ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংস্কৃত পণ্ডিত, লেখক, শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক, জনহিতৈষী। তিনি ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। পাঁচ বছর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্রকে গ্রামের পাঠশালায় পাঠানো হয়। তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান ছাত্র। অমিত প্রভাধর ঈশ্বরচন্দ্র ১৮৩৯ সালে বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা ভাষার প্রধান পণ্ডিত, সংস্কৃত কলেজের সহকারী সেক্রেটারি ছিলেন। পরবর্তীকালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হেড রাইটার ও কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৮৫০ সালে সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক পদ এবং কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। তিনি কলেজের পাঠ্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আনেন। ব্যাকরণ, বীজগণিত ও গণিত আগে শেখানো হতো সংস্কৃতে; কিন্তু তিনি সংস্কৃতের বদলে ব্যাকরণ বাংলার মাধ্যমে এবং গণিত ইংরেজির মাধ্যমে পড়ানোর নিয়ম চালু করেন। ইংরেজি ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক করেন। বিদ্যাসাগর ছিলেন স্ত্রী শিক্ষার বিশেষ সমর্থক। সরকার সে জন্য এ কাজের দায়িত্ব দেয় তার ওপর। তিনি বালিকা বিদ্যালয় খোলার বিষয়ে স্থানীয় লোকদের সমর্থনে বর্ধমানে একটি স্কুল স্থাপন করেন। পরে ১৮৫৭ সালের নভেম্বর থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাসের মধ্যে আরও ৩৫টি স্কুল স্থাপন করতে সমর্থ হন। সংস্কৃত কলেজের সংস্কার ও আধুনিকীকরণ এবং বাংলা ও বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন ছাড়া, শিক্ষা ক্ষেত্রে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো পাঠ্যপুস্তক রচনা ও প্রকাশ করা। বর্ণপরিচয় প্রকাশের আগপর্যন্ত প্রথম শিক্ষার্থীদের জন্য এ রকমের কোনো আদর্শ পাঠ্যপুস্তক ছিল না। তার বর্ণপরিচয়ের মান এত উন্নত ছিল যে, প্রকাশের পর থেকে অর্ধশতাব্দী পর্যন্ত এই বই বঙ্গদেশের সবার জন্য পাঠ্য ছিল। দেড়শ বছর পরে এখনো এ গ্রন্থ মুদ্রিত হয়। বর্ণপরিচয়ের মতো সমান সাফল্য লাভ করেছিল বোধোদয়, কথামালা, চরিতাবলী এবং জীবনচরিত। সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা ও বর্ণপরিচয়ের মতো অভিনব—এর আগে বাংলা ভাষায় কোনো সংস্কৃত ব্যাকরণ ছিল না। চার খণ্ডে লেখা ব্যাকরণ-কৌমুদীও তার ব্যাকরণ রচনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক অবদান। শুধু পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে নয়; বরং তার অন্যান্য রচনা দিয়েও বাংলা গদ্যের সংস্কার এবং তার মান উন্নত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের শব্দ-সাযুজ্য আবিষ্কার, বাক্য-কাঠামো সংস্কার, কর্তা ও ক্রিয়াপদ এবং ক্রিয়া ও কর্মের মধ্যে যথাযথ অন্বয় স্থাপন করে বাংলা গদ্যকে মাধুর্য দান করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ চালু করা, বহু ও বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ করা এবং স্ত্রী শিক্ষা বিস্তারের জন্য আন্দোলন করেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৮৫৬ সালের জুলাই মাসে বিধবা বিবাহ আইন প্রণীত হয়। বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়নে সাফল্য লাভ করায় পরে কুলীনদের বহু ও বাল্যবিবাহ রোধ আইন পাস করার পক্ষে কাজ করেন। দয়া এবং মানবিকতার জন্য তিনি করুণাসাগর নামে পরিচিতি পান। বিদ্যাসাগর ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই প্রয়াত হন।