ইলিয়াস হোসেন
প্রকাশ : ২৩ জুলাই ২০২৪, ১১:৩২ পিএম
আপডেট : ২৪ জুলাই ২০২৪, ১১:৫৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

অন্তর্জালের অন্তর্জ্বালা

অন্তর্জালের অন্তর্জ্বালা

মাঝবয়সী মোশতাক আহমেদ খান পেশায় ঠিকাদার। সারা দিন রড-সিমেন্ট-বালু আর শ্রমিক নিয়ে কারবার। মোবাইলে ফুলচার্জ থাকার পরও পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে সকাল সকাল সাইটে চলে যান। শ্রমিকদের নির্দেশনা দেওয়া আর স্থানীয়দের নানা বিশেষজ্ঞ পরামর্শ শোনার ফাঁকে ফাঁকে ফেসবুক চালান। শুধু কি ফেসবুক! পাশাপাশি ইউটিউব, টিকটকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢু মারেন। কোনো কোনো সময় রীতিমতো ঢুকে থাকেন। কাজের সময়ই এ অবস্থা। আর কাজ না থাকলে তো কথাই নেই।

সকাল শুরু করেন ইউটিউবে কোরআন তেলাওয়াত শোনার মাধ্যমে। রাতে সামনে টিভি খোলা থাকলেও, চোখ লেগে থাকে মোবাইল বা পিসির স্ক্রিনে। বিছানায় যাওয়ার সময় হেডফোন লাগিয়ে রাজনৈতিক টক শো চালিয়ে দেন। উত্তপ্ত আলোচনা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। এ নিয়ে পরিবারের কেউ আর অহেতুক কৌতুক করেন না। কিছু বললেই নানা অজুহাত দেখান মোশতাক সাহেব। মোবাইলে লেনদেন, টেন্ডার, দেশের খবর, উদ্যোক্তা সংবাদ, নির্মাণসামগ্রীর খোঁজ-খবরে ভীষণ ব্যস্ত তিনি। বিশেষ করে অনলাইনে আনা খাবার এবং উপহার পেয়ে পরিবারের আর বলার কিছু থাকে না।

সেই ঠিকাদার সাহেব কয়েক দিন ধরে অন্তর্জালের (ইন্টারনেট) অভাবে অন্তর্জ্বালায় ভুগছেন। নেট নেই জেনেও নিজের স্মার্টফোনের স্ক্রিনে আঙুল চালাচ্ছেন। টাইমলাইনে ঝুলে থাকা শেষমুহূর্তের ছবি বারবার দেখছেন। স্ক্রিনে থাকা বিভিন্ন অ্যাপস অযথাই ওপেনের চেষ্টা করছেন। ঘন ঘন আঙুল ফোটানোর বদভ্যাস বেড়ে গেছে। কখনো ঘাড়ের নিচে হাত দিয়ে ছাদের দিকে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকেন। কখনোবা উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশ দিয়ে মাথা ঢেকে রাখছেন। দিন দিন তার আচরণ মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের মতো হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন পরিবারের সদস্যরা।

ডাক্তার আক্তারি বেগম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক তৎপর থাকেন। এতে করে কেউ কেউ তাকে অসামাজিক বলে ভুল করেন। বিভিন্ন দাতব্য উদ্যোগ ও নানা উৎসবের আয়োজন করেন তার ফেসবুক পেজ থেকে। নিজের ইউটিউব চ্যানেলে নিজেকে নানা ঢংয়ে উপস্থাপন করে রীতিমতো সেলিব্রেটি বনে গেছেন। ফেসবুকে রোগীদের পরামর্শ দেন তিনি। হোয়াটসঅ্যাপে টেস্টের রিপোর্ট দেখে প্রেসক্রিপশনও পাঠান। করোনাকালে তো অনলাইনে রোগী দেখে প্রচুর আয় এবং মানবসেবা করেছেন ডাক্তার আক্তারি। এ ছাড়া, ইউটিউব দেখে বাহারি রান্নার রেসিপি রপ্ত করেছেন। রসনাবিলাসে তৃপ্ত পরিবারের সদস্যরা তার কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কখনোই তাদের কৃতজ্ঞ জিহ্বা ব্যবহার করেন না।

