একটি দেশে বসবাস করে নানা গোত্র-বর্ণ ও শ্রেণি-পেশার মানুষ। দেশের পরিচালকদের ভাবতে হয় সবার কথা। সবার অধিকারের বিষয় মাথায় রেখে প্রণয়ন করা হয় সার্বজনীন আইন। ইসলামও সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অধিকারের কথা বলে এবং পরিচালকদের নির্দেশ দেয় সবার প্রাপ্য অধিকার আদায় করতে। সম্প্রতি দেশে একটি আইন কেন্দ্র করে রাজপথে নেমে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে কয়েক বছর আগে সরকারের জারি করা একটি পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সারা দেশে চালিয়ে যাচ্ছেন ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি। দিনব্যাপী ও দেশব্যাপী আন্দোলন কর্মসূচিতে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকাসহ পুরো দেশ। ভোগান্তিতে পড়ছে সাধারণ মানুষ। বাসসহ অন্যান্য যানবাহন প্রধান সড়কগুলোয় আটকা পড়ছে। নগরজুড়ে দেখা দিচ্ছে তীব্র যানজট। অনেকে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দিচ্ছেন। এতে সবচেয়ে বিপদে পড়েন বয়স্ক মানুষ, শিশু ও নারীরা। তপ্ত রোদ মাথায় নিয়ে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয় তাদের। গাড়ির মধ্যে বসে হাঁসফাঁস করতে থাকে অনেক মানুষ। প্রচণ্ড গরমে গাড়িতে বসে বাচ্চারাও অসুস্থ হয়ে পড়ে। এসব নিয়ে বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যাত্রীদের কথাকাটাকাটিও হয়।
ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলামে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য ও জনদুর্ভোগ সৃষ্টি সর্বতোভাবে নিষিদ্ধ। কোনো মানুষকে যেন কখনো সামান্যতম কষ্ট ও দুর্ভোগের মুখে না পড়তে হয়, ইসলাম সেদিকে খেয়াল রেখেছে। রাজনীতি বা আন্দোলনের নামে সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ, জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা ইসলামের শিক্ষা নয়। পৃথিবীতে মানুষের একটি মৌলিক অধিকার জীবনের নিরাপত্তা। মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইসলামের অন্যতম নির্দেশনা। ‘ইসলাম’ অর্থ আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে তার আদেশ-নিষেধ মেনে চলার মাধ্যমে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা অর্জন। ধর্মপ্রাণ মুসলমানের পরিচয় তুলে ধরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রকৃত মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার হাত ও মুখ থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ।’ (বোখারি ও মুসলিম)। তাই পৃথিবীতে সত্য ও ন্যায়নীতির বাস্তব প্রতিফলনের মাধ্যমে সমাজজীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বজায় রাখা ইসলামের দৃষ্টিতে অপরিহার্য কর্তব্য এবং ইমানি দায়িত্ব। সুতরাং মানবসমাজে কোনোরকম নাশকতা, অশান্তি সৃষ্টি, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, সংঘাত, হানাহানি, উগ্রতা, বর্বরতা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ইসলামে নিষিদ্ধ।
আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘দুনিয়ায় শান্তি স্থাপনের পর এতে বিপর্যয় ঘটাবে না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৫৬)। রাজনৈতিক অনৈক্য ও অস্থিরতার সুযোগে একদল দুষ্কৃতকারী সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। নানা প্রকার জনদুর্ভোগ, নিরাপত্তাহীনতা, নাশকতা, নৃশংসতা ও সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে চলছে। এতে যেমন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম ব্যাঘাত হচ্ছে, তেমনি সামাজিক কর্মকাণ্ডে জননিরাপত্তার ব্যাঘাত ঘটছে। যেসব বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী দুর্বৃত্ত বিভিন্ন স্থানে নানা পর্যায়ে সন্ত্রাস, বোমাবাজি, গুপ্তহত্যা ও প্রকাশ্য দিবালোকে নরহত্যা, অপহরণ, হামলাসহ ধর্মবিরোধী, মানবতাবিবর্জিত ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে, বাস্তবিকই তারা ইসলামের মর্মবাণীর সঙ্গে সম্পর্কহীন। নিরপরাধ জনগণকে গুলি করে, বোমা মেরে বা যাত্রীবাহী বাসে অগ্নিসংযোগে হত্যা করা, পুড়িয়ে মারা বা প্রাণহানি ঘটানো ইসলামের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
