বছর দুয়েক ধরেই দেশের সাধারণ মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির যে চাপ সহ্য করে চলেছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট চলমান পরিস্থিতি সেই চাপ আরও বাড়িয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে শঙ্কার। কেননা দীর্ঘ সময় ধরে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যই দরিদ্র শ্রমজীবী ও সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। সুতরাং, এ আশঙ্কা যেন বাস্তব না হয় সেটা অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে ভাবা প্রয়োজন।
রোববার কালবেলায় প্রকাশিত ‘চলমান পরিস্থিতিতে বাড়বে মূল্যস্ফীতি’ শীর্ষক শিরোনামের প্রতিবেদনে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে, শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে সারা দেশে সংঘটিত সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে সরকার ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয়। জারি করা হয় কারফিউ। ফলে সারা দেশের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ভেঙে পড়ে সরবরাহ ব্যবস্থা। দেশের শিল্পসহ বিভিন্ন খাতের উৎপাদন কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়তে শুরু করে। এমন পরিস্থিতিই মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত নতুন মুদ্রানীতিতে বছর শেষে মূল্যস্ফীতির যে সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে, সেই নীতি কাজ করবে না বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। কারণ চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অর্থাৎ সহিংসতা ও অনিশ্চয়তা বৃদ্ধিতে জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হচ্ছে। নতুন করে সৃষ্ট রাজনৈতিক এ সংকট অর্থনৈতিক ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর এ পরিস্থিতিই নতুন মুদ্রানীতি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়।
আমরা জানি সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রায় এক যুগ পর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বার্ষিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। অবশ্য ২০২৪-২৫ অর্থবছর শুরুর মাসে অর্থাৎ জুলাইয়ে তা কিছুটা কমে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ হয়। তবে এ সময় গ্রাম ও শহরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের বেশি। এমন অবস্থার জন্য বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এবারের মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার বৃদ্ধি না করাকে দায়ী করছেন। অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন, বৈশ্বিক ও দেশীয় পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই তারা চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। ফলে চলমান পরিস্থিতি মূল্যস্ফীতিতে খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না। আবার প্রভাব ফেললেও তাতে মুদ্রানীতির কোনো ভূমিকা নেই। পাশাপাশি নীতি সুদহার বাড়ানো হলে দেশের অর্থনীতি আরও চাপে পড়তে পারে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপের কথা আমরা জানি। নানা কারণে তা সম্ভব হয়নি।
কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে সারা দেশে সপ্তাহব্যাপী নাশকতাকারীদের তাণ্ডবের পর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে সবকিছু—এটা যেমন সত্য; একই সঙ্গে এ ধ্বংসযজ্ঞ দেশের অর্থনীতিতে ফেলেছে ব্যাপক বিরূপ প্রভাব। দৃশ্যমান ধ্বংসের ক্ষত যেমন রয়েছে, একই সঙ্গে প্রায় দুই সপ্তাহের অচলাবস্থায় সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ পড়েছে বিপাকে। তার ওপর ক্রয়ক্ষমতার বাইরে থাকা বিরাজমান মূল্যস্ফীতিতে নতুন করে বৃদ্ধির চোখরাঙানি দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্দোলন ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতির পেছনে দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গুর ষড়যন্ত্র ছিল বলে শনিবার খোদ প্রধানমন্ত্রীও উল্লেখ করেছেন। আমাদের প্রত্যাশা, চলমান পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হবে। স্বাভাবিক হবে সরবরাহ ব্যবস্থাসহ সার্বিক অর্থনীতির গতিধারা। পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্টরা প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ গ্রহণ করবেন, যেন নতুন করে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি তো নয়-ই, কমানো সম্ভব হয়।