সরকারের উচ্চমহলের প্রায় সবার অংশগ্রহণে এবারের বাজেটের আগে নীতিনির্ধারণী আলোচনায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বিলাসদ্রব্যসহ অপ্রয়োজনীয় পণ্যের যথাযথভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ, সতর্কতার সঙ্গে উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া, রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি এবং এজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া, বৈধপথে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ভাতাভোগীদের সংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। এমনকি বৈঠকে বাজেট প্রণয়নে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পরামর্শকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে।
নতুন করে আর কর অব্যাহতি নয়, কিছু পণ্যে নতুন করে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের কথা ভাবছে এনবিআর। সংসদ সদস্য, ইকোনমিক জোন-এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন ও হাইটেক পার্কের গাড়িতে ২৫ শতাংশ কর আরোপ হবে বলেও জানা গেছে। সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে গড়ে তুলতে হলে দেশীয় শিল্পের বিকাশে গুরুত্ব দিতে হবে। স্থানীয়ভাবে সম্পদ সংবর্ধনের প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।
বিভিন্ন ঋণদান সংস্থা থেকে আমাদের ঋণের পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে। অন্যদিকে যেসব ঋণ নেওয়া হচ্ছে, তার সদ্ব্যবহারও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এরই মধ্যে শিল্পের কর অব্যাহতি তুলে নেওয়াসহ বিভিন্ন শর্ত দিয়েছে। আমরা জানি, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণ খুবই কম। রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হলে এ খাতে সংস্কার প্রয়োজন।
বর্তমানে কর-জিডিপির অনুপাত ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। কর-জিডিপির অনুপাত বাড়াতে হলে রাজস্ব খাত সংস্কার করতে হবে। অর্থনীতির যেখানেই সম্পদের পুঞ্জীভবন হচ্ছে, তাকেই করের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ কর-জিডিপির অনুপাত থাকা প্রয়োজন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে এ হার সবচেয়ে কম। বর্তমানে বাংলাদেশে কর-জিডিপির অনুপাত সোমালিয়া বা ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর কাছাকাছি। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আমাদের কর-জিডিপির অনুপাত নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ। আর এখন অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা শেষ হওয়ার আর মাত্র এক বছরের কিছুটা বেশি সময় বাকি আছে। কিন্তু আমরা পেছনের কাতার থেকে মোটেও এগোতে পারিনি। বাংলাদেশের অবস্থা হয়তো খুব শোচনীয় নয়। তবে আমাদের বহুমুখী ঋণদান সংস্থার চাপ মোকাবিলায় রাজস্ব আহরণ যে বাড়াতে হবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। উন্নয়ন অর্থায়নের জন্যও এর বিকল্প নেই। স্থানীয়ভাবে রাজস্ব আদায়ের পথে তাই আনতে হবে অপরাপর দেশের অভিজ্ঞতায় অভিনবত্ব।
কর আহরণ বাড়াতে হলে কর ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছে। কর প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। নিয়ে যেতে হবে আয়বর্ধিষ্ণু এলাকাগুলোর কাছাকাছি। কর আহরণে ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করতে হবে। এ খাতের দুর্নীতি কমিয়ে আনতেও শক্ত পদক্ষেপ কাম্য। বিদ্যমান ব্রিটিশ পদ্ধতিতে কর আদায় অব্যাহত থাকলে কর আহরণে সুফল দেবে না। এরই মধ্যে গৃহীত রিরা (রিফর্মিং ইন্টারনাল রেভিনিউ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) এবং ট্যাক্টস (ট্যাক্স অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ক্যাপাসিটি বিল্ডিং অ্যান্ড ট্যাক্স পেয়ারস সার্ভিসেস) প্রকল্পগুলো বেশ কাজ দিয়েছে। এ ধরনের আরও উপকারী প্রকল্প গ্রহণে উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তাও মিলতে পারে।
বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের জিডিপি অনুপাতে কর ২ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়লে গড়ে অতিরিক্ত ৬৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় বাড়বে। এ বাড়তি রাজস্ব বিভিন্ন খাতে সরকার বিনিয়োগ করলে তা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ২ শতাংশ বাড়াবে। ২০২২ সালের হাউসহোল্ড ইনকাম-এক্সপেনডিচার সার্ভে অনুসারে, দেশের মোট সম্পদের প্রায় ৪১ দশমিক ১০ শতাংশ ধনীর হাতে আর মোট ৩০ শতাংশ সম্পদ ওপরের স্তরের ৫ শতাংশের হাতে। তাদের কাছ থেকে যথাযথ কর আদায় করতে পারলে এর চেয়ে অনেক বেশি রাজস্ব বাড়বে, আয়বৈষম্যও কমে আসবে।
