মো. জাফর আলী (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি)
প্রকাশ : ০৮ জুলাই ২০২৪, ০২:৫৪ এএম
আপডেট : ০৮ জুলাই ২০২৪, ০৭:৪৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সাক্ষাৎকারে ভিপি নুর

কোটার মাধ্যমে অযোগ্য আমলাতন্ত্র তৈরির চিন্তা

কোটার মাধ্যমে অযোগ্য আমলাতন্ত্র তৈরির চিন্তা

বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোটা সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা উচিত। ২০১৮ সালে কোটা নিয়ে যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেই কমিটি কোটা বাতিলের সুপারিশ করে। তাদের মতেই তো কোটা রাখার যৌক্তিকতা নেই। যেখানে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন সংসদে দাঁড়িয়ে যে, কোটা থাকবে না। এখন বিশিষ্টজনের মতামত নিয়ে যদি সরকার মনে করে কিছু জায়গায় রাখা দরকার, সেটা করা যেতে পারে।

২০১৮ সালে কোটাবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসেন সেই সময় বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নুর। ওই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি চাকরির নবম থেকে ত্রয়োদশ গ্রেড পর্যন্ত নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা বাতিল করা হয়। পরের বছর অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে তিনি ভিপি পদে জয়লাভ করেন। তিনিসহ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সংগঠকদের উদ্যোগেই পরবর্তী সময় গণঅধিকার পরিষদ নামের রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। ‘ভিপি নুর’ নামে পরিচিত সাবেক এই ছাত্রনেতা এখন দলটির সভাপতি। গত ৫ জুন হাইকোর্ট কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। এর প্রতিক্রিয়ায় সেদিন থেকেই আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষার্থীদের একাংশ। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে পালিত হচ্ছে লাগাতার কর্মসূচি। চাকরিতে কোটা প্রথার বিরুদ্ধে নতুন করে আন্দোলন গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন ২০১৮ সালের আন্দোলনের অন্যতম নেতা ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মো. জাফর আলী

কালবেলা: আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে জারি হওয়া পরিপত্র নিয়ে আপনারা কি সন্তুষ্ট ছিলেন?

ভিপি নুর: ২০১৮ সালে ছাত্র সমাজের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সংঘটিত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন যে, সরকারি চাকরিতে কোনো কোটাই থাকবে না। আমরা সেই বক্তব্য ও সিদ্ধান্তকে স্বাগতও জানিয়েছিলাম। পরে সরকার কোটার বাস্তবতা বিবেচনা করার জন্য জনপ্রশাসন সচিবের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছিল। তাদের প্রতিবেদনে সুপারিশ করেছিলেন যে, সামাজিক ও আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প বা উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কোনো চাকরিতে কোটা থাকা উচিত নয়। সেদিক বিবেচনায় আমরা ভেবেছিলাম, প্রধানমন্ত্রীর কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তই বহাল থাকবে। পরে সেটা না হয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর দফায় দফায় হামলা করা হয়েছে। তখন আমরা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়ার কারণে ২০১৮ সালের পরিপত্রের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ভেবেছিলাম যে, যতটুকু হয়েছে ততটুকুই থাকুক, পরবর্তী সময় আবার যৌক্তিকভাবে উত্থাপন করা গেলে করা হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সেই আগের পরিপত্রটাও বাতিল করা হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে, চলমান রাজনীতিকে আড়াল করা কিংবা কোনো রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার জন্যই বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে।

কালবেলা: ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিল করে উচ্চ আদালতের দেওয়া রায়ের বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?

ভিপি নুর: কোটা সংস্কারের জন্য আমরা যারা ২০১৮ সালে আন্দোলন করেছিলাম তারা সবাই আদালতের এই রায়কে প্রত্যাখ্যান করি। নানা বাস্তবতায় কোটা বাতিল হওয়ার সিদ্ধান্ত প্রাসঙ্গিক ছিল। রাষ্ট্রের পরিচালনাকারী নির্বাহী বিভাগ যদি মনে করে যে, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে একটু সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এগিয়ে নেবে, তাহলে বাস্তবতার নিরিখে তারা যে কোনো একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সেই নির্বাহী বিভাগের আদেশকে ভ্রুক্ষেপ না করাকে আমি ভালোভাবে দেখছি না। ২০১৮ সালে কোটার বিষয়ে আমরা যখন একটি রিট করেছিলাম, ‘এটা নির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্ত’ এই বলে তখন আদালত সেটা খারিজ করে দিয়েছিলেন। তার মানে তখন তারা বিষয়টিকে নির্বাহী বিভাগের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। নির্বাহী বিভাগের সেই সিদ্ধান্তকে আদালত কীভাবে আবার ফিরিয়ে আনেন, সেটা আমার বোধগম্য নয়।

কালবেলা: আদালতের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় নতুন করে কোটাবিরোধী আন্দোলনে নামার যৌক্তিকতা কতটুকু?

ভিপি নুর: চলমান আন্দোলনের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণরূপে ঐকমত্য পোষণ করছি। এই আন্দোলন যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত। এটা ছাত্রসমাজের সময়োপযোগী একটা প্রতিক্রিয়া। শিক্ষার্থীরা চাচ্ছে, ২০১৮ সালের পরিপত্রের পুনর্বহাল। কিন্তু তারা সেটাও না দিয়ে একেবারে বাতিল করে দিচ্ছে। শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়ায় আমি অযৌক্তিক কিছু দেখি না। তাদের দাবিতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন রয়েছে, একটা শ্রেণি ব্যতীত। যারা বাংলাদেশকে পিছিয়ে দিতে চায়, দেশকে ব্যর্থ ও পঙ্গু রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায় এবং যারা চায় এদেশে মেধাবী তরুণরা না থাকুক, একমাত্র তারাই কোটার মাধ্যমে একটা অযৌক্তিক ও অযোগ্য আমলাতন্ত্র তৈরি করতে চায়।

কালবেলা: কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাবেক নেতা হিসেবে এবং বর্তমানে একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা হিসেবে এই আন্দোলনে আপনার ভূমিকা কী?

ভিপি নুর: আমরা ২০১৮ সালে যারা কোটা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলাম, তারা সংবাদ সম্মেলন করে ওই সময় জারিকৃত পরিপত্র বহালের পক্ষে যেন সরকার ব্যবস্থা নেয় সেই দাবি জানিয়েছিলাম। সরকার এখন একটি জটিলতার মধ্যে আছে। একদিকে দেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি ও লুটপাটের তথ্য গণমাধ্যমে আসছে। নির্বাচন ও জাতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সরকার নানা ধরনের সংকট মোকাবিলা করছে। এ মুহূর্তে কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং শিক্ষকদের আন্দোলন সরকারকে চাপে ফেলেছে। সরকারের কাছে আমার দাবি থাকবে, কোটা সংস্কার কিন্তু কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। অতএব শিক্ষার্থীদের এ দাবি মেনে নিক। যদি সরকার এই দাবি মেনে না নেয়, তাহলে এ আন্দোলন বৃহৎ আকার ধারণ করবে। এ আন্দোলনকে যদি সরকার ছাত্রলীগ দিয়ে হামলা করিয়ে এবং পুলিশ প্রশাসন দিয়ে থামিয়ে দিতে চায়, তাহলে সেটা হবে সবচেয়ে বড় ভুল। এর আগে আমরা যারা কোটা আন্দোলন করেছি এবং বর্তমানে জাতীয় পর্যায়ে থেকে রাজনীতি করছি, তারা বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছি। প্রয়োজনে আরও বৃহদাকারে রাজনৈতিক দল ও অভিভাবকদের নিয়ে আমরা আবারও ছাত্রদের সঙ্গে রাজপথে নামব।

কালবেলা: বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কোটা ব্যবস্থা এবং বাংলাদেশের কোটা ব্যবস্থা তুলনা বিবেচনায় আপনার মতামত কি?

ভিপি নুর: পৃথিবীর বহু দেশে কোটা ব্যবস্থাই নেই। ভারতের মতো অল্প কিছু দেশে কিছু কোটা চালু আছে। ভারতে বিভিন্ন পিছিয়ে পড়া এলাকা, প্রদেশ ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে নানাদিক বিবেচনায় কিছু কোটা রাখা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমান প্রেক্ষাপটে যে বিবেচনায় কোটা রাখা হয়েছে, সেটা অগ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিদের জন্য আবার রাখা হলো। সেটা সমর্থনযোগ্য নয়।

কালবেলা: কোটা সম্পর্কে আপনার চূড়ান্ত অবস্থান কী?

