মোস্তফা কামাল
প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০২৪, ০২:২১ এএম
আপডেট : ১৩ জুলাই ২০২৪, ০৯:০৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

গেম চেঞ্জিংয়ে হাসিনার চীন মোদির রাশিয়া

গেম চেঞ্জিংয়ে হাসিনার চীন মোদির রাশিয়া

একই সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর চীন এবং রাশিয়া সফর। শেখ হাসিনা রাজকীয় সফর সারলেন চীনে। আর নরেন্দ্র মোদি রাশিয়ায়। বিশ্বময় চলমান শীতল বা স্নায়ুযুদ্ধের বিশেষ সন্ধিক্ষণে তাদের যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী দুটি দেশ সফর। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে মোদির বৈঠকের উদ্দেশ্য হিসেবে জানানো হয়েছে—দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারসহ স্থিতিশীল অঞ্চল প্রতিষ্ঠা। সফরে যাওয়ার আগেই বিবৃতিতে মোদি বলেছেন, পুতিনের সঙ্গে তিনি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সব দিক পর্যালোচনা করতে চান। সফরের পর বলা হয়েছে, তারা শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় যৌথ ভূমিকা রাখবেন বলে পাকা কথা হয়েছে। মোদি তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতা নেওয়ার পর প্রথম বিদেশ সফরে গেলেন রাশিয়ায়। এমনকি ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত শুরু হওয়ার পর এটি মোদির প্রথম মস্কো সফর। অন্যদিকে, টানা চতুর্থ দফায় ক্ষমতায় বসে দিল্লিতে এক মাসে দুবার সফরের পর চীন গেলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাশিয়ায় পৌঁছে ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তার বাসভবনে দীর্ঘক্ষণ সময় কাটান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। হালকা চালে অনেক বিষয়ে দুই নেতার মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়। তাদের এ হৃদ্যতা কষ্ট দিয়েছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে। একই সময়ে ১৯৬ জন সফরসঙ্গী নিয়ে চীনের বেইজিংয়ে অবস্থান করছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দক্ষিণ এশিয়ার দুটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের সরকারপ্রধানরা যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী দুটি দেশ সফর নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ চলছে। মোদির সফর নিয়ে একটি বিবৃতি জারি করে রাশিয়া বলেছে, পশ্চিমের দেশগুলো তার সফরকে ‘ঈর্ষার চোখে’ দেখছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরকে ‘খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং পরিপূর্ণ সফর’ বলে বর্ণনা করেছে রাশিয়া। আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সফরকে গেম চেঞ্জিং বলে অভিহিত করেছে চীন।

সফরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিংপিং এবং প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে বৈঠক ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পার্শ্ববৈঠক হয়েছে। শেখ হাসিনার চীন এবং মোদির রাশিয়া সফরে ‘কৌশলগত অংশীদারত্ব’ থেকে ‘কৌশলগত বিস্তৃত সহযোগিতার অংশীদারত্বে’ উন্নীত করার মন্ত্রে ভরা। মস্কো ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করার পর থেকে তার দীর্ঘদিনের মিত্রদের মধ্যে সম্পর্ককে জটিল করে তুলেছে। রাশিয়াকে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের কাছাকাছি ঠেলে দিয়েছে। মোদি শেষবার ২০১৯ সালে রাশিয়ায় ভ্লাদিভোস্টকে এ ধরনের বৈঠক করেছিলেন পুতিনের সঙ্গে। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের দৃঢ়তা ১৯৪৮ সালে গত স্নায়ুযুদ্ধ শুরু থেকেই। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ক্রেমলিন ইউক্রেনে সৈন্য পাঠানোর পর থেকে মস্কোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে ভারতের গুরুত্ব আরও বাড়তে থাকে। চীন ও ভারত রাশিয়া হয়ে ওঠে তেলের প্রধান ক্রেতা। মোদির কূটনীতিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের নিন্দা এড়িয়ে গেছে ভারত। মোদির সফর নিয়ে রাশিয়ার জারি করা বিশেষ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পশ্চিমের দেশগুলো তার সফর ‘ঈর্ষার চোখে’ দেখছে।

অন্যদিকে, কমিউনিস্ট পার্টির গণপ্রজাতন্ত্রী চীন ঘোষণার পরের বছরগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়ে ওঠে। মস্কো হাজার হাজার সোভিয়েত প্রকৌশলী ও কর্মী পাঠায় চীনে। ট্রেনভর্তি করে যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম পাঠাতে থাকে রাশিয়া। পাঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে, সোভিয়েত ইউনিয়ন চীনজুড়ে আধুনিক শিল্পকারখানার একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করে ফেলে, যা যুদ্ধবিমান, ট্যাঙ্ক এবং যুদ্ধজাহাজ তৈরি করতে সক্ষমতা এনে দেয়। মস্কো এমনকি কিছু পারমাণবিক প্রযুক্তিও প্রদান করে।

একসময় এ সম্পর্কে কিছুটা ফাটল ধরে। লেনিন ও স্ট্যালিন আদর্শের দ্বন্দ্বে পাঞ্চাশের দশকের শেষ এবং ষাটের দশকের শুরুতে দেশ দুটির সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে। তা চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৬৯ সালে চীন-সোভিয়েত সীমান্ত লড়াইয়ে। তা আবার সময়ে সময়ে উভয়ের প্রয়োজনে উতরে যায়। চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের মধ্যেও এমন হেরফের হয়েছে সময়ে সময়ে। ১৯৭১ সালে হেনরি কিসিঞ্জারের পরামর্শে যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে, যার চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চাঞ্চল্যকর চীন সফরের মধ্য দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের যৌথ প্রচেষ্টায় ১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয় এবং ইউনিয়ন ভেঙে অনেক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। আর ক্রমেই একক বিশ্বের নেতা হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্র। নতুন স্নায়ুযুদ্ধে চীন-মার্কিন আবার প্রতিপক্ষ। সেটাও অর্থনৈতিক কারণে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে টেকনোলজি নিয়ে নিজের মতো করে নিজেকে গড়ে তোলে এবং ২০১৭ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি চলে আসে চীন।

বাংলাদেশ উভয়ের কাছে ভূরাজনৈতিক কারণে দামি। যারপরনাই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী ভারতের কাছেও। চার চোখের এই চাহনিতে বাংলাদেশের সুবিধা-অসুবিধা দুটোই হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অতিকূটনীতিতে সবাইকে আয়ত্ত করছেন। পারলে মাঝেমধ্যে ভিন্ন উচ্চতা ও ক্যাইরশশাও দেখাচ্ছেন। খাস বাংলায় একে কেউ কেউ টেক্কাও বলেন।

দুই নৌকায় পা দিতে বলে একটি সবক থাকলেও বাংলাদেশের একটি বাড়তি সুবিধা আছে। কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের স্লোগানে দুই নৌকা নয়, বহু নৌকায় পা দেওয়ার কূটনীতি বাংলাদেশের অনেক দিনের চর্চা। এ চর্চায় বিশ্বের সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবিলার দৃষ্টান্ত রেখে চলছে বাংলাদেশ। বিষয়টি শেখ হাসিনার জন্য সাহসের, আবার এক ধরনের আশীর্বাদও।

ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে আলাদা আলোচনায় একান্ত কথাবার্তা ও কয়েকটি সমঝোতা তার প্রাপ্তির ফর্দ বেড়েছে। স্বাভাবিকভাবে এদিকটায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পশ্চিমা বলয়ের দেশগুলোর। লাল চাহনিও। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটি বাণিজ্যিক। আর ভারতের সঙ্গে আত্মা ও ঐতিহ্যের। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে তৈরি হওয়া রক্তের সম্পর্ক দিনে দিনে ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছেছে গত ১৭-১৮ বছরে। যে কারণে চীন ও ভারতের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে বিরোধ থাকলেও বাংলাদেশ উভয়ের সঙ্গে মিতালি রাখছে।

