অজয় দাশগুপ্ত
প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৩:৩০ এএম
আপডেট : ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৮:৫৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ভালো থাকুক বাংলাদেশ

ভালো থাকুক বাংলাদেশ

আমি তখন বারো বছরের বালক। চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার মোড়ে দাঁড়িয়ে। ভোরের সূর্য তখন গনগনে হয়ে উঠছে। এখনকার চট্টগ্রাম আর তখনকার চট্টগ্রামে দুস্তর ব্যবধান। আন্দরকিল্লা তখন শহরের প্রাণকেন্দ্র। একপাশে জামে মসজিদ। আরেক পাশে নবাব সিরাজদৌল্লার নামে সড়ক। সে সড়কের ও-প্রান্ত থেকে ঘন ঘন মিছিল আসছিল। ছাত্র-যুবক-তরুণ-তরুণীদের সে মিছিলে সবাই উচ্চকিত স্লোগান আর বজ্রনিনাদে ধ্বনি তুলছিল—জয় বাংলা। বাংলার জয় তখনো অনিশ্চিত।

আমি বলছি একাত্তরের কথা। সেই যে জয় বাংলা ধ্বনি আমাদের কানে অমৃত ঢেলে দিয়েছিল, তার প্রমাণ মিলল ৯ মাস পর। তখন সারা দেশে জয় বাংলা পরিণত হয়েছিল জয়ধ্বনিতে। একসময় সাহস আর শক্তির প্রতীক হয়ে উঠল এ স্লোগান। আজ ৫৩ বছর পর বহুল ব্যবহারে দীর্ণ স্বার্থপরতায় ক্লান্ত সুবিধাবাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হতে হতে এটি তার মর্যাদা হারিয়ে ফেলেছে প্রায়। হয়তো সে কারণেই তরুণ প্রজন্মে এখন আর তা পুলক জাগায় না।

কী আশ্চর্য! যে স্লোগান বা ধ্বনি আমরা গালাগালি অর্থে ব্যবহার করতাম, ঘৃণা সহকারে উচ্চারিত হতো; সে রাজাকার ফিরে এসেছে। রাজাকার শব্দটি যারা রাজাকার, তারাও বলতে কুণ্ঠিত ছিল। মনে রাখতে হবে ইতিহাস লেখেন বিজয়ীরা। যে কোনো যুদ্ধেই দুটি দল থাকে। শ্রীকৃষ্ণ না থাকলে আর মহাভারতের যুদ্ধে কৌরবেরা জয়ী হলে পাণ্ডব বা অর্জুন কি বীর বলে গণ্য হতেন? বিশ্বযুদ্ধে যদি হিটলার জিতে যেতেন, আমরা কি আজকের ইতিহাসকে ইতিহাস বলে জানতাম? তখন আমাদের মনে হতো হিটলারই ছিলেন সর্বজনমান্য এক বীর। তেমনি একাত্তর সালে বাঙালিরা হেরে গেলে, পাকিস্তানিরা জয়ী হলে ইতিহাসে আমরা হতাম গাদ্দার। আমরা জিতেছি আর স্বাধীন হয়েছি বলেই মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিযুদ্ধ সম্মান পেয়েছে।

এই সম্মানের ধারাবাহিকতা শুধু একটি দল বা সরকারের কাজ হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। যে যুদ্ধে বাংলাদেশের সব মানুষেরই ভূমিকা ছিল। আমরা আমজনতার দলে। আমার বাবা ছিলেন সাধারণ একজন ব্যাংকার। পাঁচ সন্তান ফেলে রেখে যুদ্ধে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না তার। কিন্তু যে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট আর যন্ত্রণা সহ্য করে আমরা সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিলাম, তা কোনো যুদ্ধের চেয়ে কম কিছু নয়। শুধু কি তাই? সে সময় আমাদের কম করে হলেও একাধিকবার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানোর মতো পরিবেশে পড়তে হয়েছিল। দেশের ভেতরে বাইরে এমন অজস্র মুক্তিযোদ্ধা বা পীড়িতদের আমরা ধীরে ধীরে আউট করে দিয়েছি। এর জন্য দায়ী সমাজের নিয়ন্ত্রকরা। তারা কোটা আর অকোটার ভেতর দিয়ে এমন এক পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে, যেখানে আজ ভাই ভাইয়ের দুশমন।

মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধা আমাদের গর্ব। যোদ্ধারা শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের লড়াই তাদের অবদানের তুলনা হয় না। তারা দেশ এনে না দিলে কী হতো সবাই জানেন। কিন্তু ৫০ বছর পর যখন তরুণ-তরুণীরা রাজাকার বলে মাঠে নামে বা তাদের রাগ-অভিমান এভাবে তাদের মাঠে নামায়, আমরা কি বলব না যে এ আমাদের ভুল? আমাদের পাপের কারণে আজ এই দশা? বাংলাদেশ একসময় প্রগতিশীলদের হাতের বাইরে চলে গিয়েছিল। যৌবনে আমরা মনে করতাম বিরোধী দল হয়েই দিন কাটাবে আওয়ামী লীগ। শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আর মুক্তিযুদ্ধের কারণেই মানুষ তাদের প্রতি মনোযোগী হতো। জামায়াত-শিবিরের সর্বত্রগামী কানেকশন আর বিএনপির দাপটের পরও এ দুই কারণে আবারও আওয়ামী লীগ দেশ শাসনে ফিরে আসে। এ শাসন যে ২০০৮ থেকে এত দীর্ঘ হবে, সেটা হয়তো দলও ভাবেনি। এর নাম হওয়া উচিত ছিল দেশ শাসনের সুবর্ণ সুযোগ। সে সুযোগ যে পুরোপুরি ব্যর্থ তা বলব না। কিন্তু তা আদর্শিকভাবে সার্থকও হয়নি।

উন্নয়ন হয়েছে। রাস্তাঘাট, উড়ালপুল, পাতাল, মেট্রোরেল বহু শানদার উন্নয়ন আমরা দেখেছি। একটি আধুনিক রাষ্ট্র বা দেশের অবকাঠামো হয়তো আমরা পেয়েছিও। কিন্তু মনোজগৎ বা যুবমানস বলে যে বিষয়, তা নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। আমি বহুবার এ কথা লিখেছি ও বলেছি, পাশের বঙ্গে কমিউনিস্টরা ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজত্ব করতেন। তারা আমাদের এসব নেতা-উপনেতার চেয়ে হাজারগুণ মেধাবী আর নিষ্ঠাবান ছিলেন। সেসব মেধাবীও জনগণের ভোটের চাপে শাসন ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। আজ এমন হাল তাদের দুরবিন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না। শাসন যত দীর্ঘ হয়, মানুষ ততই হাঁপিয়ে ওঠে। তাদের ক্লান্তি আর হতাশা ততই বাড়তে ধাকে। এজন্য তাদের কথা শুনতে হয়, তাদের মনের ভাষা বুঝতে হয়। আর একটা সমস্যা হচ্ছে, সবকিছু এককেন্দ্রিক করে ফেলা। বাংলাদেশে এ দুই সমস্যা প্রকট। প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত কোথাও কোনো সমাধান মেলে না। এখন তিনিও একজন মানুষ। সবসময় সঠিক কথা বা সমাধান দিতে পারা সম্ভব নাও হতে পারে। সে কারণেই একটি কথার রেশ ধরে আজ দেশ জ্বলছে। প্রাণ হারিয়েছে আমাদের কোমলমতি সন্তানরা।