ভিপি নুর: আমার মতে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোটা সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা উচিত। ২০১৮ সালে কোটা নিয়ে যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেই কমিটি কোটা বাতিলের সুপারিশ করেছিল। তাদের মতেই তো কোটা রাখার যৌক্তিকতা নেই। যেখানে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন সংসদে দাঁড়িয়ে যে, কোটা থাকবে না। সেখানে বিশিষ্টজনের মতামত নিয়ে যদি সরকার মনে করে কিছু জায়গায় রাখা দরকার, সেটা করা যেতে পারে। তবে আন্দোলন চলাকালে আমরা বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তির কাছে গিয়ে মতামত নেওয়ার চেষ্টা করেছি, তাদের কেউই কখনো কোটার পক্ষে কখনো মতামত দেননি।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে এখন বর্তমানে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরাই বেশি এগিয়ে। বর্তমানে ক্ষুদ্র-নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীদের জন্যও ওই ধরনের কোটার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আমার মনে হয় না। প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে কিছু কিছু জায়গায় কোটা রাখা যেতে পারে।

কালবেলা: চলমান আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কী?

ভিপি নুর: আমরা যতদূর জানতে পেরেছি, বর্তমান আন্দোলনে বিভিন্ন দল ও মতের শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং অংশগ্রহণ করছেন। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে যারা আছেন তাদের সরকার নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করে এবং প্রভাবিত করে আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। আমাদের সময় আমরা সুসংহতভাবে আন্দোলনটা পরিচালনা করেছিলাম। আন্দোলনের শুরুতে আমরা যে জনমত এবং অবস্থান তৈরি করতে পেরেছিলাম, সেই সক্ষমতা এখনকার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের কতটুকু আছে সেটা আমার জানা নেই। তবে আমি তাদের কিছু বিষয়ে সতর্ক করেছি। আন্দোলনকারী দু-একজনের রাজনৈতিক পরিচয় সামনে এনে আন্দোলনরতদের ওপর সরকার সমর্থকদের দিয়ে হামলা করানো হতে পারে। অথবা কিছু নেতৃবৃন্দকে নাজেহাল করতে পারে। কাজেই তাদের মধ্যে সঠিক ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ নেতৃত্ব থাকতে হবে। আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা হলে তারা যদি ঘুরে দাঁড়াতে না পারে, তাহলে এই আন্দোলন সফল হবে না।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দ্বিতীয় সেশনেও টাইগারদের দাপট

ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব রক্ষায় ৮ দফা বাস্তবায়নের দাবি ঐক্য পরিষদের

ভিসার মেয়াদ শেষ আজ, কী ঘটবে শেখ হাসিনার ভাগ্যে

লক্ষ্মীপুরে পিটিআই প্রশিক্ষকের অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ

সালমানকে নিয়ে যা বললেন শাবনূর

ট্রাম্পের তথ্য হ্যাক করে বাইডেনকে দিয়েছে ইরান!

শেষ ম্যাচে ৮ উইকেটের বড় জয় বাংলাদেশের

নামাজ পড়ে বাসায় যাওয়া হলো না পুলিশ সদস্য জহিরুলের

বিদেশি শিক্ষার্থী-কর্মীদের কানাডার দুঃসংবাদ

পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ঢাবি প্রশাসনের মামলা

১০

জবির নতুন রেজিস্ট্রার অধ্যাপক শেখ গিয়াস উদ্দিন

১১

ঢাবিতে মব জাস্টিসের প্রতিবাদে ‘ব্রিং ব্যাক জাস্টিস’ কর্মসূচি

১২

ঢাবিতে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িতদের পরিচয় মিলল

১৩

আ.লীগ নেতা তুষার কান্তি মন্ডল ৭ দিনের রিমান্ডে

১৪

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই গ্রামবাসীর সংঘর্ষে আহত ১৫

১৫

ঢাবি ও জাবিতে ‘পিটিয়ে হত্যা’ দুঃখজনক : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

১৬

জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সম্প্রদায়িক সহিংসতার তদন্ত দাবি ঐক্য পরিষদের

১৭

ঢাবির হলে পিটিয়ে হত্যা, তদন্তে প্রত্যক্ষদর্শীদের সহায়তার আহ্বান

১৮

জাবিতে ছাত্রলীগ নেতা হত্যা নিয়ে আ.লীগের বিবৃতি

১৯

গ্যাংস্টারের স্ত্রী পরী মণি 

২০
X