২০২০ সালে হঠাৎ মানুষ চমকে উঠেছিল এক খবরে। বড় বড় কর্মকর্তার দুর্নীতির খবরে নয়, মানুষ ভিমড়ি খেয়েছিল এক গাড়িচালকের সম্পদের বিবরণ দেখে। সে সময় পত্রিকায় খবর বের হয় যে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক আবদুল মালেকের রয়েছে শত শত কোটি টাকার সম্পদ। ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে আছে একাধিক বাড়ি। রয়েছে গাড়িও। তার পরিবারের সদস্যদের তিনি অধিদপ্তরের নানা পদে ঢুকিয়েছেন, যাদের চাকরি দিতে পারেননি, তাদের ব্যবসা জোগাড় করে দিয়েছেন অধিদপ্তরের ভেতরেই।
এখন আরেক গাড়ি চালকের সন্ধান পাওয়া গেল। তার নাম সৈয়দ আবেদ আলী জীবন। তিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক। পিএসসির অধীনে যত পরীক্ষা হয়, সেগুলোর প্রশ্নপত্র ফাঁস করে তিনি আজ হাজার কোটি টাকার মালিক। হয়েছেন বড় ব্যবসায়ী, রিসোর্টের মালিক এবং দানবীর উপাধি নিয়ে শুরু করেছেন রাজনীতি। পুলিশ পিএসসির উপপরিচালক মো. আবু জাফর, উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক এস এম আলমগীর কবির, সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায়, অফিস সহায়ক খলিলুর রহমানসহ আবেদ আলীকে গ্রেপ্তার করেছে। পিএসসির কোনো নিয়োগ পরীক্ষা এলেই প্রশ্ন ফাঁস করে অর্থ লোপাটে মেতে উঠত সংঘবদ্ধ চক্রটি।
মালেক কিংবা আবেদ আলী আসলে নিছক গাড়িচালক নন। তারা একটা বিরাট দুর্নীতি মাফিয়া গ্রুপের সদস্য। এরকম মাফিয়া সরকারি প্রায় সব অফিসে আছে এবং তারা অতি নিম্ন পদে কাজ করে বিত্তবান হন ওপরস্তরের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে।
সংবাদমাধ্যমে খবর আসায় আবেদ আলীর চক্রটি এখন গ্রেপ্তার হয়েছে। কিন্তু এরকম কত কত মালেক আর আবেদ আলীকে চিহ্নিত করা সম্ভব হবে? বেনজীর, মতিউরসহ সাম্প্রতিক বড় দুর্নীতিগুলোর পর পিএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রমাণ করল সরকারি কোনো অফিস আর বাকি নেই, কোনো সিস্টেমই আর বাদ থাকছে না।
দুর্নীতি কখনো দু-একজনের সংযোগে ঘটে না। একটা বিশাল চক্র কাজ করে। তার শিকড় অনেক গভীরে। এ চক্র সমূলে উপড়ে ফেলার সাধ্য কি শুধু সিআইডি দিয়ে গ্রেপ্তার করিয়ে? খোদ পুলিশের ভেতরেই তো দুর্নীতির মহাবিস্তার ঘটেছে। জনগণকে কিছুটা ঠান্ডা করার জন্য মাঝেমধ্যে কেঁচো ধরার মতোই দুর্নীতিবাজদের ধরা হচ্ছে দেশে।
আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কথায় কথায় বলেন আইনের শাসন। কিন্তু এ দেশে আইন শুধু আইনের পথেই চলে না, প্রভাবশালীর অঙ্গুলি হেলনেও চলে। তাই এমন ব্যবস্থায় আইন সবার জন্য সমান নয়। যারা জনগণের কয়েক লাখ কোটি টাকা পুঁজি বাজার থেকে, ব্যাংক থেকে মেরে দিল, তাদের শাস্তি হলো না। বরং তাদের অনেকে এখন ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরের মানুষ। সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতেও আমরা দেখলাম ক্ষমতাধররা কত সুবিধা পায়। জনগণের টাকা মেরে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলেন প্রভাবশালী বেনজীর। এর আগে চলে গেছেন পি কে হালদার। এখনো গ্রেপ্তার হননি মতিউর। একক ব্যক্তির দখলে চলে গেছে অনেক ব্যাংক। অনেক ব্যাংক মালিক বিশাল অঙ্কের টাকা মেরে একের পর এক ব্যাংক আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে লোপাট করেছেন।
