পকেটে হাত রেখে ঘুমিয়ে থাকলে চলবে না। ওরা সুযোগ বুঝে ঘরে ঢুকে মেরে ফেলবে। আমাদের যা করার তা করতে পারিনি—মন্তব্যটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের। বৃহস্পতিবার রংপুর শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ মন্তব্য তাদের। শুধু রংপুরের আওয়ামী লীগ, জনপ্রতিনিধি বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই তার এ বক্তব্যের উদ্দেশ্য? এ প্রশ্নের মধ্যেই রাজধানী কয়েক এলাকায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অ্যাকশন। কোটা আন্দোলনের সময় সহিংসতার বিরুদ্ধে মাঠে না নামায় ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের মোহাম্মদপুর, আদাবর ও শেরেবাংলা নগর থানার ২৭টি ইউনিটের কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এমন গাফিলতি বা মাঠে না নামার আমলনামা শুধু মোহাম্মদপুর, আদাবর ও শেরেবাংলা নগর থানার ২৭টি ইউনিটের?
এ ধাঁচের আরও অনেক প্রশ্ন আছে। কোটাওয়ালাদের দমাতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট বলে ঘোষণারইবা কী হলো? কেন, কার বা কাদের হম্বিতম্বি-বেটাগিরি ও মুখপণ্ডিতির আগুনে পরিস্থিতি তেলেবেগুনে এতটা ভয়াবহ ও রক্তাক্ত হলো? এসব প্রশ্ন নিয়ে কথা চালাচালির মধ্যে একসঙ্গে এত রক্ত ঝরার বিষয়টি উহ্যই থাকছে। স্বাধীনতার পর এ দেশে একসঙ্গে এত রক্ত ঝরেনি আর কখনো। মাটিতে রক্তের দাগ রেখে কতজন চিরবিদায় নিয়েছেন, সেই বিষয়ে মাতবোলের চেয়ে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিকে বেশি সাবজেক্ট করে ফেলা হচ্ছে। সরকারি ভাষ্যের সঙ্গে এ হত্যাকাণ্ডের কোনো মিল নেই, বড় রকমের বৈপরীত্য আছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো কোনো আন্দোলনে মাত্র পাঁচ-ছয় দিনে এত সংখ্যক মানুষ হত্যা হয়নি। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ৯ বছরেও দিন কয়েকে একসঙ্গে এত মানুষ হতাহত হয়নি। ২০১৩-১৪ সালের নির্বাচন প্রতিহতের আন্দোলনে হতাহতের নির্ভরযোগ্য তথ্যও এখনো অজানা। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ব্যাপক প্রাণহানি, সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞের কিছু অংশের তদন্তে নেমেছে বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের বিচার বিভাগীয় কমিশন। কিছু অংশ বলতে ১৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতায় ছয়জন নিহত এবং ৫ থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত সংঘটিত সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।
এ সংক্রান্ত তথ্যাদি প্রমাণসহ ৬ আগস্টের মধ্যে সরাসরি বা ডাকযোগে বা ইমেইলে কমিশনের কাছে পাঠানো যাবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ঢাকার বাইরের ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাওয়ার কথাও জানানো হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখছে না, পুরো ঘটনা না হলেও অনেক কাজ এ কমিশনের। কিন্তু, নানান কথার মচ্ছব এবং