটিভি রাষ্ট্রের সম্পদ। সবাই জানে যে, দল যখন ক্ষমতায় থাকে তখন সেই দলের মুখপত্র হিসেবে কাজ করতে হয় এই সরকারি সম্প্রচার মাধ্যমকে। কিন্তু রাজনীতির কথা বাদ দিলে বিটিভির অসংখ্য প্রোগ্রাম আছে, যা দেশের কৃষি, অর্থনীতি, শিল্প-সাহিত্যসহ বহু দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে। এ প্রতিষ্ঠানের ওপর শুধু সেই হামলা করতে পারে, যে রাষ্ট্রটিকেই মানে না। আন্দোলনকারীরা হামলা চালিয়েছে মেট্রোরেলে। স্বৈরাচার, মিলিটারি শাসক থেকে শুরু করে প্রতিটি সরকারের প্রধান একটি দায়িত্ব থাকে দেশের অবকাঠামো ও অর্থনীতির উন্নয়ন করা। বিগত ১৫-২০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভলিউম অনেক বড় হয়েছে, ফলে সরকার অনেক মেগা প্রজেক্ট হাতে নিয়ে সফল হয়েছে। তারই একটি মেট্রোরেল। এ প্রজেক্ট বাস্তবায়ন সত্যিই মানুষের কাছে স্বপ্নপূরণ মনে হয়েছে। মেট্রো ব্যবহার করা প্রতিটি মানুষের মধ্যে দেখা যায় এক পরম তৃপ্তির অভিব্যক্তি। এটি গড়ে তুলতে ব্যয় করতে হয়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। অবশ্যই জনগণের টাকায় এবং এই মেট্রোর সুবিধা ভোগ করে দলমত নির্বিশেষে সব মানুষ। যে এটিকে তার সম্পদ মনে করে, রাষ্ট্রের সম্পদ মনে করে সে এই স্টেশন ধ্বংস করতে পারে না! নরসিংদী কারাগারে ভয়াবহ হামলা করে ৮২৬ জন বন্দিকে মুক্ত করে দেয় কারা? একটি মানুষকেও সরকারের ক্ষমতা নেই বিচার বিভাগকে এড়িয়ে জেলখানায় ঢুকিয়ে রাখার। জেলখানায় হামলা আমরা দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে প্রায়ই দেখে থাকি। সেখানে যারা হামলা করে তাদের কিচ্ছু আসে যায় না রাষ্ট্র পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও। বাংলাদেশে যারা এ কাজ করল তারাও কি সেই চিন্তা করে? এই হামলাকারীদের একটি বড় অংশ অবশ্যই তাই ভাবে। ১৯৭১ সাল থেকে তারা এ দেশকে অস্বীকার করার সুযোগ খুঁজে আসছে। তবে এটাও সত্য যে, এ ধারাকে অনেকটা সুযোগ করে দিয়েছে আওয়ামী লীগের কিছু মানুষের দুর্বল চরিত্র, যা সঠিকভাবে দলটি চিহ্নিত করতে পারেনি। যেমন আওয়ামী লীগের হাত দিয়েও হাজার হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার জন্ম হয়েছে। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধকে স্বাধীনতাবিরোধীরা খাটো করে দেখার সুযোগ পেয়েছে।
সর্বশেষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, সহিংসতায় নিহত হয়েছে ১৪৭ জন। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে এত মানুষের মৃত্যু কেউ কল্পনাও করেনি। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে ক্ষমতা থেকে নামাতে জীবন দিতে হয়েছিল নুর হোসেন, ড. মিলনসহ কয়েকজনকে। তাতেই এরশাদের গদি খসে পড়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবিচল এবং বেঁচে থাকলে তিনি তার এই টার্ম পূরণ করবেনই। এর প্রথম এবং একমাত্র কারণ জাতি এখন পরিষ্কার দুটি আদর্শিক ধারায় বিভক্ত। মুখে স্বীকার করুক আর না করুক, বিএনপি-জামায়াত ধারার মেইনস্ট্রিম বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত। তাই সংখ্যায় কে কত সেটা বড় প্রশ্ন নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। যদিও একাত্তরের বঙ্গবন্ধুর মতোই তাকে দেশি এবং বিদেশি শক্তিকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
আমার কাছে খুবই অবাক লাগে যে, প্রধানমন্ত্রী এবং তার দল একটুও মেঘ দেখতে পেলেন না? তিনি নিজেই তো বারবার বলে আসছিলেন তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কথা! কেমন যেন অনেক কিছুই এখন ১৯৭১ সালের মতো লাগে! তখন চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রশ্নে ছিল একাট্টা। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের বড় অংশ মানবতার প্রশ্নে বাংলাদেশের পক্ষে থাকলেও সরকারের পরিষ্কার ভালোবাসা ছিল পাকিস্তানের জন্য। আর চীনের তো কথাই নেই! অস্ত্র সরবরাহ থেকে শুরু করে সাধ্যমতো সবই করেছিল পূর্ব পাকিস্তান টিকিয়ে রাখতে। তখনো বাংলাদেশের বাম দলগুলো ছিল বিভক্ত, এখনো তাই। তখনো সমাজের এক ধরনের পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের সুবিধার দিকে তাকিয়ে ভালোমন্দ জ্ঞান হারিয়েছিল, এখনো তাই!
কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবীকে চেঁচামেচি করতে দেখছি। সরকারকে সমর্থন করতে হবে সেটা মোটেও না। কিন্তু যে কয়জন লোক ‘মানবিকতায়’ ফেটে পড়ছেন তারা কি সত্যিই অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন, নাকি গুড়ের ভাগ না পেয়ে বঞ্চনায় ফেটে পড়ছেন? এ লোকগুলো তো বাংলাদেশের মানুষের কাছে অপরিচিত নয়। এদের কেউ কেউ পল্টি খেয়েছে, কেউবা আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যও ছিলেন। এরা কোনো রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারেনি। এরা নাকে খত দিয়ে তাদের সারা জীবনের মতাদর্শবিরোধী দলের সঙ্গে যোগ দিয়ে ঢোল বাজাচ্ছেন। তবে একটা বিষয়ে প্রতিটি মানুষের পরিষ্কার হওয়া দরকার। সেখানে ভণিতার কোনো স্থান নেই। আওয়ামী লীগ তথা সরকারের বহু দোষ, বহু দুর্বলতা আছে, অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু সে কারণে যারা রাষ্ট্রের সম্পদ পোড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে—আপনি আমি সেই শক্তিকে সমর্থন করতে পারি না। আপনার ঘরে চোর ঢুকলে কি আপনি ঘর পুড়িয়ে দেবেন? অনেক মানুষের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু হয়েছে সত্য, কিন্তু পাশাপাশি এটাও সত্য যে, এই মৃত্যুর বিনিময়ে গোটা রাষ্ট্রটি রক্ষা করা গেছে। যদি ঠেকানো না যেত, তাহলে বাংলাদেশকে একটি পোড়া মাটিতে পরিণত করত ওই অপশক্তি, যা কোনোক্রমেই সমর্থনযোগ্য নয়।
সর্বশেষ একটি কথা বলে শেষ করি। আমার ধারণায় ছিল প্রধানমন্ত্রী সারাজীবন আসুরিক শক্তি দেখে দেখে দশভুজায় পরিণত হয়েছেন। আমার সে ধারণায় আঘাত লেগেছে। অনেক দিন ধরে তার প্রকাশ্যে চরম বৈরী সম্পর্ক চলছে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটির সঙ্গে, যার হাতে লেগে আছে অসংখ্য বিশ্বনেতার রক্ত, হাতের তালুতে রয়েছে আরব স্প্রিংসহ বহু দেশে জনগণকে ফুসলে দিয়ে জনপ্রিয় নেতাকে হত্যা অথবা গদিচ্যুত করার চিত্ররেখা! এখন তো আর দেশ ১৯৭৫ সালের মতো অতটা অসহায় নেই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে ন্যূনতম সব বীক্ষণ যন্ত্রই আছে। সরকারের শত্রুর অভাব নেই এটা কে না জানে? ওই দেশটি যদি জড়িত নাও থাকে, অন্তত কোনদিক থেকে আঘাত আসতে পারে সেটা বোঝার ক্ষমতা ঢাকার না থাকার কথা নয়। কিছুই বোঝা গেল না? এখন মনে রাখতে হবে, সবকিছু সমাধান হয়ে যায়নি। আঘাতের ধরন পাল্টাতে পারে। তাই প্রস্তুতিতে যেন কোনো দুর্বলতা না থাকে।
লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক