ফারাজী আজমল হোসেন
প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৩:৩০ এএম
আপডেট : ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৮:৫৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশেও বাড়ছে চীনের দাদাগিরি

বাংলাদেশেও বাড়ছে চীনের দাদাগিরি

নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সবসময়ই মরিয়া চীন। প্রয়োজনে অন্যের দেশে ঢুকে সেখানকার কিছু সরকারি কর্মকর্তাকে হাতে নিয়ে নিজেদের মর্জিমাফিক প্রশাসনও ব্যবহার করতে তারা পারদর্শী। চীনা কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের সালিশি বিচারসভা থেকে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে অপসারণ তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিচারপতি মানিক চীনের চুরি-জোচ্চুরি ধরে ফেলেছিলেন। তাই তার গায়ে ‘চীনবিরোধী’র তকমা লাগিয়ে অপসারিত করতে বাধ্য করা হয়। এ ক্ষেত্রে চীন বিচারপতি মানিকের লেখা ‘চীনের উত্থান: উদ্বিগ্ন প্রতিবেশী’ বইটিকে হাতিয়ার করে। কিন্তু বিচারপতিকে আর্বিট্রাল ট্রাইব্যুনাল থেকে অপসারিত করা হলেও সত্য ধামাচাপা দেওয়া যায়নি। মানুষ বুঝেছেন, চীন আসলেই দাদাগিরি দেখাচ্ছে। বাংলাদেশে তাদের বিভিন্ন প্রকল্পে যেভাবে আমাদের দেশের শ্রমিকরা বঞ্চনা ও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন, তাও লক্ষণীয়। গত বছরই পটুয়াখালীর আরপিসিএল (রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড) তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের শ্রমিকরা বঞ্চনার অভিযোগে গর্জে উঠেছিলেন। একই ছবি দেখা গিয়েছিল পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রেও।

চীন নিয়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির যথার্থই মূল্যায়ন করেছেন। বিচারপতি মানিকের গ্রন্থ উন্মোচন অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘চীন যার বন্ধু তার আর শত্রুর দরকার হয় না।’ তার সাফ কথা, ‘চীন নিজের স্বার্থের বাইরে কাউকে সাহায্য করেনি।’ শাহরিয়ার কবির মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘১৯৭১ সালে চীন আমাদের পাশে ছিল না। তারা পাকিস্তানের পাশে ছিল। অথচ আমেরিকার সরকার আমাদের পাশে তখন না থাকলেও আমেরিকার জনগণ ব্যাপকভাবে আমাদের পাশে ছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনী বন্দুকের যেসব বুলেট ব্যবহার করেছে, সবই ছিল চীনের বুলেট।’ সেই চীন এখন আমাদের বন্ধু সাজতে চাইছে। কিছু স্বার্থপর নেতা ও আমলাও নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে চীনের হয়ে দালালি করতে নেমেছেন।

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘চীনকে নিয়ে আলোচনার কারণ হলো—তারা একটি ভীতি সৃষ্টি করেছে। সেটা হলো চীনের অর্থনৈতিক আগ্রাসী মনোভাব।’ এ আগ্রাসী মনোভাবের বিরুদ্ধেই মুখ খুলেছেন বিচারপতি মানিক। কারণ তিনি মুক্তিযোদ্ধা। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত। তিনি বিশ্বাস করেন, জাতির পিতাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার জন্যও তিনি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে প্রকাশ্যেই দায়ী করেছেন। তাই বিএনপি নেতাকর্মীরা তাকে হেনস্তা করে। বিদেশের মাটিতেও তার ওপর আক্রমণ হয়। বিএনপি-জামায়াতের অপছন্দের মানুষটিকে চীনও পছন্দ করে না। কারণ দেশপ্রেমী মানুষটি চীনের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের গোপন সখ্য কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড বা গ্রেনেড হামলা প্রসঙ্গে বিচারপতি মানিক বলেছেন, ‘১৭ আগস্ট ও ২১ আগস্টের ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ছক ১৯৭৩ সালে আমেরিকায় গিয়ে জিয়া এঁকেছেন। তিনিই এ ছক কষেছিলেন। কেন তিনি আমেরিকায় গিয়েছিলেন, তা বের করার জন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।’ এ বিষয়ে তার প্রশ্ন, ‘কেন তিনি (জিয়া) আমেরিকায় গেলেন? কেন একটি স্যুটকেস আনার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন? জিয়া হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছেন। এ ব্যাপারটিও তদন্তে আনা উচিত। জিয়াকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপের জন্য এই দুটি তদন্ত কমিশন গঠন করা দরকার। জাতির সামনে উনার মুখোশ উন্মোচন করা প্রয়োজন।’

