মেজর (অব.) ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ
প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০২৪, ০২:২১ এএম
আপডেট : ১৩ জুলাই ২০২৪, ০৯:০৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান অটুট থাকুক

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান অটুট থাকুক

১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে মোগল সম্রাট আকবর তার বিশ্বস্ত সহচর ও উপদেষ্টা বৈরাম খাকে নিয়ে যুদ্ধ করেন সে সময়কার শৈর্য-বীর্যের প্রতীক ও মহারাজ বিক্রমাদিত্য উপাধি নেওয়া দক্ষিণ ভারতীয় রাজা হিমুর বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় ঘটে কয়েক সপ্তাহ আগেই দিল্লি ও আগ্রা দখল করা দক্ষিণের হিমুবাহিনীর। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই যুদ্ধে বিজয় লাভের সময় সম্রাট আকবরের বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডারের যুদ্ধ জয় শুরু হয়েছিল বলকান যুদ্ধে জয়ের মধ্য দিয়ে, যখন তার বয়স ২১। যুক্তরাষ্ট্রে ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত চলে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। এই যুদ্ধে বেশ কজন শিশুযোদ্ধা অমর হয়ে আছেন ইতিহাসের পাতায়। এর মধ্যে জন লিঙ্কন ক্লেম মাত্র ১০ বছর বয়সে প্রথম দুবার প্রত্যাখ্যাত হলেও তৃতীয়বারের প্রচেষ্টায় যুদ্ধে যোগ দেন। এ যুদ্ধে কৃতিত্বের জন্য ১৩ বছর বয়সী উইলিয়াম জন স্টোন পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের কাছ থেকে মেডেল অব অনার অর্থাৎ সম্মানসূচক পদক লাভ করেন। একই যুদ্ধে একজন জেনারেল ছিলেন ইউলিসেস এস ক্রান্ট গ্রান্ট। তার পুত্র ফ্রেডরিক গ্রান্ট মাত্র ১২ বছর বয়সে পিতার নিষেধ অমান্য করে যুদ্ধে যোগ দেন এবং সম্মুখ রণাঙ্গনে পায়ে গুলিবিদ্ধ হন।

অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ পূর্বদিকে অবস্থিত গোয়াদাল কানাল অঞ্চলে ও সলোমন দ্বীপপুঞ্জের নিকটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেশ কিছু ভয়াবহ নৌযুদ্ধ হয়। ১৯৪২ সালের ১৪ নভেম্বর এমনি এক নৌযুদ্ধ চলাকালে ‘ব্যাটেল শিপ এক্স’ নামে পরিচিত আমেরিকার একটি যুদ্ধ জাহাজে জাপানিরা ৪৭ বার বোমা নিক্ষেপ করে। এতে জাহাজে থাকা প্রায় অর্ধেক নৌসেনানী মৃত্যুবরণ করেন। যারা বেঁচে ছিলেন, তাদেরও প্রায় সবাই ছিলেন আহত। বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে নৌসেনা কেলভিন গ্রাহামের বয়স ছিল ১২ বছর। শরীরে পোড়া ক্ষত, মুখে ধারালো লৌহখণ্ডের (স্প্লিন্টার) আঘাত ও দাঁত হারানোর পরও কেলভিন রাতভর আহত অন্য নৌসেনাদের সেবা-শুশ্রূষা করেন এবং আশার কথা শোনাতে থাকেন। পরে কেলভিন গ্রাহাম বীরত্ব সূচক বিভিন্ন পদক লাভ করেন।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বীরপ্রতীক খেতাব পাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম লালুর বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্য এ মুক্তিযোদ্ধা একাই পাকিস্তানি শিবিরে ঢুকে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটান। এতে আটজন শত্রু নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়।

পৃথিবীর ইতিহাসে শিশুযোদ্ধাদের এমন বীরত্বগাথার বহু নিদর্শন থাকলেও যুদ্ধের পর জন্ম নিয়ে যোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রপ্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার ঘটনা সম্ভবত একমাত্র বাংলাদেশেই ঘটেছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাওয়া প্রায় দুই হাজার জনের জন্ম ১৯৭১ সালের পর, যা নিয়ে তদন্ত চলছে তো চলছেই। সরকারের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেছেন যে, দুই-একজনের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটলে এটাকে ভুল বলা যেত। কিন্তু দুই হাজার জনের ক্ষেত্রে এমন ঘটলে তাকে আর ভুল বলার সুযোগ নেই।

অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে ১ লাখ ৯২ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধাকে বিভিন্ন প্রকার ভাতা প্রদান করা হলেও ‘ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম’ (এমআইএস) নামক উন্নত ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভাতা প্রদান শুরু হলে এ সংখ্যা ২০ হাজার হ্রাস পায় এবং ১ লাখ ৭২ হাজারে নেমে আসে। কোন ২০ হাজার ব্যক্তি, ভূত বা প্রেতাত্মা দীর্ঘদিন মুক্তিযোদ্ধা সেজে সরকারের তথা জনগণের টাকা হজম করেছে, তা অজানাই রয়ে গেছে। পূর্বের বরাদ্দ অনুসারে মাথাপিছু ১০ হাজার টাকা করে ধরা হলেও এতে মাসে অন্তত ২০ কোটি টাকা তথা বছরে ২৪০ কোটি টাকার নিশ্চিত দুর্নীতি হয়েছে, এ ক্ষেত্রে আমরা প্রায়ই শুনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্যসহিষ্ণুতা নীতিতে সার্বিকভাবে সরকার এবং বিশেষভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনড় ও অটল। তাই মাসে ১ কোটি হিসাবে বছরে ১২ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে হলেও প্রয়োজনে অবসরপ্রাপ্ত অথচ সৎ ও শারীরিকভাবে সক্ষম সরকারি কর্মকর্তা, প্রতিরক্ষা বাহিনীর অফিসার কিংবা বিচারকদের দিয়ে এমন দুর্নীতির শিকড় অনুসন্ধান ও সমাজে একটি অন্তত দৃষ্টান্ত স্থাপন করা একান্ত বাঞ্ছনীয়।

২০২১ সালের ৯ অক্টোবর একটি বাংলা দৈনিকের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধের ৯ বছর পর জন্ম নেন চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার হাজীগাঁও গ্রামের মো. মিজানুর রহমান। তার বাবা-মায়ের বিয়ে হয়েছিল ১৯৭৮ সালে অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের পর। অথচ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার নাম আছে সরকারি নথিতে। একই দৈনিক পত্রিকা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপির বরাতে মহান সংসদে আলোচিত নিখিল চন্দ্র সাহার কথা উঠে আসে। মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ও সুবিধা পাওয়া নিখিলের জন্ম ১৯৬৮ সালের ২৮ মার্চ অর্থাৎ ১৯৭১ সালের মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় নিখিলের বয়স ছিল তিন বছর। এমন জানা কাহিনির আড়ালে অজানা-অপ্রকাশিত কাহিনিও কেবল কম নয়।

বীর মুক্তিযোদ্ধারা নিঃসন্দেহে দেশ ও জাতির অহংকার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে এসেছিল দেশ-বিদেশের বহু সোনার ছেলে, ব্যক্তি, রাষ্ট্র ও সংগঠন। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখা এমন ৩৩৮ ব্যক্তি ও সংগঠনকে তাদের অবদানের প্রতি সম্মান জানাতে স্বাধীনতার ৪০ বছরপূর্তি উপলক্ষে ৩৩৮টি সম্মাননা ক্রেস্ট সরাসরি কিংবা দূতাবাসের মাধ্যমে প্রদান করেন। এসব ক্রেস্টে ১ ভরি স্বর্ণ থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে ছিল ৪ ভাগের ১ ভাগ, অর্থাৎ ১৬ আনা স্বর্ণের ১২ আনাই ছিল মিছে। মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে ও জীবন দিয়ে দেশের জন্য যুদ্ধ করলেও একদল পথভ্রষ্ট শিক্ষিত ব্যক্তি দেশের মানসম্মান বিসর্জন দিয়ে নিজের আখের গোছাতে একটুও কার্পণ্য করেন না। দুঃখের বিষয় হলো, অলৌকিক ক্ষমতাবলে তারা নিরাপদ থাকেন, বহাল তবিয়তে সরকারি চাকরির নিয়মিত মেয়াদ শেষ করেন, ক্ষেত্রবিশেষে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান, এমনকি দলীয় মনোনয়ন পেয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মন্ত্রী-এমপি বনে যান। এই সংস্কৃতি বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার পক্ষে বড় অন্তরায়।

২০২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর একটি বাংলা দৈনিকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ৪৬টি খাতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলে ৭৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পেয়েছে সরকারের রাজস্ব অধিদপ্তর। পরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরও ১০ কোটি ১০ লাখ টাকা খরচে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়। আরও কিছু অভিযোগ পাওয়া যায় ৪৩৬টি উপজেলায় নির্মিত তিনতলাবিশিষ্ট ৪৩৬টি মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে।

এ তো গেল জ্ঞানপাপীদের কথা, যাদের অধিকাংশের জন্মই হয়তোবা মহান মুক্তিযুদ্ধের আগে। যাদের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের পর, তাদের নিয়ে কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সম্প্রতি বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রচার করেছে। এ কথা সবার জানা যে, সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি রাখা বা সংশোধনের পক্ষে-বিপক্ষে রাজপথে আন্দোলন করছে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা। মুক্তিযোদ্ধাদের নিজেদের আর নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়ার সুযোগ নেই। তাদের সন্তানদের সুযোগও দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে বয়সজনিত কারণে। এবার নাতি-নাতনিরা সেই কোটায় চাকরির প্রত্যাশা করছেন। তারা যেমন এমনটা প্রত্যাশা করছেন, তেমনি জাতিও প্রত্যাশা করে যে, দেশের ভবিষ্যৎ এই আগামী প্রজন্ম অন্তত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মৌলিক কিছু জ্ঞানের অধিকারী হবেন। একটি বেসরকারি টেলিভিশনের প্রতিবেদনে দেখা যায়, যারা তাদের পূর্বপুরুষ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বিধায় মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি প্রত্যাশা করছেন, তারা অনেকেই জানেন না যে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া পূর্বপুরুষরা কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। তাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাধারণ জ্ঞানের অভাব দৃষ্টিকটু ও অত্যন্ত লজ্জাজনক।

মুক্তিযোদ্ধারা একটি দেশ দিয়েছেন, স্বাধীনতা দিয়েছেন। আমরা কী দিচ্ছি? আমরা কি শুধু নিতেই শিখেছি? কেউ ব্যাংক নিচ্ছি! কেউ শেয়ারবাজার নিচ্ছি! কেউ রিসোর্ট নিচ্ছি! কেউ স্বর্ণের ক্রেস্ট নিচ্ছি! কেউ পিএইচডি সার্টিফিকেট নিচ্ছি! কেউবা আবার কোটি টাকা দামের উচ্চবংশীয় ব্রাহমা গরু নিচ্ছি! ১৫ লাখ টাকা দামের ছাগল ৩০ লাখ শহীদের বিদেহী আত্মার প্রতি চরম অবমাননা—এর অবসান চাই।

লেখক: মেজর (অব), গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কিশোরগঞ্জ-৫ আসনে তৃণমূলের আস্থা হুদাতে

১ হাজারে দৈনিক সুদ ১০০ টাকা!

বাংলাদেশ সফরে আসতে পারেন ব্রিটেনের রাজা

‘ড্রেসিংয়ে গেলে বলতেন আন্দোলনে গেছিলা ক্যান’

৩১ দফা বাস্তবায়নে বিএনপি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ : যুবদল সম্পাদক

শহীদ শাকিলের কবরে ছাত্র ফেডারেশনের শ্রদ্ধা নিবেদন

দুই দিনের ব্যবধানে সোনার দাম বৃদ্ধি, ভরি কত?

সাগরে লুঘচাপের মধ্যেই বৃষ্টি নিয়ে বড় দুঃসংবাদ   

আ.লীগের ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ : রাশেদ প্রধান

সাতছড়ি উদ্যান দখল করে প্রভাবশালীদের লেবু চাষ

১০

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কমিটি নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সংঘর্ষ

১১

এবার মারা গেলেন পরীমণির প্রথম সিনেমার পরিচালক

১২

বিএনপিতে অনুপ্রবেশকারীর ঠাঁই হবে না : আমিনুল হক 

১৩

‘আ.লীগ ভিন্ন রাষ্ট্রের আদেশ বাস্তবায়নে ক্ষমতা দখলে রেখেছিল’

১৪

ঢাবির ইসলামের ইতিহাস বিভাগে মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তির সুযোগ

১৫

কওমি সনদকে কার্যকরী করতে ছাত্রদল ভূমিকা রাখবে : নাছির উদ্দীন 

১৬

তিনবারের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আজাদ গ্রেপ্তার

১৭

শিল্পকলায় প্রদর্শিত হলো সার্কাস

১৮

৮ দফা অবিলম্বে বাস্তবায়ন দাবি ঐক্য পরিষদের

১৯

পুলিশ পরিচয়ে দখলবাণিজ্য এসপি শামীমা ইয়াসমিনের

২০
X