মস্কো ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করার পর থেকে তার দীর্ঘদিনের মিত্রদের মধ্যে সম্পর্ক জটিল করে তুলেছে এবং রাশিয়াকে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের কাছাকাছি ঠেলে দিয়েছে। গত স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হওয়ার (১৯৪৮) সময় থেকেই ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ক্রেমলিন ইউক্রেনে সৈন্য পাঠানোর পর থেকে মস্কোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে নয়াদিল্লির গুরুত্ব বেড়েছে। চীন ও ভারত রাশিয়ার তেলের প্রধান ক্রেতা হয়ে উঠেছে। মোদির নেতৃত্বে ভারত একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের নিন্দা করা এড়িয়ে গেছে। রাশিয়া প্রধানমন্ত্রী মোদির সফর নিয়ে একটি বিবৃতি জারি করে বলেছে, পশ্চিমের দেশগুলো তার সফর ‘ঈর্ষার চোখে’ দেখছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফর ‘খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং পরিপূর্ণ সফর’ বলে বর্ণনা করেছে রাশিয়া। চীন ও রাশিয়ার সম্পর্কও ঐতিহাসিক। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক গণপ্রজাতন্ত্রী চীন ঘোষণার পরের বছরগুলোতে, সোভিয়েত ইউনিয়ন তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়ে ওঠে। মস্কো হাজার হাজার সোভিয়েত প্রকৌশলী ও কর্মী পাঠায় চীনে। ট্রেনভর্তি করে যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম পাঠাতে থাকে রাশিয়া।

১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সোভিয়েতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভারত কালবিলম্ব না করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিত্রতা তৈরি করে। এখন আবার নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সময় ভারত রাশিয়ার দিকে ঝুঁকেছে। বিগত স্নায়ুযুদ্ধের সময় রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে ভেঙে এবং পরে ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গাঁটছড়া সম্পর্ক বেঁধে ভারত আঞ্চলিক নেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখেছে। বর্তমান স্নায়ুযুদ্ধের সময় দেশ দুটি এ সম্পর্ক চালিয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি নিঃসন্দেহে সন্দেহের বাইরে রাখবে না। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী দেশ দুটিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং ভারতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর অবশ্যই মোটাদাগের ঘটনা।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সরাইলে বিএনপির নতুন কমিটি বাতিলের দাবিতে ঝাড়ু মিছিল

মানিকগঞ্জে নিজ বাড়িতে নারীকে গলা কেটে হত্যা 

ভৈরবে আ.লীগ কার্যালয় থেকে যুবকের মরদেহ উদ্ধার

আন্দোলন-ধর্মঘটে ‘কার্যত অচল’ রাবি, ব্যাহত শিক্ষার পরিবেশ

রাজবাড়ীতে জমি বন্ধক নিয়ে গাঁজা চাষ, চাষি আটক

টিউলিপের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ তদন্ত প্রতিবেদনে যা ছিল

নারী উদ্যোক্তা তনির স্বামী মারা গেছেন

ভারত থেকে এলো ২৪৫০ টন চাল

নারায়ণগঞ্জে আগুনে পুড়ল দুই কারখানা

উপসচিব বিতর্ক এবং আন্তঃক্যাডার বৈষম্যের বাস্তবতা 

১০

কিশোরগঞ্জে হাসপাতালে ভুল ইনজেকশনে ২ রোগীর মৃত্যু

১১

আবারও আসছে শৈত্যপ্রবাহ

১২

দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে শক্তিশালী মালদ্বীপের পাসপোর্ট

১৩

কুয়াশা ও তাপমাত্রা নিয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের নতুন বার্তা

১৪

দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন দাবানলকে ভয়াবহ করছে আরও

১৫

ধুম ৪-এ রণবীর

১৬

আমি কারাগারে বৈষম্যের শিকার : পলক

১৭

পয়েন্ট হারানোর পর গোলকিপারের ওপর ক্ষোভ ঝাড়লেন গার্দিওলা

১৮

লালমনিরহাটে পেট্রল পাম্প থেকে বাস চুরি

১৯

অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে কাজ করছে : আইজিপি

২০
X