প্রভাষ আমিন
প্রকাশ : ১০ জুলাই ২০২৪, ০২:৪৩ এএম
আপডেট : ১০ জুলাই ২০২৪, ০৮:৫৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কোটাবিরোধী আন্দোলন: আসল লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধ

কোটাবিরোধী আন্দোলন: আসল লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধ

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট কোটাব্যবস্থা পুনর্বহাল করেছেন। আপিল বিভাগও হাইকোর্টের আদেশ বহাল রেখেছেন। কিন্তু ছাত্ররা কোটাব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে আবার আন্দোলনে নেমেছেন। সে আন্দোলন ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিদিনই শিক্ষার্থীরা রাস্তা আটকে আন্দোলন করছেন। তাতে সাধারণ মানুষকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। আর কে না জানে, বাংলাদেশে যত বেশি মানুষকে আপনি জিম্মি করতে পারবেন, আপনার দাবি আদায়ের সম্ভাবনা তত উজ্জ্বল হবে। কোটার বিরুদ্ধে যারা আন্দোলন করছে, তাদের আন্দোলন করার পূর্ণ অধিকার আছে। কিন্তু দিনের পর দিন রাস্তা আটকে মানুষকে জিম্মি করার অধিকার কারও নেই। কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে সরকারও একটু বেকায়দায় আছে। এটা রাজনৈতিক আন্দোলন হলে সরকার পাঁচ মিনিটের মধ্যে খালি করে ফেলতে পারত। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন গায়ের জোরে দমন করা সম্ভব নয়। অতীতে শক্তি দিয়ে কোটা আন্দোলন দমন করার চেষ্টা ভালো হয়নি। তার চেয়ে বড় কথা হলো, কোটা নিয়ে এখন সরকারের কিছু করার নেই। ২০১৮ সালে সরকার দাবি মেনে কোটা বাতিল করেছিল। কিন্তু এখন বিষয়টি সর্বোচ্চ আদালতের এখতিয়ার। এখন চাইলেও প্রধানমন্ত্রী বা অন্য কেউ কোটা বাতিল করতে পারবেন না। শিক্ষার্থীদের উচিত রাস্তায় আন্দোলন না করে আদালতে গিয়ে তাদের যুক্তি তুলে ধরা। আপিল বিভাগও কিন্তু বলেছেন, রাজপথের আন্দোলন দিয়ে আদালতের রায় বদলানো যাবে না। তাহলে আর দিনের পর দিন রাস্তা আটকে মানুষকে জিম্মি করা কেন?

কোটা থাকলে মেধাবীরা বঞ্চিত হয়—এই অতি সরলীকরণের মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নামানো হয়েছে। কোটা বনাম মেধা—এমন একটা সমীকরণে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে গোটা জাতিকে। মনে হতে পারে, কোটায় যারা চাকরি পান, তারা সবাই বুঝি অযোগ্য, অদক্ষ, অমেধাবী। বাস্তবতা মোটেই তা নয়। কোটার প্রয়োগ হয়, নিয়োগের শেষ ধাপে। তার আগে আবেদন থেকে শুরু করে প্রিলিমিনারি, লিখিত পরীক্ষায় সবাইকে একসঙ্গেই এগোতে হয়। আবেদন করার যোগ্যতা সবারই সমান। এখানে কোনো কোটা নেই।

তবে কোটাবিরোধী আন্দোলন মূল লক্ষ্য হলো মুক্তিযুদ্ধ। আমার আপত্তিটাও সেখানেই। বিশ্বের আরও অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও কোটা আছে। সেটা শুরু হয়েছে স্বাধীনতার পরপরই। বঙ্গবন্ধুর আমলে কোটা ছিল, জিয়ার আমলে ছিল, এরশাদের আমলে ছিল, খালেদা জিয়ার আমলে ছিল। আগে কিন্তু কোনো আন্দোলন হয়নি। কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে ২০১৩ সালে। টাইমিংটা খেয়াল করুন। ২০১৩ সালে শাহবাগে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল। সেই গণজাগরণের একটা পাল্টা ন্যারেটিভ দরকার ছিল স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির। স্বাধীন বাংলাদেশে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতার বিপক্ষে বলা শোভনীয় নয়। তাই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ভিন্ন কৌশল নেয়। তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বঞ্চনার ক্ষোভ সঞ্চারিত করে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের চাকরি নিয়ে নিচ্ছে, এই সরল হিসাবে তাদের সংক্ষুব্ধ করে তোলে। তারপর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের গণজাগরণের পাল্টা হিসেবে কোটাবিরোধী গণজাগরণ সৃষ্টি করে।