দেশ-বিদেশে এ ঘটনা যে কুপ্রভাব ফেলেছে, তা সহজে নিরাময় হওয়ার মতো নয়। আরেকটা বিষয় পরিষ্কার, পদ-পদক আর অর্থপ্রত্যাশী স্তাবকরা খারাপ সময় পাশে থাকে না। সেটা আমরা ’৭৫ থেকে আজ পর্যন্ত বারবার দেখে আসছি। তবু তারাই ঘিরে থাকে। এবারের দুর্যোগে তাদের কেউ দাঁড়ায়নি। যারা মার খেয়েছে তারা সাধারণ। আর যারা কোটা আন্দোলনের জন্য মারা গেছে, তারা আরও সাধারণ। তাদের ভেতর কে ঢুকে আছে, কে ঢোকেনি—এসব বলে পার পাওয়া যাবে না। ঘটনা বলে দিয়েছে, বলে দিচ্ছে, কাচের স্বর্গে বসবাস করে কেউ নিরাপদ থাকে না। আর সম্মান ও ইজ্জত ভেঙে পড়তে সময় লাগে না। এজন্যই সুশাসনের বিকল্প নেই। দুর্নীতি বন্ধের বিকল্প নেই।

আমরা যারা প্রবীণ বা প্রবীণ হওয়ার পথে, আমাদের মনে একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। কার কাছে আমরা বিচার চাইব? যে দেশে বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা ছিলেন, যে সমাজে হাজারো জ্ঞানী-গুণী বিবেকবান বাঙালি আছেন, সে দেশে এমন ক্রাইসিস হয় কী করে? কী করে অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি হয়? বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে দোষারোপ করার আগে এগুলোর জবাব পাওয়া জরুরি। শুরুতেই লিখেছি, অন্ধকার একদিনে ঘনীভূত হয়নি। সে অন্ধকারকে যারা লালন করেছিলেন, আজ তারাই ভুগবেন। তা ছাড়া কোনো চাওয়া-পাওয়া না মিললে সেটা নিয়ে কথা বলা মানেই কি দেশদ্রোহিতা? এসব প্রশ্ন আর উত্তরের ভেতরেই ভবিষ্যতের শান্তি লুকিয়ে। বাংলাদেশ তুমি ভালো থেকো। থাকো রক্তপাতহীন শান্তিতে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও ছড়াকার, সিডনিপ্রবাসী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাজশাহীতে গণপিটুনিতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নিহত 

কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

দেশে ফিরলেন আমিরাতে ক্ষমা পাওয়া ১৪ বাংলাদেশি

আজকের নামাজের সময়সূচি

শহীদ আমিনুলের সন্তানদের দায়িত্ব নিল ইত্তেফাকুল উলামা

রোববার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

মিছিলে বিএনপি নেতার গুলির প্রতিবাদে বিক্ষোভ

রৌমারীতে ব্যবসায়ীদের আহ্বায়ক কমিটির শপথ অনুষ্ঠিত

৬৫ ভরি স্বর্ণ ছিনিয়ে নেয়ায় মামুনের বিরুদ্ধে যুবদলের মামলা

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ইসলামী আন্দোলনে যোগদান

১০

ক্ষমা পেয়ে আমিরাত থেকে ১২ জন ফিরছেন চট্টগ্রামে

১১

‘ছাত্র জনতার আন্দোলনে হাসিনা সরকার দুই ভাবে পরাজিত’

১২

মহানবীকে (সা.) কটূক্তিকারী সেই যুবকের বিরুদ্ধে মামলা

১৩

শিবচর আঞ্চলিক সড়কে গ্রামবাসীর বৃক্ষরোপণ

১৪

মাদ্রাসাছাত্রকে বলাৎকার চেষ্টার অভিযোগ ধামাচাপা, ৭ দিন পর ফাঁস

১৫

১২ দিনেও মেলেনি রানীনগরে নিখোঁজ নার্গিসের সন্ধান

১৬

দায়িত্বশীলদের নিয়ে সাতক্ষীরায় ছাত্র শিবিরের সমাবেশ

১৭

আযহারী শিক্ষার্থীরা হবে বাংলাদেশ ও মিশরীয় ঐতিহ্যের সেতুবন্ধন : মিশরীয় রাষ্ট্রদূত

১৮

রাজশাহীতে বস্তাভর্তি দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার

১৯

আন্দোলনের ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ছাত্রলীগ কর্মীকে গণধোলাই

২০
X