প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক মহলকে দোষী সাব্যস্তকরণের মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির কাজ করে ফেলছে সরকারপক্ষ। সরকার ও সরকারি দলের শীর্ষ পর্যায়, পুলিশ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের স্পর্শকাতর জায়গা থেকেও জোর গলায় বলা হচ্ছে, সহিংসতার যত কাণ্ড জামায়াত-শিবিরই করেছে। সহায়তা করেছে বিএনপি। আর যাবতীয় হুকুম বা নেতৃত্ব এসেছে লন্ডন অবস্থানরত বিএনপি নেতা তারেক রহমানের কাছ থেকে। দোষ ঘটনা এভাবে সাব্যস্তের মধ্য দিয়ে তদন্ত কমিটির জন্য তেমন কাজ রাখা হচ্ছে না। তদন্ত কমিটিরইবা এর বাইরে যাওয়া কতটা সম্ভব হবে—পথেঘাটে উচ্চারিত ও আলোচিত এসব প্রশ্ন। বিএনপি এ আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছে। সরকার তা মেনে নিয়েছে। আদালতের নির্দেশনাও আন্দোলনকারীদের পক্ষে। মানে কোটার বিষয়ে ক্ষমতাসীন-ক্ষমতাহীন-দলবেদল সবার মনমর্জি একই। কোনো বিষয়ে আন্দোলনকারী, সরকার, বিরোধী দল, এমনকি আদালত একমত হওয়ার এমন ঘটনা বাংলাদেশের জন্য একদম নতুন। সেখানে সমর্থনকারী একটি দলকে দোষী সাব্যস্ত করাও নজিরবিহীন। দোষী সাব্যস্ত করে এরই মধ্যে বিচারও শুরু হয়ে গেছে। বিএনপি নেতাদের সমানে ধরপাকড় করে বিচারের প্রাথমিক কাজ দ্রুতগতিতে চলছে। জামায়াত নেতাকর্মীদেরও মোটামুটি সাফা করে ফেলা হচ্ছে।
আন্দোলনে সমর্থন দেওয়া আর নাশকতাকে এক করে দিয়ে এখন হরদম চলছে মালের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব জানান দেওয়া। জানের চেয়ে মালের গুরুত্ব বেশি করে ফেলা হচ্ছে। হতাহতের স্বজন ও পরিবারগুলোর মধ্যে তা কোন মাত্রার ঘৃণা ও ক্রোধ বাড়াচ্ছে জানেন শুধু ভুক্তভোগীরাই। এসবের মধ্য দিয়ে নতুন করে আরও জটিলতা পাকছে। আসছে পুরোনো তিক্ত কথা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল এরই মধ্যে পাল্টা অভিযোগসহ পুরোনো কিছু তিতা কথা টেনেও এনেছেন। বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারই নাশকতার মদদ দিয়েছে। এ ধরনের নাশকতা হোক, সমস্যা তৈরি হোক—এটা তারাই চেয়েছে। এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে প্রকাশিত চট্টগ্রামের আদালতে এক ব্যক্তির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে স্থানীয় শ্রমিক লীগ নেতার নির্দেশে বাসে আগুন দেওয়ার কথাও টেনে এনেছেন তিনি। সরকার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিষয়টি বাদ দিয়ে শুধু সরকারি স্থাপনায় হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা সামনে এনে বিএনপির ওপর দোষ চাপাতে চায় বলেও মূল্যায়ন তার।