তাই দুর্নীতিবিরোধী এখনকার চিত্র দেখে আশান্বিত হওয়ার কিছু আছে বলে ধারণা করার কিছু নেই। যে ব্যবস্থা দুর্নীতির ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেটা শুধু কিছু সম্পদ জব্দ করা, গ্রেপ্তার করার মাধ্যমে নিরসন করা যাবে না। সরকারি কর্মচারীদের প্রশাসনিক অন্যায়, অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করার উপায় কী, সেটা বড় করে ভাবা জরুরি হয়ে পড়েছে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকদের স্বার্থরক্ষার অন্যতম মাধ্যম হলো জনপ্রশাসন; সহজ কথায় সরকারি প্রশাসন। তত্ত্বগতভাবে জনপ্রশাসনের অন্যতম দুটি দিক হলো—সহায়ক যেখানে নাগরিকবৃন্দ প্রশাসনের সেবা সুবিধা ভোগকারী, আরেকটি দিক হলো অংশগ্রহণকারী যেখানে জনগণই চালিকাশক্তি। দুই দৃষ্টিভঙ্গিতেই জনসাধারণ প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বেশিরভাগ সরকারি কর্মী নিপীড়ক এবং তারা জনগণকে সেবা না দিয়ে তাদের কাছ থেকে ঘুষ খায়, অর্থ না দিলে জনগণকে হয়রানি করে। আর এভাবেই বাংলাদেশের জনপ্রশাসন জনগণের স্বার্থরক্ষার মাধ্যম না হয়ে হয়েছে দুর্নীতির বীজতলা। এই বীজতলায় কোনো ছোট-বড় নেই। বড় কর্মকর্তা যেমন আছেন, তেমনি আছেন গাড়িচালক, পিয়নের মতো নিচু স্তরের কর্মীও।
মানুষ এখন তাই বলাবলি করছে, যদি ড্রাইভারের এত সম্পত্তি থাকে তাহলে তারা যাদের গাড়ি চালান তাদের না জানি কত টাকা। অনেকেই বলছেন, ড্রাইভার কোন ক্ষমতাবলে কার প্রশ্রয়ে এত টাকার মালিক হলো সেটাও দেখা দরকার। দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ একবার বলেছিলেন, সব জায়গায় দুর্নীতির বিশাল নেটওয়ার্ক। সবাই মিলেই গড়ে তুলেছে সিন্ডিকেট। দুর্নীতির ভাগ পায় সবাই। ফলে এখন মন্ত্রণালয় কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
এই সমাজের এখন সামাজিক আত্মসমীক্ষণ ও বিশ্লেষণ জরুরি। দুর্নীতি সাধারণ মানুষের জীবনপ্রাণ ওষ্ঠাগত করে ফেলেছে। গত কয়েক বছরে চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট, ছাগলকাণ্ড, ব্যাংককাণ্ড, লিজিংকাণ্ড, বেনজীরকাণ্ড, টাকা পাচার—বহু ক্ষেত্রে ভয়ংকর দুর্নীতির উপর্যুপরি প্রমাণে দেশবাসী আজ বিধ্বস্ত ও অবসন্ন। নাগরিক সমাজে এ ধারণা বিশেষ গভীরভাবে জায়গা করে নিয়েছে, যে যায় প্রশাসনে সেই হয় রাবণ।
পিএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁসকাণ্ডে গ্রেপ্তারকৃত সৈয়দ আবেদ আলী চক্র সম্পর্কে সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, পিএসসির কোনো নিয়োগ পরীক্ষা এলেই এ চক্রের সদস্যরা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে অর্থ নিতেন। গত ৫ জুলাই (শুক্রবার) অনুষ্ঠিত রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন তারা। চক্রের সদস্যরা ওই পরীক্ষার আগের রাতে তাদের চুক্তি করা শিক্ষার্থীদের অজ্ঞাত স্থানে রেখে ওই প্রশ্নপত্র ও তার উত্তর দিয়ে দেন। বোঝা যায় কতটা সংগঠিত ছিল তারা।
