নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতা অমলকান্তি-এর অংশবিশেষ:
“আমাদের মধ্যে যে এখন মাষ্টারি করে,
অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত,
যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল,
উকিল হলে তার এমন কিছু ক্ষতি হত না।
অথচ, সকলেরই ইচ্ছে পূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।”
যে কোনো কবিতারই দোতনা অনেক গভীর। ফলে কবিতার পুরো গভীরে যাওয়া সাধারণত সম্ভব নয়। তবে খানিকটা অনুধাবন করা যায়। উদ্ধৃত অংশ থেকে এটুকু ধারণা নেওয়া চলে, অমলকান্তির মতো অনেকেরই ইচ্ছা পূরণ হয় না। আর যে যা হয়েছেন সে অন্যটাও হতে পারতেন, তাতে কোনো ক্ষতি হতো না। এ বিবেচনায় রাস্তায় যে ছিনতাই করে সেও কিন্তু অন্য কিছু হতে পারত। যিনি শিক্ষক, তিনিও কিন্তু অন্য পেশায় যেতে পারতেন, রাস্তার ছিনতাইকারীও হতে পারতেন। পাকিস্তান আমলে তো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সিভিল সার্ভিসে যাওয়ার একটা রেওয়াজই ছিল। ফলে ইচ্ছা পূরণ না হওয়া এবং ভিন্ন কিছু হওয়ার শিক্ষা কবিতার বাইরে থেকেও নেওয়া যায়। এ শিক্ষা তো সর্বব্যাপী। সঙ্গে আরেকটি শিক্ষা হচ্ছে, সব পেশারই আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকে। থাকে আচরণধারা। দাবি আদায়ের জন্য সাবেকি আমলের আদমজীর শ্রমিকরা যা করেছেন এবং অধুনা গার্মেন্টস শ্রমিকরা যা করেন, তা কিন্তু অনেক পেশায় মানায় না। যদিও হাসপাতালের বেডে রোগীদের ফেলে রেখে ডাক্তাররা ধর্মঘট করেন, উকিলরা করেন মারামারি, বিচারকের দরজায় লাথি মারেন—ইত্যাকার অনেক অনাচার দেখে দেখে অনেকেরই শানিত চেতনা হয়তো খানিকটা ভোঁতা হয়ে গেছে। এরপরও দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককুল রাস্তায় নেমে চিৎকার-চেঁচামেচি করবেন, বক্তব্যে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মতো শব্দ প্রয়োগ করবেন! এটা দেশের মানুষকে ব্যথিত করে। আবার কোনো কোনো শিক্ষকের বডি ল্যাঙ্গুয়েজে অনেকেই বিস্মিত।
সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রত্যাহারের দাবিতে ১ জুলাই থেকে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করছেন। এ কারণে ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস, পরীক্ষা এবং দাপ্তরিক কার্যক্রম বন্ধ। সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্তির কারণে শিক্ষকরা নিজেদের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থেকে রাস্তায় নেমেছেন। সাধারণভাবে বলা হয়, দাবি আদায়ের জন্য চিকিৎসক, আইনজীবীসহ জরুরি পেশায় নিয়োজিত মানুষদের কর্মবিরতি অগ্রহণযোগ্য। আর শিক্ষকদের বেলায় এটি তো গন্ধম ফলের মতোই নিষিদ্ধ। সর্বোচ্চ শিক্ষাপীঠের শিক্ষকদের সাম্প্রতিক আচরণে অনেকেই মনে করেন, লজ্জায় মুখ লুকানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। দাবি আদায়ে শিক্ষকদের সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন অনৈতিক হিসেবেও আখ্যায়িত করেন কেউ কেউ। এ অবস্থা উদ্ভব হয়েছে প্রত্যয় স্কিম নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রধান সমালোচনাগুলো হচ্ছে—বিদ্যমান ব্যবস্থায় চাকরিজীবীর বেতন থেকে টাকা কাটা হয় না, যা প্রত্যয় স্কিমে কাটা হবে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় অধ্যাপকরা এককালীন গ্র্যাচুইটি বা আনুতোষিক পান ৮০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। এ বিষয়ে প্রত্যয় স্কিমে কিছু বলা হয়নি। বিদ্যমান ব্যবস্থায় অর্জিত ছুটির পরিবর্তে অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা থাকলেও প্রত্যয় স্কিমে এ বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই। বিদ্যমান ব্যবস্থায় পেনশনার ও নমিনি আজীবন পেনশনপ্রাপ্ত হন। প্রত্যয় স্কিমে পেনশনার যদিও আজীবন পেনশনপ্রাপ্ত হবেন কিন্তু পেনশনারের মৃত্যুর পর নমিনি পেনশনারের বয়স ৭৫ বছর পূর্তি পর্যন্ত পেনশনপ্রাপ্ত