জনপ্রিয় আক্তারি বেগম এখন পাগলপ্রায়। কয়েক দিন ধরে ইন্টারনেট না থাকায় কোনো কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছেন না তিনি। স্বামী-সন্তানরা তাকে নানাভাবে সঙ্গ দিচ্ছেন। কখনো লুডু-ক্যারম বা রান্নায় ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এতেও বিপত্তি। রান্নার জিনিসপত্র দ্রুত কমে যাচ্ছে। কয়েকটি আইটেম একেবারেই শেষ। কারফিউ শীতল হলেও পণ্যের দামে বেশ উত্তাপ। জোগানও কম। হাতে নগদ টাকা তেমন একটা নেই। ইন্টারনেট জটিলতায় ক্রেডিট কার্ড কাজ করছে না। বুথ থেকে টাকা তোলা যাচ্ছে না। এদিকে, ফ্ল্যাটের টিভিটা স্মার্ট। নেট না থাকায় সেটি চলে না। আক্তারি এক রুম থেকে আরেক রুমে হাঁটাহাঁটি করেন। মাঝেমধ্যেই ফোনটা হাতে নেন। আর মনটা বিষিয়ে ওঠে। ওহ! শিট!! বলে চিৎকার করে ওঠেন। মাঝেমধ্যে নিজের বয়কাট চুল টেনে লম্বা করেন। এসব দেখে পরিবারের সবাই বাইরের পরিস্থিতির মতো ঘরেও আতঙ্কে দিন-রাত কাটাচ্ছে। যুদ্ধ করে বিদ্যুৎ বিলটা দিতে পারায় কিছুটা স্বস্তি।

তবে পাশের বস্তির কলেজপড়ুয়া নাহিদের হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার বিষণ্ন করে তুলছে পরিবেশ। লেখাপড়ার পাশাপাশি সে একজন টিকটকার। করোনাকালে অনলাইন ক্লাসের প্রয়োজনে দরিদ্র পিতা-মাতা বাধ্য হন তার হাতে স্মার্টফোন তুলে দিতে। একসময় এই ফোন তার আয়ের অন্যতম উৎস হয়ে ওঠে। নানা ধরনের কনন্টেট তাকে এনে দেয় ডলার। প্রথম প্রথম পরিবার কিছুটা বিরক্ত হলেও ডলার ভাঙা টাকা দেখে খুশি হয় তারা। মেধাবী বলে প্রতিবেশীদের কাছেও প্রিয় হয়ে ওঠে এ উঠতি যুবক। যেখানেই ঘটনা-দুর্ঘটনা, সেখানেই ছুটে যায় নাহিদ। বন্ধুদের মামুলি আড্ডাও কনটেন্ট বানিয়ে নেটে ছেড়ে অর্থকরী করে তোলে সে। এরকম উদ্যমী তরুণের চোখে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন হয়ে ওঠে এক প্রিয় প্ল্যাটফর্ম। আন্দোলনে অংশ নিয়ে লাইভ দেয় এবং একাধিক কনটেন্ট বানায় সে। প্রথম প্রথম বেশ মজা পায় এবং ভালো আয় করে নাহিদ। একপর্যায়ে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার মধ্যে পড়ে পা ভেঙে যায় তার। শরীরের বিভিন্ন অংশে জখম নিয়ে হাসপাতালে যায়। শত শত রোগীর মধ্যে কোনোরকম চিকিৎসা পায়। এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় ইন্টারনেট। অনেক কনটেন্ট এখনো আপলোড বাকি। এদিকে শরীর এবং পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। ধারণা করছে, প্লাস্টার ঠিকমতো করা হয়নি। হাড় বোধহয় যথাযথ জায়গায় বসেনি। বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে সে। পায়ের ব্যথার চেয়ে মাঝেমধ্যে নেট না থাকায় কষ্ট পাচ্ছে। এরকম সময় নেটের খুব দরকার ছিল তার। বিরক্ত হয়ে একেক সময় মোবাইল দিয়ে শক্ত প্লাস্টারে আঘাত করে আর চিৎকার দিয়ে ওঠে।

সুমাইয়া সোমা খুবই উৎসাহী অনলাইন রিপোর্টার। একেক দিন একাধিক অ্যাসাইনমেন্ট করেন। এক স্পট থেকে আরেক স্পটে দৌড়ান। গাড়ি-ক্যামেরা সংকট থাকলে অফিসে বসেই নানান স্বাদের নতুন নতুন কনটেন্ট বানান। মুহূর্তেই হাজার হাজার ভিউ হয়। এক ঘোরলাগা স্বপ্নের মধ্যে দিন-রাত কাটে তার। তিনি ওরিয়ানা ফালাচি, আমানপুর হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। সময় পেলেই অনলাইনে বিখ্যাত বিখ্যাত টিভি রিপোর্টারের রিপোর্ট দেখেন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ওভাবে কথা বলেন।