এবারের আন্দোলনটি কোটা নিয়ে সূত্রপাত হলেও তা আর কোটাতে ছিল না, তা সামান্য বুঝজ্ঞানসম্পন্ন মানুষও বুঝেছে। জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও ঘটেছে। পুলিশসহ সিভিল প্রশাসনের অ্যাকশন ব্যর্থ হওয়ার পর সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। এক অর্থে এটি দমন করতে পারা বা থামিয়ে দেওয়া। নিয়ন্ত্রণ নয়, সমাধানও নয়। কোটা আন্দোলন থামাতে গিয়ে সারা দেশে কারফিউ, টানা কয়েক দিন সাধারণ ছুটি, ইন্টারনেট বন্ধ থেকেছে। এর পূর্বাপরে চলেছে প্রাণহানিসহ ধ্বংসলীলা। তা ব্যক্তি ও বেসরকারি পর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন খাত থেকে আসছে ক্ষতির ভয়ংকর তথ্যচিত্র। গার্মেন্টস, বিমান, সিরামিক, সিমেন্ট থেকে মাছ-মাংস খাতের ক্ষতির হিসাবও বাদ পড়ছে না। মানুষের প্রাণহানির তথ্য অনেকটা অপ্রয়োজন-অপ্রসঙ্গই থাকছে। প্রতিপক্ষকে দমাতে ‘ছাত্রদলই যথেষ্ট’ মার্কা কথা ও সেই কথার জের বিএনপিকে ভুগতে হয়েছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার কাফফারা তো এখনো টানতে হচ্ছে বিএনপিকে।
এবারের ছাত্র নির্যাতন, হত্যার জের হয়তো কাউকে না কাউকে একদিন বা দীর্ঘদিন সইতে হতেও পারে। এখন কিছু কমিটি-উপকমিটি ভেঙে বা হাত পকেটে নিয়ে না ঘুমানোর সবক দিয়ে দলীয় কিছু লোককে নতুন উদ্যমে তেজি করা যেতেও পারে। অবশ্যই ধার-ভার দেখাবে নতুন পদপদবি হাসিল করা নেতাকর্মীরা। বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধীপক্ষকে ছ্যাঁচা মার মেরে হিম্মতের জানান দেবে। তাতে কি ফয়সালা আসবে? এরই মধ্যে সন্ত্রাসীরা ওত পেতে আছে, ঘাপটি মেরে আছে মন্তব্য করে সামনের দিনগুলোতে আবারও মার খাওয়ার শঙ্কা জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রতাপশালী মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষা-উচ্চারণ ভিন্ন। দলের নেতাকর্মীদের জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। নাজেহাল হওয়া ছাত্রলীগ সভাপতি বলেছেন, কড়ায়-গণ্ডায় শোধ-উসুলের কথা। মার খেয়ে মাঠছাড়া হওয়া নেতাকর্মীদের মনোবল ফেরাতে বা আবার মাঠমুখী করতে রাজনীতিতে এটিই হয়। তা কখনো কাজে দেয়। কখনো বুমেরাংও হয়।
ক্ষমতাসীন দলে তেল-ফুয়েল বেশি থাকে বলে নতুন উদ্যম আনা একটু সহজ। তারও একটা মাত্রা আছে। এবার যে রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরি হয়েছে, তা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় কত সময় লাগবে তা সময়ই বলবে। বিশেষ করে নিজ দলের না হলেই দিবারাত্রি যাকে-তাকে রাজাকার-স্বাধীনতাবিরোধী তকমা দেওয়ার মার্কেটিং যে ধাক্কা খেয়েছে, তা একটু বেশি ভাবতে হবে ক্ষমতাসীনদের। একটি অরাজনৈতিক-অহিংস শান্তিপূর্ণ আন্দোলন রাজনৈতিক ও সহিংস করায় কার কী ভূমিকা তা আরও বিশ্লেষণ দরকার। এর জেরে এখন চলমান ঢালাও মামলা ও গ্রেপ্তারেরও একটা জের থাকতে পারে। কোটার আন্দোলনকে খোঁচায় নিয়ে প্রাণহানিসহ অসংখ্য হতাহত, এর সুযোগে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ধ্বংসযজ্ঞের ভয়াবহতার সাক্ষী করার পরিণাম কে কীভাবে ভুগবে এখনই বলা যাচ্ছে না। এগুলো মেরামত বা সংস্কারে বাজেট-খরচ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, পিডি মহোদয়দের ক্রিয়াকর্ম শুরু হলে দেখা যাবে বাকিটা। কে কীভাবে কার হিসাব মেলাবেন তারাই জানেন। টাকার অঙ্কের বাইরে বাংলাদেশের ইমেজের যে সর্বনাশ হয়ে গেল, সেটা উদ্ধার কি টাকা দিয়ে হবে?
সহিংসতার অভিযোগে যেভাবে ঢালাও মামলা ও গ্রেপ্তার চলছে, তা কতটা আইনি প্রক্রিয়া মেনে করা হচ্ছে, তা প্রশ্নবিদ্ধ আছে। এত এত উন্নয়ন, স্মার্টনেস, এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখানোর মধ্যেও মানুষ কেন এত ক্ষুব্ধ হলো, সেটা বেশি বেশি বিবেচনা ও আমলে নিতে হবে সরকারকেই। কোটার আন্দোলন কেন কোটায় থাকল না, তা বুঝতে মস্ত বিদ্যান বা রাজনৈতিক বিশ্লেষক হওয়া লাগে না। মূল্যস্ফীতি, দুর্নীতি, গরিবে-ধনীতে বৈষম্য থেকে শুরু করে ভোটকে বেদরকারি করে ফেলাসহ দিনের পর দিন পুঞ্জীভূত ক্ষোভের একটা বার্তা পাওয়া কি কানে কানে বলা লাগে? আওয়ামী লীগের মতো প্রাচীন ও জনগণের মধ্য থেকে উঠে আসা দলকে তা বুঝতে কি এক্সপার্ট হায়ার করা লাগে? বাষট্টি, ঊনসত্তর, একাত্তর, নব্বইয়ের অভ্যুত্থানের ইনস অ্যান্ড আউট তাদের চেয়ে কে বেশি জানে? এরকম একটা কঠিন সময়ে কোটা সংস্কারের মতো নির্দোষ আন্দোলন দমাতে ছাত্রলীগ নামানো, আন্দোলনকারী ছাত্রসহ দেশের একটা বিশাল অংশকে রাজাকার বানিয়ে ফেলার মতো মোটা কাজের জের পুলিশ-র্যাব কেন সামলাতে পারল না, ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ কেন বেদম মার খেয়ে মাঠ ছাড়ল, সেনাবাহিনী নামিয়ে পরিস্থিতি আয়ত্তে নিতে হলো—এ কয়েকটি প্রশ্নে গায়ে ফোসকা অনুভব না করে মগজে নিলে এখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলতে হয় না—‘পকেটে হাত রেখে ঘুমিয়ে থাকলে চলবে না।’ ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদককে আবার মার খাওয়ার শঙ্কা জানিয়ে কর্মীদের চাঙ্গা করার উদ্দেশ্যে বলতে হয় না, ‘ওরা ঘাপটি মেরে আছে, আবার অঘটন ঘটাতে পারে।’ অথবা দলের মোহাম্মদপুর, আদাবর ও শেরেবাংলা নগরের ২৭টি ইউনিটের কমিটি ভেঙে ঝিকে মেরে মাকে শিক্ষা দেওয়া লাগে না।
টানা তিন-চার দিন দেশের কোথাও কোথাও যে ‘লীগমুক্ত’ হয়েছে, সেটা শুধু ছাত্রলীগ বা কারও একার দোষে নয়। দলের এবং বাইরের সমালোচকদের কারও কারও মধ্যে যত দোষ ছাত্রলীগকে দেওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। ছাত্রলীগকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে হলকে ‘ছাত্রলীগমুক্ত’ ঘোষণা দেওয়ার মতো ঘটনা কবে, কখনো হয়েছে? ছাত্রলীগ কি কোনো রোগ-বিমারি? পোলিওমুক্ত-করোনামুক্ত টাইপের কথায় ‘ছাত্রলীগমুক্ত’ বলে সম্বোধন করা? সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর গেস্টরুমের অত্যাচার, সিট বণ্টনের নৈরাজ্য, ছাত্রলীগের মিছিলে-মিটিংয়ে যাওয়ার জন্য চাপ, না গেলে নানা ধরনের অত্যাচারের একটা জের যে কখনো না কখনো পড়তে পারে, তা কখনো ভাবনায় নিয়েছেন মুরুব্বি সংগঠনের নেতারা? বিশেষ করে ছাত্র বা ছাত্রলীগের সিঁড়ি বেয়ে যাদের আজকের এ অবস্থান। ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন লীগকে থামিয়েছিলেন তারা? নিজেরাও কতটা সামলে চলেছেন?
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন