কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে সারা দেশে সপ্তাহব্যাপী নাশকতাকারীদের তাণ্ডবের পর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে সবকিছু। তবে গত কয়েকদিনে পরিস্থিতির ভয়াবহ রূপ যে জনমনে শঙ্কা ও আতঙ্কের ছাপ রেখে গেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। পাশাপাশি তাণ্ডব-পরবর্তী সময়ে নাশকতাকারীদের ধরতে দেশব্যাপী যে চিরুনি অভিযান চলছে এবং প্রতিদিন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে তাণ্ডবকারী সন্দেহে। প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে এই অভিযান অবশ্যই দরকার। তবে এসব অভিযান সাধারণ মানুষ ও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মনে এক ধরনের ভয় ও অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। সরকার ও প্রশাসনের প্রতি এই ভয় ও শঙ্কা দূর হোক—সেটাই হবে ইতিবাচক। শনিবার কালবেলায় প্রকাশিত ঢাকার জাতিসংঘ তথ্যকেন্দ্রের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ-সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হয়। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, কোটা আন্দোলন কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক আহ্বান জানিয়েছেন, যেসব কারণে সহিংসতা সৃষ্টি হয়েছে, তা বন্ধে আলাপ-আলোচনার সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। জনগণের মনে যে গভীর আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে, তা ফিরিয়ে আনতে হবে। তিনি বাংলাদেশ সরকারের আইন প্রয়োগকারী কার্যক্রম যেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের নিয়ম ও মানদণ্ড মেনে করা হয়—এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে ইন্টারনেট চালু করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। মানবাধিকার লঙ্ঘনের সব অভিযোগ বিষয়ে একটি নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্ত আহ্বানের পাশাপাশি এ বিষয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে প্রস্তুত বলে তিনি জানান।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগসহ নানা নাশকতায় জড়িতদের গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিভিন্ন এলাকায় ব্লক রেইড দিয়ে জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে। কালবেলায় প্রকাশিত শনিবারের প্রতিবেদন বলছে, এসব নাশকতার ঘটনায় শুধু ঢাকা মহানগর এলাকাতেই শুক্রবার পর্যন্ত ২০৯টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২ হাজার ৩৫৭ জনকে। তাদের মধ্যে এদিন ২৪ ঘণ্টায় গ্রেপ্তার করা হয় ১৪৮ জনকে। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় এদিন ২৪ ঘণ্টায় ১৭৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, হামলা, পুলিশ হত্যা, আহত করাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় এখন পর্যন্ত বিএনপি, জামায়াত এবং দল দুটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা গ্রেপ্তার হয়েছেন। গ্রেপ্তারের তালিকায় বিএনপির বেশ কয়েকজন পদধারী নেতাও রয়েছেন। বিভিন্ন নাশকতাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ, ভিডিও ফুটেজ, স্টিল ছবি বিশ্লেষণ এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষণ করে চালানো হচ্ছে গ্রেপ্তার অভিযান। অভিযানে নাশকতায় সরাসরি জড়িত, উসকানিদাতা, পরিকল্পনাকারী ও অর্থদাতাদের আইনের আওতায় নেওয়া হচ্ছে।
আমরা মনে করি, ছাত্রদের অরাজনৈতিক আন্দোলনের সুযোগে যেসব অপরাজনৈতিক ও অশুভ শক্তি দেশব্যাপী তাণ্ডব চালিয়েছে, রক্ত ঝরিয়েছে, শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনতার জীবন কেড়ে নিয়েছে, দেশের সম্পদ ধ্বংস করেছে, তাদের যে কোনো মূল্যে গ্রেপ্তার ও শাস্তির আওতায় আনতে হবে—এ চাওয়া দেশের সবার। তবে মনে রাখা জরুরি, এই গ্রেপ্তার অভিযানে যেন কোনো নির্দোষ-নিরপরাধী ব্যক্তি ভোগান্তি ও হেনস্তার শিকার না হন—সে যেই দল-মতেরই হোক না কেন। এ আন্দোলনে নিহতের পরিবারকে সহযোগিতা, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা ও আহতদের চিকিৎসার ব্যাপারে সরকারের ওপর মহল থেকে বারবার যে আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে, তা অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। আমাদের প্রত্যাশা, সরকার সব রকমের শঙ্কা দূর করতে চলমান পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণভাবে সামাল দেবে।