হবেন। বিদ্যমান ব্যবস্থায় নিট পেনশনের ওপর ৫ শতাংশ হারে বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হয়। কিন্তু প্রত্যয় স্কিমে বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের ব্যবস্থা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবসরের সময়সীমা ৬৫ হলেও তা প্রত্যয় স্কিমে বিবেচনা করা হয়নি এবং বিদ্যমান পেনশন স্কিমে মাসিক পেনশনের সঙ্গে চিকিৎসা ভাতা, বছরে দুটি উৎসব ভাতা ও একটি বৈশাখী ভাতা প্রদান করা হয়, প্রত্যয় স্কিমে এসব বিষয়ে কিছু বলা হয়নি বলে অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের।
এদিকে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছেন, শিক্ষকরা যেসব বিষয়ে আন্দোলন করছেন, তা অনেকটাই সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিম পুরোপুরি না বুঝেই। বিদ্যমান সুবিধার চেয়েও প্রত্যয় স্কিমে অন্তত ১২ গুণ বেশি অবসর ভাতা পাবেন শিক্ষকরা। ২০২৩ সালে সর্বজনীন পেনশন চালু করে কৃষক, শ্রমিক থেকে শুরু করে দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর পড়ন্ত জীবন নিরাপদ করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সুযোগ-সুবিধা বিবেচনা করে এ পর্যন্ত ‘প্রবাস’, ‘প্রগতি’, ‘সুরক্ষা’, ‘সমতা’ ও ‘প্রত্যয়’ নামে পাঁচটি পেনশন স্কিম চালু করা হয়েছে। এর প্রথম চারটি বেসরকারি খাতের মানুষদের জন্য এবং ‘প্রত্যয়’ নামের পঞ্চমটি স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নাগরিকদের জন্য প্রযোজ্য। সরকারের ঘোষণা অনুসারে, ২০২৫ সালের ১ জুলাইয়ের পর সরকারের চাকরিতে যোগ দেওয়া সব কর্মকর্তা ও কর্মচারী এ স্কিমের আওতায় আসবেন।
প্রত্যয়সহ সর্বজনীন পেনশন স্কিমের সবকটিতে কিছু কিছু দুর্বলতা থাকাটা বিচিত্র কিছু নয়। এতে শুধু শিক্ষককুল নয়, অন্য পেশার মানুষরা সংক্ষুব্ধ হতে পারেন। কিন্তু তাই বলে শিক্ষকরা লাগাতরভাবে রাস্তায় থাকবেন? আবার আন্দোলন ‘কঠোরতর’ করার হুংকার দেবেন? তারা বেমানান। এর চেয়ে তারা প্রতীকী কোনো কর্মসূচি নিতে পারতেন। যাতে বিষয়টি সবার নজরে আসে। এতে সরকারও আলোচনার একটি স্পেস পেত, জনসহানুভূতিও পেতেন শিক্ষকরা। কিন্তু তা না করে সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে হুড়মুড় করে রাস্তায় নেমে পড়ার বিষয়টি তো অনেকের দৃষ্টিতেই জাসদীয় হটকারীর মতোই মনে হচ্ছে এবং আলোচনার ক্ষেত্রে সরকারের জন্য সম্মানজনক কোনো পথ খোলা রাখা হয়নি বলে মনে করা হয়। হয়তো এ কারণেই সরকারের মুখপাত্র হিসেবে সেতুমন্ত্রীর সঙ্গে গত ৪ জুলাইয়ের বৈঠক হয়নি বলে মনে করছেন কেউ কেউ। অথচ পরিস্থিতি জটিলতর না করে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, মনোযোগ এবং সমাধানের সদিচ্ছায় প্রতীকী কর্মসূচির পাশাপাশি আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধানে পৌঁছানো কঠিন কোনো কাজ ছিল না। এরপরও বিশ্লেষকরা বলছেন, এখনো সমাধানে পৌঁছানো মোটেই কঠিন কিছু নয়। রেওয়াজ অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং কয়েক লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের ক্ষতির কথা বিবেচনা করে শিগগির আলোচনায় বসে কথিত এ আন্দোলনের অবসান হবে—এমনটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।
এ প্রসঙ্গে একটি বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। শিক্ষকরা হয়তো এখনো জানেনই না তাদের কেন্দ্র করে কী হতে চলেছে। তাদের একটি বিষয় বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন, জিম্মি করে দাবি আদায়ের সীমা থেকে সরকার কিন্তু অনেক ওপরে আছে। আর শিক্ষকরা রাজনীতির গিনিপিগ হলে ইজ্জত যতটুকু আছে তাতেও কিন্তু আঘাত লাগার আশঙ্কা থেকেই যায়। অন্যান্য পেশার মতো চরমভাবে বিভাজিত শিক্ষক সমাজের অভ্যন্তর থেকে কোনো মহল কিন্তু রাজনীতির লক্ষ্য হাসিলের খেলা খেলে দিতে পারে। তখন কি শিক্ষকসমাজ সামাল দিতে পারবে?
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক