কোনো প্রতিষ্ঠানে অসৎ কর্মীকে পুরস্কৃত করার অর্থই যে সৎকর্মীকে তিরস্কার করা, তা বলাই বাহুল্য। কেননা চুরি করে পদোন্নতিসহ পুরস্কার যদি চোরের কপালে জোটে, স্বভাবতই সৎকর্মীদের তা আহত করে; প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাদের আন্তরিকতা, কর্মনিষ্ঠতা ও সততায় চিড় ধরে—এটাই স্বাভাবিক। এ ছাড়া সহকর্মীদের মধ্যে অসাধু উপায় অবলম্বনের উৎসাহ তৈরি হতে পারে। আখেরে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সরকারি এসব প্রতিষ্ঠান। আর সরকারি প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিটা হয় জনগণেরই। এ চিত্র দেশের বেশিরভাগ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় একেবারেই অচেনা নয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় অনিয়ম, দুর্নীতি এবং সেসব অপকর্মের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না হওয়া বিরল ঘটনা তো নয়ই; বরং অসংখ্য ঘটনায় অপকর্মের হোতাদের নানাভাবে পুরস্কৃত করার ঘটনাও কম নেই, যা এক কথায় হতাশার।
‘বিমানে পদোন্নতি পাচ্ছেন চোরাচালানে জড়িতরা’ শীর্ষক শিরোনামে রোববার কালবেলায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে, সরকারি সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কিছুসংখ্যক কেবিন ক্রুর পদোন্নতির একটি প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গতকাল রোববার ছিল পদপ্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, যাদের পদোন্নতির জন্য মৌখিক পরীক্ষায় জন্য ডাকা হয়েছে, তাদের প্রায় সবাই বিভিন্ন সময় সংস্থাটিতে চোরাচালান, চুরি, শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডসহ নানা রকমের অনিয়ম ও অসাধুতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অতীতে এসব কর্মকাণ্ডে ধরা পড়ে কিংবা জড়িত প্রমাণ হওয়ায় তারা নানা ধরনের শাস্তিও ভোগ করেছেন। কেউ কেউ হন চাকরিচ্যুতও। আবার বিশেষ বিবেচনায় ফেরত দেওয়া হয়েছে চাকরি। শাস্তিস্বরূপ একধাপ পদাবনতি দেওয়া হলেও ফেরানো হয় আগের পদেই। এবার এমন ব্যক্তিকেও আরও এক ধাপ পদোন্নতি দেওয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে বিমান। এ ছাড়া এই পদোন্নতির ক্ষেত্রে কারও কারও ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না বিমানের সার্ভিস রেগুলেশনের নীতিমালা; যেমন—একই পদে তিন বছর দায়িত্ব পালন না করলে পদোন্নতিযোগ্য নয়, মানা হচ্ছে না সেটাও। সব মিলিয়ে পদোন্নতির ভাইভার মাধ্যমে যে ১৭ জন জুনিয়র পার্সার পদোন্নতি পেয়ে ফ্লাইট পার্সার হচ্ছেন, তাদের প্রায় সবার বিরুদ্ধেই রয়েছে গুরুতর অভিযোগ।
প্রথমত, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে ফ্লাইট পার্সার পদে বর্তমানে যে ৭৬ জন কর্মরত রয়েছেন, তাদের মধ্যেও প্রতিদিন বসে থাকতে হয় ৪৬ জনকে। এর পরও নতুন করে পদোন্নতির কী প্রয়োজন, তা বোধগম্য নয়। দ্বিতীয়ত, যেসব কর্মীদের চোরাচালানের মতো অপকর্মে জড়ানোয় ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় রাষ্ট্রীয় এ সংস্থাকে, তাদেরই পদোন্নতি দেওয়ার এ পাঁয়তারা কেন? তৃতীয়ত, এই পদোন্নতির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছেন সস্থাটির যে বিভাগ এবং যেসব উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নির্দেশে সম্পন্ন করা হচ্ছে, এ বিষয়ে তাদের ব্যাখ্যা যথার্থ ও পরিষ্কার নয়?
আমরা মনে করি, রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি বিশেষের প্রভাব ও খামখেয়ালিতে চলতে পারে না। বিভিন্ন গুরুতর অনিয়ম ও চোরাচালানে জড়িত, শাস্তিপ্রাপ্ত এসব অসৎ ক্রুদের পদোন্নতি গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা এতে চোরের গলায় মাল্যদানই ঘটে। এটি ভালো উদাহরণ নয়। এ ছাড়া একই পদে প্রয়োজনের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশিসংখ্যক কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও এই পদোন্নতি যে রাষ্ট্র তথা জনগণের অর্থের অপচয়কেই নিশ্চিত করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানে শাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধীদের এ পদোন্নতির যৌক্তিক ও বাস্তবিক কোনো ভিত্তিই যেখানে আপাতদৃষ্টে স্পষ্ট নয়, সেখানে কোন বিবেচনায় এবং কার স্বার্থে এটি হচ্ছে, তা খুঁজে বের করা জরুরি। আমরা চাই, নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়া এসব কেবিন ক্রুদের পদোন্নতির এ প্রক্রিয়া স্থগিত করা হবে। এতে সংস্থাটিতে অপরাধ ও নীতিবিবর্জিত কাজ নিরুৎসাহিত হওয়ার পাশাপাশি অর্থের অপচয়রোধ সম্ভব হবে।