জিনি কোইফিশিয়েন্টের (আয়বৈষম্য নির্ধারণের পদ্ধতি) হিসাবে দেশে বৈষম্য ১৯৯০ সালে শূন্য দশমিক ৩৫ ছিল, তা এখন শূন্য দশমিক ৪৯-এ এসে গেছে। অর্থাৎ আয়বৈষম্য বেড়ে গেছে। এতে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন হচ্ছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আসছে। দেশের দারিদ্র্য হয়তো সুনির্দিষ্ট হারে কমেছে, কিন্তু অর্থনীতির গতির সঙ্গে সমন্বয় করে রাজস্ব আদায় বাড়েনি। আমাদের কর-ডিজিপির হার বাড়াতে হলে কর ফাঁকি দেওয়া ঠেকাতে হবে। অন্যদিকে আবার আইএমএফের কথামতো সেচের পানি, ডিজেল ইত্যাদির ওপর হরেদরে কর বাড়ানোও যাবে না। তবে এটাও হয়তো ঠিক, অনেক দিন ধরে চলে আসা, এমনকি অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর কিছু একপেশে ও ব্যক্তিগত অনুরোধ আর উপরোধে চলে আসা কর-রেয়াত বা অব্যাহতির বিষয়টি আমাদের গভীর বিবেচনায় নিতে হবে।
সম্প্রতি আইএমএফ বাংলাদেশকে কিছু নিয়ম বেঁধে দিয়েছে। আইএমএফের চিরাচরিত তিনটি নীতি আছে—প্রথমত নমনীয় বিনিময় হার, দ্বিতীয়ত নমনীয় ও উচ্চ সুদহার এবং তৃতীয়ত কঠোর মুদ্রানীতি। এরা অনেকটা আপ্তবাক্যের মতো তিনটি নীতি অনুসরণ করতে থাকে বলে অভিযোগও রয়েছে। তিনটিই অ্যাডাম স্মিথ বর্ণিত অদৃশ্য হাত (ইনভিজিবল হ্যান্ড), যেন সব কাজ করে ফেলবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর বাইরে অনেক বিষয় আছে। দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে দেশকে গৎবাঁধা নীতির বাইরেও যেতে হবে। সেজন্য অতীতের মতো রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশন গঠনের কথাও ভাবা যেতে পারে। প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে, নাকি পরোক্ষ করের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ করা হবে, এ ব্যাপারে অনেক আলোচনা আছে। এদিকে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হলে আমদানি শুল্কও কমবে। এতে আমাদের আমদানি রাজস্বও কমবে। এর প্রভাব পড়বে শিল্পোৎপাদনেও। অর্থাৎ হঠাৎ মুদ্রানীতির মাধ্যমে আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে।
অন্যদিকে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা। ব্যাংকাররা তাদের ঋণ দিতে চান না কিংবা ঋণ না দেওয়ার জন্য নানা বাহানা তৈরি করেন। বড় ব্যবসায়ীদের ওপর অবশ্য এর প্রভাব খুব একটা পড়ে না। বড় ব্যবসায়ীরা ঋণ পান, কারণ তারা হয়তো তথাকথিত জামানত দিতে পারেন। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ওপর মনোনিবেশ করতে হবে। বাজারে চাহিদা বেড়ে গেলে মুদ্রা সরবরাহ কমাতে হবে। সেজন্য হয়তো মাঝেমধ্যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নিয়ে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের হাতে যেন ঋণ পৌঁছায়, সেজন্যও বাংলাদেশ ব্যাংককে বিশেষ নজর রাখতে হবে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে আর্থিক হিসাব নেতিবাচক। তবে চলতি হিসাব ইতিবাচক। আর্থিক হিসাব নেতিবাচক মানে অধিক হারে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে না। বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়াতে হলে বিনিয়োগ খাতকে আকর্ষণীয় করতে হবে। বিনিয়োগ আকর্ষণে জটিলতা নিরসন করে দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হবে। প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ানোয় উদ্যোগ নিতে হবে। এতে কর্মসংস্থান বাড়বে। কর্মসংস্থান বাড়লে বেকারত্ব কমবে। রেমিট্যান্সও কম এবং তা বাড়ানোর জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়াতে হলে হুন্ডি কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। হুন্ডি কমানোর জন্য কিন্তু অনেক আইনকানুন আছে। হুন্ডি একেবারে নির্মূল করা কঠিন হলেও কমানো অবশ্যই সম্ভব। দেশের অর্থনৈতিক নীতিতে এসব বিষয় বিবেচনায় রেখেই আমাদের সামনের দিকে অগ্রসর হতে হবে। ক্রমবর্ধমান ঋণের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসার উপায় বের করতে হবে। আইএমএফ এবং অন্যান্য সংস্থা থেকে যেসব ঋণ নেওয়া হচ্ছে তার সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে, তা না হলে দীর্ঘমেয়াদে দেশের জনগণকে ঋণের বোঝা বইতে হবে।
বাংলাদেশের অবস্থা হয়তো খুব শোচনীয় নয়। তবে আমাদের বহুমুখী ঋণদান সংস্থার চাপ মোকাবিলায় রাজস্ব আহরণ যে বাড়াতে হবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। উন্নয়ন অর্থায়নের জন্যও এর বিকল্প নেই। স্থানীয়ভাবে রাজস্ব আদায়ের পথে তাই আনতে হবে অপরাপর দেশের অভিজ্ঞতায় অভিনবত্ব এবং পদক্ষেপ।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক-বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড