মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫, ৯ বৈশাখ ১৪৩২
প্রভাষ আমিন
প্রকাশ : ১৭ জুলাই ২০২৪, ০৩:০৭ এএম
আপডেট : ১৭ জুলাই ২০২৪, ০৮:১৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ভয় দেখিয়ে জয় করা যায় না

ভয় দেখিয়ে জয় করা যায় না

রোববার রাত থেকে আমার মনটা খারাপ, ভীষণই খারাপ। এতটাই খারাপ, দুদিনেও স্বাভাবিক হতে পারছি না। বরং নানান ঘটনা প্রবাহে মনটা আরও খারাপ হয়েছে। রোববার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ‘তুমি কে, আমি কে; রাজাকার, রাজাকার’ এ স্লোগান শোনার পর আমার মনে হয়েছে, আমাদের সারাজীবনের সব চেষ্টা বুঝি বিফলে গেল। বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কখনো এমন স্লোগান শুনতে হবে ভাবিনি। নব্বইয়ের দশকে হুমায়ূন আহমেদের নাটকের একটি সংলাপ ‘তুই রাজাকার’ দেশজুড়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। আর আজ সেই ন্যারেটিভ পাল্টে গেছে। ‘তুই রাজাকার’-এর বদলে এসেছে ‘আমি রাজাকার’; এটা অবিশ্বাস্য, দুর্ভাগ্যজনক। এ ন্যারেটিভ বদলে যাওয়ার জন্য আমাদের সবাইকে দায় নিতে হবে। আমরা এতদিন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গড়ার যে লড়াই করলাম, তার পুরোটাই কি তবে ব্যর্থ হয়ে গেল। আমাদের চোখের সামনেই দেশটার সর্বনাশ হয়ে গেল! মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার সময়ে তরুণ প্রজন্ম আর মুক্তিযুদ্ধকে এমন মুখোমুখি দাঁড় করানো দেখাটা সত্যি দুর্ভাগ্যজনক। স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৮ সালে বাতিল হওয়ার আগপর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা ছিল। কিন্তু আগে কখনো আন্দোলন হয়নি। ২০১৮ সালের আন্দোলনে তরুণ প্রজন্মের মাথায় এমন একটা ধারণা গেঁথে দেওয়া হয় যে, তাদের বঞ্চনার জন্য দায়ী মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরিরাই তাদের চাকরি কেড়ে নিচ্ছে। এ ভুল ভাবনায় বশবর্তী হয়ে তরুণ প্রজন্ম আন্দোলনের মাঠে মুক্তিযুদ্ধকেই প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলে। আন্দোলনে কোটা সংস্কারের দাবি করা হলেও, তাদের মূল আপত্তি ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে। এবারের আন্দোলনেও তাই। কিন্তু আমাদের ব্যর্থতা হলো, আমরা তরুণ প্রজন্মকে বোঝাতে পারিনি যে, মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তারা জীবনের পরোয়া না করে যুদ্ধ করেছেন বলেই আমরা একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। তাই তাদের বা তাদের উত্তরসূরিরা রাষ্ট্রের কাছে একটু বাড়তি সুবিধা, একটু বাড়তি সম্মান পেতেই পারে। আর মুক্তিযোদ্ধার উত্তরসূরিদের জন্য যে ৩০ ভাগ কোটা রাখা হয়েছে, তা আসলে সম্মানসূচক। কারণ অনেক বছর ধরেই মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরিদের কোটা পূরণ হয় না। গড়ে পাঁচ-ছয় ভাগের বেশি এ কোটায় যোগ্য লোক পাওয়া যায় না। বাকি ভাগ সাধারণ তালিকা থেকেই পূরণ করা হয়। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরিরা সব চাকরি নিয়ে নিচ্ছে, এ ধারণাটা ভুল। আর কোটা ব্যবস্থায় মেধাবীদের বঞ্চিত করে সব অমেধাবী চাকরি পেয়ে যাচ্ছে, এমন প্রচলিত ধারণাও ভুল। কোটায় চাকরি পেতে হলেও মেধার পরীক্ষার সব ধাপ অতিক্রম করেই আসতে হয়।

তরুণ প্রজন্মের ক্ষোভ, বঞ্চনাকে পুঁজি করে একটি মহল তাদের মুক্তিযুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ট্যাগ লাগানো আমাদের পুরোনো স্বভাব। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললেই আমরা তাকে ‘জামায়াত-শিবির’ ট্যাগ লাগিয়ে দিই। আমি নিজেও অনেকবার এ ট্যাগের শিকার হয়েছি। কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদেরও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করার ও ট্যাগ লাগানোর অপপ্রয়াস চলছে। যদিও তাদের আন্দোলন মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিরুদ্ধে, তবুও আন্দোলনকারীরা সবাই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এমনটা মনে করা বা এমন ট্যাগ লাগানো একটা মহা ভুল এবং মহা অন্যায়। একটি মহল তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিতে চাইছে বটে, কিন্তু সেই ফাঁদে পা দিয়ে গোটা তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়াটাই আত্মঘাতী। মনে রাখতে হবে, কোটাবিরোধী মানেই স্বাধীনতাবিরোধী নয়, কোটাবিরোধী মানেই রাজাকার নয়। যারা কোটার সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছে, তারা আমাদেরই সন্তান।

এ প্রসঙ্গে একটা ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা দিয়ে নিই। গত রোববার প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে আমি চলমান কোটা আন্দোলন নিয়ে একটি প্রশ্ন করেছিলাম। আমার প্রশ্নে একটা অংশ ছিল, মেধার পরীক্ষার সব ধাপ পেরিয়ে আপনার সামনে যদি দুজন সমান মেধাবী থাকেন, তাদের একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, একজন রাজাকারের সন্তান; আপনি কাকে চাকরি দেবেন? প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে। আমার প্রশ্নটা ছিল একটা অপশন মাত্র। এখানে কোনোভাবেই আন্দোলনকারী সবাইকে রাজাকার বলা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীও তার জবাবে আন্দোলনকারী সবাইকে রাজাকার বা স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি বলেননি। তবুও বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, আন্দোলনকারীদের আমি কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বা রাজাকার মনে করি না। তারা সবাই আমার সন্তানের মতো। তাদের বঞ্চনা, তাদের ক্ষোভটা আমি বুঝি। শতচেষ্টার পরও প্রাপ্য চাকরি না পেলে আপনি ক্ষুব্ধ হবেনই। তারপরও আমার প্রশ্নে যদি আন্দোলনকারীদের একজনও ক্ষুব্ধ হয়ে থাকেন, আমি তার কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাইছি। আমি স্বাধীনতার পক্ষে, আমি বাংলাদেশের পক্ষে। ন্যায্যতার ভিত্তিতে আমরা একটি মানবিক রাষ্ট্র চাই।

তবে রোববার প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে আমার মূল প্রশ্ন ছিল ভিন্ন। আমি কোটাবিরোধী চলমান আন্দোলন ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলার জন্য সরকারপ্রধানকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবেদন করেছিলাম, যেন আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বিষয়টি ধৈর্য ও সংবেদনশীলতার সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। যেন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তাদের ক্ষোভ প্রশমনের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু আমার আবেদন ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বিফলে গেছে। রোববার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রাজাকার’ স্লোগানে আমার যতটা মন খারাপ হয়েছিল, সোমবার বিকেলে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় তার চেয়ে বেশি খারাপ হয়েছে। রোববার রাতের ঘটনায় আমি বিস্মিত হলেও সোমবারের হামলায় মোটেই অবাক হইনি। ছাত্রলীগ হামলা চালানোর ব্যাপারে অভিজ্ঞ। কিন্তু অতীতেও আমরা দেখেছি, ছাত্রলীগ বা পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমন করা যায় না, যায়নি কখনো। ২০১৮ সালে এই কোটাবিরোধী আন্দোলনের কথা মনে থাকলে ছাত্রলীগের হামলা চালানো উচিত ছিল না। ১৪ দিন ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করে সরকার যেটুকু অর্জন করেছিল, সোমবারের হামলায় তার পুরোটাই বিসর্জনে গেছে। এ লেখা যখন লিখছি, তখনো রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলনকারীদের ঠেকাতে মাঠে নেমেছে ছাত্রলীগ।

কিন্তু এভাবে হয় না। এভাবে হামলা চালিয়ে বিপুলসংখ্যক তারুণ্যকে প্রতিপক্ষ বানানোটা বোকামি। বরং উচিত ছিল, কোটা বিষয়ে সঠিক তথ্য তুলে ধরা। তাদের বলা যে তাদের আন্দোলনের সঙ্গে সরকারের অবস্থানের কোনো ভিন্নতা নেই। বরং কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন বাতিল করে দেওয়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকারই আপিল করেছিল। তাই আন্দোলনকারীদের অবস্থান আর সরকারের অবস্থান সমান্তরাল। এ বিশালসংখ্যক তারুণ্যকে স্বাধীনতাবিরোধী বা রাজাকার আখ্যা দিয়ে প্রতিপক্ষে ঠেলে দিয়ে তাদের ওপর হামলা চালানোটা অন্যায়, অমানবিক। যেভাবে ছাত্রীদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে, যেভাবে ছাত্রদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে; তা চোখে দেখা যায় না।

বরং আওয়ামী লীগের আত্মমূল্যায়ন প্রয়োজন, কেন তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধকেই প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলছে। তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে ঠিকঠাকমতো কমিউনিকেট করতে পারছে না কেন আওয়ামী লীগ। যারা আন্দোলনে আছেন, তাদের প্রতি অনুরোধ, আপনাদের আন্দোলনের আবেগ, অনুভূতির সঙ্গে আমি শতভাগ একমত। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রের সবচেয়ে গৌরবের অধ্যায়কে বিতর্কিত করবেন না। মুক্তিযুদ্ধকে, বাংলাদেশকে হৃদয়ে ধারণ করেই আপনাদের দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরুন। মনে রাখবেন, দেশটা আমার-আপনার সবার। আওয়ামী লীগ মানেই মুক্তিযুদ্ধ নয়, আওয়ামী লীগ মানেই বাংলাদেশ নয়। আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের অন্যায়ের জন্য মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিপক্ষ করবেন না, মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করবেন না। আর সরকারের প্রতি অনুরোধ, আপনারা ছাত্রলীগকে নিবৃত্ত করুন। ছাত্রলীগের যারা আইন হাতে তুলে নিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। আন্দোলনকারীদের আবেগের মূল্যায়ন করুন, তাদের সঙ্গে কথা বলুন, তাদের কথা মন দিয়ে শুনুন।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি মডেল ইউনাইটেড নেশনস অ্যাসোসিয়েশনের ১০ বছর পূর্তি

ছাত্রলীগ কর্মীকে পিটিয়ে রিকশায় ঘোরানো ছাত্রদল নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা

নারায়ণগঞ্জে চাঞ্চল্যকর সোহান হত্যা মামলার প্রধান আসামি গ্রেপ্তার

আ.লীগের হাতে গত ১৫ বছর আলেম সমাজ লাঞ্ছিত হয়েছে : রহমাতুল্লাহ

চট্টগ্রামে পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীরা এবার বসলেন আমরণ অনশনে

বগুড়ায় ৫ ইউএনওর মোবাইল নম্বর ক্লোন করে চাঁদা দাবি

৩ মিনিটের ঝড়ে লণ্ডভণ্ড ফরিদপুর

ইরান নিয়ে ইসরায়েলের সামনে এখন ‘প্ল্যান বি’

আ.লীগের মিছিলের প্রস্তুতির সময় বিএনপি নেতার ছেলে গ্রেপ্তার

১০০ আসনে নারীদের সরাসরি নির্বাচন চায় এনসিপি

১০

সরিয়ে দেওয়া হলো স্বাস্থ্য উপদেষ্টার এপিএসকেও

১১

রেকর্ড ভেঙে সোনার দামে নতুন ইতিহাস

১২

আরেক দেশকে নিয়ে ‘বিশাল যুদ্ধ মহড়ায়’ যুক্তরাষ্ট্র

১৩

বাকেরগঞ্জে কারখানা নদীর বালুমহাল ইজারা বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন

১৪

টানা পাঁচ দিন ঝরবে বৃষ্টি    

১৫

কালবৈশাখী ঝড়ে লণ্ডভণ্ড মিরসরাই

১৬

মেজর সিনহা হত্যা মামলার আপিল শুনানি বুধবার

১৭

লেভানডভস্কির চোটে বার্সা শিবিরে দুঃশ্চিন্তা

১৮

ডিসি শাকিলাকে রেলওয়ে পুলিশে বদলি

১৯

ছাত্রদলে পদ পেতে স্ত্রীকে তালাক, ফয়সাল রেজার অব্যাহতি

২০
X