এ কারণেই বিএনপি ক্ষুব্ধ তার ওপর। তাদের সেই ক্ষোভ কাজে লাগাতে চাইছে চীন। চীনের সঙ্গে বিএনপির সখ্য নতুন কিছু নয়। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতে আমাদের স্বাধীনতার স্বীকৃতিটুকুও তারা দেয়নি। জিয়ার আমলেই স্থাপিত হয়েছে বেইজিংয়ের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক।

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেছেন, ‘চীনের একটি অখণ্ড উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করা এবং সেই ঘাঁটি থেকে ভারতের ওপর আক্রমণ বা আধিপত্য বিস্তার করা।’ কিন্তু এতে বাংলাদেশের কোনো লাভ হওয়ার নয়, বরং শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা বলছে, চীননির্ভরতা সর্বনাশ ডেকে আনবে। বিএনপি-জামায়াত সেটাই চাইছে।

বিচারপতি মানিককে ২০২১ সালে গঠিত ট্রাইব্যুনাল থেকে সম্প্রতি অপসারিত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও পরোক্ষভাবে চীনের দাদাগিরি চোখে পড়ে। চীনা সংস্থা জিয়াংসুর বিরুদ্ধে রায় যেতে পারে বলেই তারা প্রশাসনকে প্রভাবিত করতে সচেষ্ট হয়। অপসারিত হন সাবেক বিচারপতি। শুধু এ ক্ষেত্রেই নয়, বিভিন্ন বিষয়ে দেখা গেছে চীন তার আধিপত্যের জাল বিস্তার করে চলেছে। এখনই এটা বন্ধ না করা হলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য ভয়ংকর বিপদ হয়ে উঠতে পারে।

চীনারা আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রকল্পে যুক্ত। অবকাঠামো উন্নয়নে তারা কাজ করছে। কিন্তু দেখা গেছে, চীন থেকে আসা লোকজন সর্বত্রই দাদাগিরি দেখাচ্ছে। আমাদের দেশের শ্রমিকরা তাদের তুলনায় অনেক কম মজুরি পাচ্ছেন। ঈদের বোনাস প্রদানেও বৈষম্য রয়েছে। প্রচুর খাটানো হচ্ছে আমাদের। এমনকি, নামাজ আদায়ের সময়টুকুও অনেক সময় দেওয়া হয় না বলে জানা গেছে। প্রতিবাদ করলে পুলিশ ও প্রশাসনে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে শ্রমিকদের অসন্তোষ প্রতিহত করতেও তারা অভ্যস্ত। চীনের এ ধরনের আচরণ ঘিরে সর্বত্রই ক্ষোভ বাড়ছে।

বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো সর্বত্র চীনা প্রভাব বাড়ছে। ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে দেশের সামাজিক নিরাপত্তাও। এরই মধ্যে চীনা ফাঁদে বহু নারী পাচার হয়ে গেছে বিদেশে। যুবকরাও জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধমূলক কাজকর্মে। চীনাদের যাতায়াত বৃদ্ধির সঙ্গে সমানতালে বাড়ছে অপরাধ। মোটা টাকা বিনিয়োগের লোভ দেখিয়ে গোটা সমাজকে কলুষিত করছে বেইজিং। এখনই লাগাম টেনে ধরতে না পারলে আমাদের আরও অন্ধকার দিন দেখতে হবে।

বর্ডার রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআইয়ের নামে চীন তাদের ঔপনিবেশিক অভিযান চালাচ্ছে বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশও তাদের এ কর্মসূচির অংশীদার। তাই সাবধানতা অবলম্বন জরুরি। চীন প্রসঙ্গে এ কথাটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মানিক। তার লেখা ‘চীনের উত্থান: উদ্বিগ্ন প্রতিবেশী’ বইটিতেও তুলে ধরা হয়েছে কথিত কমিউনিস্ট শাসিত দেশটির আগ্রাসী মনোভাবের কথা। চীনে গণতন্ত্র নেই। তারা গণতান্ত্রিক পরিবেশকেও পছন্দ করে না। তাই বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক দেশকে সাহায্যের কথা বলার পেছনেও রয়েছে চীনাদের গোপন অভিসন্ধি। সেটা বুঝতে পেরেই দেশবাসীকে সতর্ক করতে চেয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মানিক। ধরে ফেলেছিলেন বিদ্যুৎ প্রকল্পের নামে চীনের জালিয়াতি। তাই তাকে হটানো হলো ট্রাইব্যুনাল থেকে। আর তার অপসারণের নেপথ্যে চীনের দালালরাই বেশি সক্রিয় ছিল বলেও অভিযোগ উঠছে। বিচারপতি মানিক শতভাগ বিএনপি-জামায়াতবিরোধী। তার অপসারণের পেছনে কি বিএনপি-জামায়াতেরও হাত রয়েছে? চীনের সঙ্গে তাদের গোপন সখ্যের হাত ধরে প্রশাসনে কি তারেকদেরও প্রভাব বাড়ছে? প্রশ্ন কিন্তু উঠতে শুরু করেছে। সরকারকে সতর্ক হতেই হবে। খুঁজে বের করতেই হবে চীনের দালালদের।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আজকের নামাজের সময়সূচি

শহীদ আমিনুলের সন্তানদের দায়িত্ব নিল ইত্তেফাকুল উলামা

রোববার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

মিছিলে বিএনপি নেতার গুলির প্রতিবাদে বিক্ষোভ

রৌমারীতে ব্যবসায়ীদের আহ্বায়ক কমিটির শপথ অনুষ্ঠিত

৬৫ ভরি স্বর্ণ ছিনিয়ে নেয়ায় মামুনের বিরুদ্ধে যুবদলের মামলা

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ইসলামী আন্দোলনে যোগদান

ক্ষমা পেয়ে আমিরাত থেকে ১২ জন ফিরছেন চট্টগ্রামে

‘ছাত্র জনতার আন্দোলনে হাসিনা সরকার দুই ভাবে পরাজিত’

মহানবীকে (সা.) কটূক্তিকারী সেই যুবকের বিরুদ্ধে মামলা

১০

শিবচর আঞ্চলিক সড়কে গ্রামবাসীর বৃক্ষরোপণ

১১

মাদ্রাসাছাত্রকে বলাৎকার চেষ্টার অভিযোগ ধামাচাপা, ৭ দিন পর ফাঁস

১২

১২ দিনেও মেলেনি রানীনগরে নিখোঁজ নার্গিসের সন্ধান

১৩

দায়িত্বশীলদের নিয়ে সাতক্ষীরায় ছাত্র শিবিরের সমাবেশ

১৪

আযহারী শিক্ষার্থীরা হবে বাংলাদেশ ও মিশরীয় ঐতিহ্যের সেতুবন্ধন : মিশরীয় রাষ্ট্রদূত

১৫

রাজশাহীতে বস্তাভর্তি দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার

১৬

আন্দোলনের ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ছাত্রলীগ কর্মীকে গণধোলাই

১৭

আশুলিয়ায় গার্মেন্টস শ্রমিক অসন্তোষ ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে শ্রমিক সমাবেশ

১৮

কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি

১৯

পাকিস্তানের জলসীমায় বিপুল তেল-গ্যাস মজুতের সন্ধান

২০
X