বিষয়টা বুঝতে হলে আরেকটু পেছনে যেতে হবে। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্র শুরু হয়। গর্তে লুকিয়ে থাকা স্বাধীনতাবিরোধীরা আবার মাঠে নামে। রাজাকার শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী বানান জিয়াউর রহমান। পরে খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ কখনোই স্বাধীনতাবিরোধীদের ছাড় দেয়নি। ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে দেশজুড়ে অভূতপূর্ব গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল। তখনকার সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেনি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেয়। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ বিচারের দাবিতে শাহবাগে সৃষ্টি গণজাগরণ। ৭৫-এর পর ২১ বছর বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধারা অবহেলিত ছিল। কোনো সুযোগ-সুবিধা পায়নি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে মুক্তিযোদ্ধাদের নানা সুযোগ-সুবিধা দেয়। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরিদের জন্য কোটাব্যবস্থা প্রচলন করে। সবদিক দিয়েই স্বাধীনতাবিরোধীরা কোণঠাসা হয়ে যায়। আর দেরিতে হলেও মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে পায় তাদের প্রাপ্য মর্যাদা। এটা স্বাধীনতাবিরোধীদের সহ্য হয়নি। তারা তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করে কোটার বিরুদ্ধে মাঠে নামায়।

যারা কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে, তাদের আবেগের সঙ্গে আমার দ্বিমত নেই। ১৮ কোটি মানুষের দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা অনেক। তারা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পেতে চাইবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র সবার পাশেই দাঁড়াবে। আদিবাসীরা চাকরি পাবে না, নারীরা চাকরি পাবে না, প্রতিবন্ধীরা চাকরি পাবে না, মুক্তিযোদ্ধার উত্তরসূরিরা চাকরি পাবে না; সব চাকরি আমাদের দিতে হবে; এ ভাবনাটাই স্বার্থপর।

তবে কোটাবিরোধী চলমান আন্দোলনের মূল লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধ। তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দেওয়া। মুক্তিযোদ্ধারা নিজের জীবনের মায়া না করে দেশের জন্য লড়েছেন, শহীদ হয়েছেন। যখন যুদ্ধ করেছেন, তখন নিশ্চয়ই তারা ভাবেননি, তাদের সন্তানরা কোটায় চাকরি পাবে। তারা ভাবেননি বলে আমরাও ভাবব না? আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, তাদের রক্তে আজকে আমরা স্বাধীন দেশে বসে কোটার বিপক্ষে আন্দোলন করতে পারছি। দেশ স্বাধীন না হলে এই শিক্ষার্থীদের পূর্ব পাকিস্তানের কোটার জন্য আন্দোলন করতে হতো। তাই এ দেশটার ওপর মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি একটু বেশিই থাকবে। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। কিন্তু তাদের অনেকেই ছিলেন কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমোর, গ্রামের সাধারণ মানুষ। তাদের অনেকই ছিলেন প্রথাগত অর্থে অশিক্ষিত। তাই স্বাধীনতার পর চাইলেও রাষ্ট্র তাদের সবাইকে চাকরি দিতে পারেনি। দেশ স্বাধীন করার মতো সাহস থাকলেও, সেই স্বাধীন দেশে কোনো চাকরি করার মতো যোগ্যতা তাদের ছিল না। পরে হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গুরুত্ব বুঝে নিজের সন্তানকে কষ্টেসৃষ্টে পড়াশোনা করিয়েছেন। এখন সেই সন্তানের পাশে রাষ্ট্র দাঁড়াবে না? অবশ্যই দাঁড়াবে। এটা তো বৈষম্য নয়, এটা ঋণ শোধ। মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট ভুয়া না আসল সেটা যাচাই করার দায়িত্ব পিএসসির বা রাষ্ট্রের। কিন্তু এই অজুহাতে মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করা যাবে না, তাদের বিপক্ষে রাজপথে স্লোগান দেওয়া যাবে না, তাদের কোটা বাতিলের দাবি করা যাবে না। অবশ্যই যাবে না। অবশ্যই আমার সন্তানের চেয়ে নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর সন্তান এই দেশে বাড়তি সুবিধা পাবে। যারা দেশের জন্য লড়েছেন, দেশের কাছে তাদের চাওয়ার কিছু না থাকতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রের উচিত সবসময় তাদের জন্য বাড়তি আসন রাখা।

আমি মনে করি, আস্তে আস্তে যদি এমন দিন আসে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি দেওয়ার মতো আর কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না, তখনো এ কোটা বহাল রাখতে হবে, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান জানানোর প্রতীক হিসেবে। কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে যখন রাজপথে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে স্লোগান ওঠে, তখন আমি বুঝি এ আন্দোলনের কলকাঠি অন্য কেউ নাড়ছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বিপক্ষে স্লোগান শুনে নিশ্চয়ই মুক্তিযোদ্ধারা কষ্ট পেয়েছেন।

২০১৩ সালের আন্দোলনের সময় বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু অভিমান করে তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের দাবি জানিয়ে বলেছিলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের যেন তরুণ প্রজন্মের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া না হয়।’ এটাই করা হচ্ছে সুকৌশলে। স্বাধীন বাংলাদেশের তরুণ যখন বুকে ‘আমি রাজাকার’ লিখে দাঁড়ায়, তখন বুঝি এই আন্দোলন কাদের শক্তিশালী করছে।

মুক্তিযোদ্ধার উত্তরসূরিদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা রাখা হলেও অনেক বছর ধরেই এ কোটা পূরণ করার মতো লোক পাওয়া যায় না। আর পাওয়া না গেলে তা সাধারণ আবেদনকারীদের মধ্য থেকে পূরণ করা হয়। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরিরা ৩০ ভাগ চাকরি নিয়ে নিচ্ছে, পরিসংখ্যানগতভাবেই এটা ঠিক নয়। এ আন্দোলন স্রেফ মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করার জন্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত করার জন্য। তাই যারা আন্দোলন করছেন, তাদের সতর্ক থাকতে হবে। আপনার মাথায় স্বাধীনতাবিরোধীরা যেন কাঁঠাল ভাঙতে না পারে। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধারা একটু বাড়তি সুবিধা পাবেন এটাই স্বাভাবিক, এটাই যৌক্তিক, এটাই ন্যায্য।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আজ টিভিতে যেসব খেলা দেখা যাবে

ছাত্রদল নেতাকে বেধড়ক পেটানোর অভিযোগ স্বেচ্ছাসেবক দল নেতার বিরুদ্ধে

লেবাননে এক দিনে নিহত ৫৯

টাইম জোনের ধারণা এসেছে যেভাবে

সরকারের চাপে বাধ্য হয়ে ওজন কমালেন ৫৪২ কেজি

উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশে নজর জিনপিংয়ের

‘উন্নয়নের নামে লুটপাট করেছে আ.লীগ সরকার’

২৩ নভেম্বর: ইতিহাসের আজকের এই দিনে

ঢাকার যেসব এলাকায় আজ মার্কেট বন্ধ

আজকের নামাজের সময়সূচি

১০

প্রথম দিনে উইন্ডিজ তুলল ২৫০ রান

১১

গাঁজা-জাল নোটসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

১২

ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের শীতবস্ত্র বিতরণ

১৩

উইন্ডিজের প্রতিরোধ ভেঙে বাংলাদেশের স্বস্তি

১৪

টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস / ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়িক অংশীদার চাই

১৫

২০২৪ সালের হাইয়েস্ট কালেকশন দরদের : শাকিব 

১৬

নায়িকা পরীমনির প্রথম স্বামী নিহত

১৭

রাজনীতিতে আ.লীগের পুনর্বাসন ঠেকাতে হবে: নুর

১৮

নির্বাচন যত দ্রুত হবে, সমস্যা তত কমে আসবে : মির্জা ফখরুল

১৯

খাসজমির দখল নিয়ে সংঘর্ষে দুজন নিহত

২০
X