কিন্তু, হঠাৎ করেই তার সময় থমকে দাঁড়ায়। কয়েক দিন ধরে ইন্টারনেট বন্ধ। কবে খুলবে কেউ বলতে পারে না। তবু তিনি টুকটাক অ্যাসাইনমেন্ট করে যাচ্ছেন। গাড়ি-ক্যামেরা ও নিরাপত্তা সংকটে প্রতিদিন কাজের সুযোগ পাচ্ছেন না। আর, কাজ করলেও তা অনএয়ার করা যাচ্ছে না। এ যেন ফুপুর মতো চিঠি লেখা। সোমার এক ফুপু একজনকে খুব ভালোবাসতেন। বলতে পারতেন না। এমনকি চিঠি লিখেও জমিয়ে রাখতেন। কোনো দিন সেই চিঠি প্রাপকের কাছে পৌঁছেনি।

সোমা প্রতিদিন ব্যাগে কারফিউ পাস নিয়ে মন খারাপ করে অফিসে যাতায়াত করেন। রাস্তায় ছেলেদের ক্রিকেট আর ফুটবল খেলতে দেখেন। জনবান্ধব এ কারফিউ দেখলে মনেই হয় না কোথাও কোনো সমস্যা আছে। অথচ ইন্টারনেট চালু না থাকায় প্রতিদিন ই-কমার্সে কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। শত শত তরুণ আউটসোর্সিং করে লাখ লাখ টাকা রেমিট্যান্স আনে। সেসব কাজ চলে যাচ্ছে অন্য দেশে। সোমাদের অনলাইন চালু না হলে আয় হবে না। বেতন না পাওয়ার শঙ্কা তার চোখেমুখে। পত্রিকাগুলো স্মার্ট দেশের স্বপ্ন নিয়ে অ্যানালগ যুগে ফিরে এসেছে। প্রচণ্ড কায়ক্লেশে পত্রিকা বের করছে। পর্যাপ্ত খবর না পেয়ে হতাশ পাঠক ইতিউতি গুজবে কান পাতছে। সর্বোপরি নেটিজেনপাড়ায় নেমে এসেছে কবরের নিস্তব্ধতা। গত দুই দশকের প্রিয় অভ্যাসের ছন্দপতনে অনিশ্চয়তা আর হতাশা।

লেখক: যুগ্ম সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাজশাহীতে গণপিটুনিতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নিহত 

কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

দেশে ফিরলেন আমিরাতে ক্ষমা পাওয়া ১৪ বাংলাদেশি

আজকের নামাজের সময়সূচি

শহীদ আমিনুলের সন্তানদের দায়িত্ব নিল ইত্তেফাকুল উলামা

রোববার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

মিছিলে বিএনপি নেতার গুলির প্রতিবাদে বিক্ষোভ

রৌমারীতে ব্যবসায়ীদের আহ্বায়ক কমিটির শপথ অনুষ্ঠিত

৬৫ ভরি স্বর্ণ ছিনিয়ে নেয়ায় মামুনের বিরুদ্ধে যুবদলের মামলা

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ইসলামী আন্দোলনে যোগদান

১০

ক্ষমা পেয়ে আমিরাত থেকে ১২ জন ফিরছেন চট্টগ্রামে

১১

‘ছাত্র জনতার আন্দোলনে হাসিনা সরকার দুই ভাবে পরাজিত’

১২

মহানবীকে (সা.) কটূক্তিকারী সেই যুবকের বিরুদ্ধে মামলা

১৩

শিবচর আঞ্চলিক সড়কে গ্রামবাসীর বৃক্ষরোপণ

১৪

মাদ্রাসাছাত্রকে বলাৎকার চেষ্টার অভিযোগ ধামাচাপা, ৭ দিন পর ফাঁস

১৫

১২ দিনেও মেলেনি রানীনগরে নিখোঁজ নার্গিসের সন্ধান

১৬

দায়িত্বশীলদের নিয়ে সাতক্ষীরায় ছাত্র শিবিরের সমাবেশ

১৭

আযহারী শিক্ষার্থীরা হবে বাংলাদেশ ও মিশরীয় ঐতিহ্যের সেতুবন্ধন : মিশরীয় রাষ্ট্রদূত

১৮

রাজশাহীতে বস্তাভর্তি দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার

১৯

আন্দোলনের ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ছাত্রলীগ কর্মীকে গণধোলাই

২০
X