অন্যায়ভাবে কাউকে কষ্ট দেওয়া, দুর্ভোগে ফেলা গুনাহের কাজ। নবীজি (সা.) এ ব্যাপারে তার উম্মতকে সতর্ক করেছেন। বিশেষ করে রাস্তাঘাটে, বাজারে কিংবা যেসব জায়গায় জনসমাগম ঘটে, এসব জায়গায় এমন কোনো কাজ না করা উচিত, যা জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে বহু মানুষকে কষ্টে ফেলবে। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আবু মুসা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, তোমাদের কেউ যদি তীর সঙ্গে নিয়ে আমাদের মসজিদে কিংবা বাজারে যায়, তাহলে সে যেন তীরের ফলাগুলো ধরে রাখে কিংবা তিনি বলেছিলেন, তাহলে সে যেন তা মুষ্টিবদ্ধ করে রাখে, যাতে সে তীর কোনো মুসলিমের গায়ে না লাগে (বোখারি, হাদিস: ৭০৭৫)।
এই হাদিসের মধ্যে নবীজি (সা.) এমন সব জায়গায় সতর্ক থাকার কথা বলেছেন, যেগুলোতে সাধারণত জনসমাগম বেশি হয়। মসজিদ, বাজার এ দুটোই জনসমাগমের জায়গা, যেখানে তীর খোলা রাখলে মানুষের কষ্ট হবে বিধায় তিনি এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামকে সতর্ক করেছেন। বোঝা গেল যেখানে অনেক জনসমাগম হয়, সেখানে এমন কিছু করা ঠিক নয়, যা মানুষের কষ্টের কারণ হবে। যে কাজটি করেছে, সে বহু মানুষের অভিশাপে অভিশপ্ত হবে, যা তার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। যারা সমাজে অস্থিরতা তৈরি করে দেশ ও জাতির ক্ষতি করতে চায়, শেষ পর্যন্ত তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহর সঙ্গে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন, তা ছিন্ন করে এবং দুনিয়ায় অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।’ (সুরা বাকারা: ২৭)। এসব মানুষ ব্যক্তিজীবনেও মানুষের অভিশাপ বয়ে বেড়ায়। পরকালেও কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে। পবিত্র কোরআনে এসব কাজে লিপ্ত ব্যক্তিকে মুনাফিক বা কপট হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যখন তাদের বলা হয়, পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করো না, তারা বলে আমরাই তো শান্তি স্থাপনকারী। সাবধান! তারাই অশান্তি সৃষ্টিকারী। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না।’ (সুরা বাকারা: ১১-১২)।
মানুষের চলাচলের রাস্তা সচল ও পরিষ্কার রাখা ইমানের অন্যতম একটি শাখা। রাস্তা বন্ধ করা, রাস্তায় নির্মাণসামগ্রী বা অন্য কিছু রেখে চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা অথবা ময়লা-আবর্জনা, ফলের খোসা, উচ্ছিষ্ট খাবার, পানের পিক, দুর্গন্ধ ছড়ায় এমন কোনো জিনিস ফেলাও কোনোভাবেই ইমানদারের কাজ নয়। বরং ইমানের দাবি হলো—রাস্তা চলাচলের জন্য উন্মুক্ত ও অবারিত রাখা। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ইমানের সত্তরের অধিক শাখা আছে। সর্বোত্তম শাখা হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা। আর সর্বনিম্ন শাখা হলো রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে ফেলা। (মুসলিম, হাদিস: ১৬২)। রাস্তা মানুষের নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য নির্মিত হয়। কাজেই রাস্তা অবরোধ করে বা বন্ধ করে বা দখল করে পথচারীদের কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে হয় না। রাসুলুল্লাহ (সা.) রাস্তার অধিকার আদায় করে রাস্তা ব্যবহারের কথা বলেছেন। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা রাস্তায় বোসো না।’ সাহাবিরা বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের তো এর প্রয়োজন হয়। পরস্পরে প্রয়োজনীয় কথা বলতে হয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘বসতেই হলে রাস্তার হক আদায় করে বসো।’ সাহাবিরা বললেন, আল্লাহর রাসুল! রাস্তার হক কী? রাসুল (সা.) বললেন, রাস্তার হক হলো—১. দৃষ্টিকে অবনত রাখা, ২. কাউকে কষ্ট না দেওয়া, ৩. সালামের জবাব দেওয়া, ৪. সৎ কাজের আদেশ করা এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখা। (বোখারি, হাদিস: ৬২২৯)। অন্যান্য বর্ণনায় আরও আছে। যেমন—৫. পথহারাকে পথ দেখিয়ে দেওয়া, ৬. মজলুম ও বিপদগ্রস্তের সাহায্য করা, ৭. বোঝা বহনকারীকে সহযোগিতা করা, ৮. ভালো কথা বলা এবং ৯. হাঁচির জবাব দেওয়া। (আবু দাউদ, হাদিস: ৪৮১৯; মুসনাদে বাজ্জার, হাদিস: ৫২৩২; মুসলিম, হাদিস: ২১৬১; মুসনাদে আবি ইয়ালা, হাদিস: ৬৬০৩)। এ ছাড়া পবিত্র কোরআনে আছে—১০. দম্ভভরে না চলা, অর্থাৎ বিনয় অবলম্বন করে পথ চলা। (সুরা: বনি ইসরাইল, আয়াত: ৩৭)।