কোটা আন্দোলন নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা যখন মাঠে সরব, ঠিক তখনই চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের একটি অনুসন্ধানে প্রতিবেদনে দেশবাসী জানতে পারল এই প্রশ্ন ফাঁস সম্পর্কে। শুধু রেলওয়ে নয়, পিএসসির অধীনে বিসিএসসহ অন্যান্য সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন এক যুগ ধরে নিয়মিতভাবে ফাঁস হয়ে আসছে।
প্রশ্ন হলো এর দায়টা কে নেবে? যে মেধাবী ছেলেমেয়েরা ফাঁসকৃত প্রশ্ন পায়নি, তাদের বঞ্চনার দায় কে নেবে? যারা চাকরিটি পেল, তাদের মধ্যে যারা ফাঁস হওয়া প্রশ্নের মাধ্যমে টিকেছে, চাকরিজীবনে তাদের অদক্ষতা আর অনিয়মের দায় কে নেবে? বিসিএসসহ অন্যান্য সরকারি চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে যারা চাকরি পান, তারা যোগ্য ও মেধাবী। এখন এ জায়গাটিই যদি কলুষিত হয়ে যায়, তাহলে তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যদি উচ্ছন্নে যায়, তার দায় কে নেবে? এখন তো আর কোনো বিশ্বাসই থাকছে না। ছেলেমেয়েরা চাকরির পরীক্ষা দিতে এসে ভাবছে কোথাও না কোথাও পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে।
বৃহত্তর সমাজে আজ হতাশা। এক-দুজন সৈয়দ আবেদ আলী বা মালেক ড্রাইভারই নয়, আছে অসংখ্য মাফিয়া। একটা ভয়াবহ অবস্থা চলছে। শাসনকাঠামোর নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভয়াবহ অনৈতিক, অন্যায় কাজে, দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে, তখন প্রবলভাবে সমাজের সর্বত্র বিরাজ করে অনৈতিকতার পরিবেশ।
বেনজীর, মতিউর, আবেদ আলীদের দেখে মানুষ বেশ বুঝতে পারছে যে, দুর্নীতির রূপ বদলেছে, মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্নীতিগ্ৰস্ত ও দুর্নীতিবাজদের সংখ্যাধিক্য ঘটছে প্রভাবশালীদের নৈকট্য অর্জন করার মাধ্যমে। আবেদ আলী দান করতেন, শাসক দলের রাজনীতির মাধ্যম উপজেলা চেয়ারম্যান হতে চেয়েছিলেন। দুর্নীতিগ্ৰস্তরা এভাবেই একদিকে যেমন স্থানীয় প্রশাসন ও নেতাদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে, আবার দুর্নীতির অর্থের কিছুটা অংশ জনস্বার্থে দান করেও সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের ভাষা বন্ধ করে দেয়।
পিএসসির ভেতরে আবেদ আলী চক্র বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরি করে কোটি কোটি টাকা মানুষের কাছ থেকে তুলতে সমর্থ হয়েছিল। এ নিয়োগ দুর্নীতির নেটওয়ার্ক সর্বগ্ৰাসী। ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হতে হবে—এই ভেবে ভালো মানুষরা এখন বোবা ও একক মানুষে পরিণত হয়েছেন। অন্যদিকে দুর্নীতিগ্ৰস্তরা সংগঠিত হয়েছে নানাভাবে। কে থামাবে এদের? কোনো ভরসা নেই। রাজনৈতিক নেতৃত্ব দুর্বল এবং প্রশ্রয়ী, তাই শুদ্ধিকরণের প্রচেষ্টা আরও দুর্বলতর।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, ঢাকা জার্নাল