জনমানুষের কল্যাণ ও শান্তির বার্তা নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছে ইসলাম। সব ধরনের জনদুর্ভোগের বিপরীতে ইসলামের অবস্থান। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবীতে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের জন্য মানুষের জন্মগত বাসনা, তার উত্তত অনুশীলনই ইসলামের নির্দেশনা। কোনো মানুষের যেন সামান্যতম কষ্ট ও দুর্ভোগের মুখে না পড়তে হয়, ইসলাম সেদিকে খেয়াল রেখেছে। সব ধরনের অন্যায় হত্যাকাণ্ড নিষিদ্ধ করেছে। রাজনীতি বা আন্দোলনের নামে সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ, জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা ইসলামের শিক্ষা নয়। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম ইসলামিক স্কলার ওআইসির ফিকহ একাডেমির সদস্য মুফতি তাকি উসমানি প্রচলিত রাজনৈতিক আন্দোলন সম্পর্কে বলেছেন, ‘প্রচলিত আন্দোলনে যদি জনগণের কোনো ক্ষতি ও অসুবিধা না হয়, তাহলে তা বৈধ। কিন্তু ব্যাপকভাবে এগুলোর মধ্যেও ভাঙচুরের, ত্রাস সৃষ্টি, জীবিকা উপার্জনে বাধা দেওয়া, স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করা, হত্যা ও জনজীবনে বাধাবিঘ্ন সৃষ্টি করা আজকাল অত্যাবশ্যক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আর এ কথা স্পষ্ট যে, এ দিকটিকে জায়েজ বলার অবকাশ নেই।’ (ইসলাম আওর সিয়াসি নজরিয়াত)।
পৃথিবীতে মানুষের একটি মৌলিক অধিকার জীবনের নিরাপত্তা। মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইসলামের অন্যতম নির্দেশনা। ‘ইসলাম’ অর্থ আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে তার আদেশ-নিষেধ মেনে চলার মাধ্যমে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা অর্জন। ধর্মপ্রাণ মুসলমানের পরিচয় তুলে ধরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রকৃত মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার হাত ও মুখ থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ।’ (বোখারি ও মুসলিম)। তাই পৃথিবীতে সত্য ও ন্যায়নীতির বাস্তব প্রতিফলনের মাধ্যমে সমাজজীবনে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বজায় রাখা ইসলামের দৃষ্টিতে অপরিহার্য কর্তব্য এবং ইমানি দায়িত্ব। সুতরাং মানবসমাজে কোনোরকম নাশকতা, অশান্তি সৃষ্টি, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, সংঘাত, হানাহানি, উগ্রতা, বর্বরতা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ইসলামে নিষিদ্ধ। আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘দুনিয়ায় শান্তি স্থাপনের পর এতে বিপর্যয় ঘটাবে না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৫৬)।
পরিবারে যেমন বাবা-ছেলের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়, তেমনি দেশের অভিভাবক ও নাগরিকদের মধ্যেও দেখা দিতে পারে মতানৈক্য। মানুষের অধিকার আছে নিজের মতামত ব্যক্ত করার। শিক্ষার্থীরাও কোনো আইন সংশোধনযোগ্য মনে করলে তা ব্যক্ত করতে পারেন। তবে যেখানে আইন প্রণীত হয়, যারা আইনের দায়িত্বে নিয়োজিত, তাদের দ্বারস্থ হতে পারে ছাত্রসমাজ। কিন্তু এর জন্য সাধারণ জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলা কাম্য নয়। ঘর থেকে কেউ আরাম করতে বের হয় না। অসুস্থ হলে হাসপাতালে, জীবিকার তাগিদে কর্মক্ষেত্রে ছুটে যায় মানুষ। তাই সাধারণ মানুষের সুবিধার দিকে লক্ষ করা সবার কর্তব্য।
লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