বিভিন্ন বেসরকারি ওষুধ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশনসহ নানাভাবে আর্থিক সুবিধা নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে একটি অংশের অমানবিকভাবে রোগীদের গলাকাটার প্রবণতা বা চর্চা নতুন নয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই অনৈতিক প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।
শনিবার কালবেলায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে রাজধানীর শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের কিছু অসাধু চিকিৎসকের কমিশনের লোভে দরিদ্র ও অসহায় রোগীদের স্বল্প দামের দেশি ওষুধের পরিবর্তে ব্যবস্থাপত্রে বিদেশি দামি ওষুধ লেখার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, হাসপাতালটিতে জ্বর, সর্দি ও কাশিতে ভুগছে এমন শিশুদের ক্ষেত্রেও দেওয়া হচ্ছে এমন সব বিদেশি ওষুধ, যার দাম অধিকাংশ রোগীর স্বজনেরই সামর্থ্যের বাইরে। হাসপাতালের বহির্বিভাগে দায়িত্বরত চিকিৎসক জ্বর ও কোষ্ঠকাঠিন্যের ওষুধের পাশাপাশি ব্যবস্থাপত্রে লিখছেন ‘স্মার্ট আইকিউ’ নামের ওষুধ। স্মার্ট আইকিউ ওষুধটি মূলত ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট। এটি থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করা। ওষুধটিতে টোনা মাছের তেল ও মাল্টিভিটামিন উপাদান আছে। এর দাম ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা। অন্যদিকে দেশি কোম্পানির উৎপাদিত একই ধরনের ওষুধের দাম বাজারে মাত্র ৮০ থেকে ১০০ টাকা। এ ধরনের সিরাপ ১৫ দিন দুবেলা করে খাওয়াতে কমপক্ষে তিনটি ফাইল প্রয়োজন, যার দাম সাড়ে ৪ হাজার টাকা। অথচ দেশি কোম্পানির ওষুধ কিনতে খরচ হবে মাত্র ৩০০ টাকা। অর্থাৎ শিশুরা যে ধরনের অসুস্থতা নিয়েই আসুক না কেন, সবার ব্যবস্থাপত্রেই এ ধরনের একটি বিদেশি দামি ওষুধের নাম ঢালাওভাবে লিখছেন চিকিৎসক। এ ছাড়া বিদেশি ওষুধের তালিকায় রয়েছে গ্রোথ বেবি, হেলথ জয়সহ আরও বেশকিছু নাম। কিছু চিকিৎসক বিদেশ থেকে বৈধ-অবৈধ পথে আনা ভিটামিন ও ফুড সাপ্লিমেন্ট কোম্পানির প্রলোভনে পড়ে এ কাজ করছেন। একেকটি ওষুধের জন্য তারা কোম্পানি থেকে ৫০০ টাকার মতো কমিশন পান। অর্থাৎ দিনে ৫০টি ব্যবস্থাপত্রে এসব ওষুধের নাম লিখলে একজন চিকিৎসক আয় করবেন ২৫ হাজার টাকা। বিদেশি ওষুধ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মীদের ভাষ্যে, ম্যানেজ বা খুশি করতে পারলেই শুধু চিকিৎসক এসব ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লেখেন।
আমরা জানি, এই হাসপাতালটি সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের রোগী, বিশেষ করে আর্থিকভাবে অসচ্ছল, দরিদ্র ও অসহায় রোগীর স্বজনদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এসব রোগীর স্বজনরা নিজ নিজ উপজেলা, জেলায় সর্বোচ্চ চিকিৎসার পর যখন শিশুকে সুস্থ করতে না পারেন, তখন চিকিৎসকরা উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজধানীতে রেফার করেন। উপায়ান্তরহীন এসব অসহায় মানুষের জন্য তখন এরকম সরকারি দু-একটি প্রতিষ্ঠানই তাদের প্রধান ভরসা। এখানেও যদি তারা প্রবঞ্চনার শিকার হন, তা-ও আবার খোদ চিকিৎসক কর্তৃক! এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ও হতাশার কথা।
বলা হয়ে থাকে, চিকিৎসা পেশা একটি মানবিক পেশা। সর্বত্র নীতি-নৈতিকতা ক্ষয়িষ্ণুতার এ সময়ে মানবিকতা অথবা অনুগ্রহ বা সমব্যথী হওয়ার বিষয়টি বাদ দিলেও অন্তত সাধারণ মানুষের সঠিক চিকিৎসা পাওয়ার যে অধিকার, সেটা নিশ্চিতে চিকিৎসকরা একটু আন্তরিক তো হতেই পারেন! এতেও কেন এত কার্পণ্য! যেসব চিকিৎসক এমন চর্চায় নিমজ্জিত, বোঝাই যাচ্ছে টাকার নেশা তাদের নৈতিকতাকে কোন অতল গহ্বরে নিয়ে গেছে। আমরা মনে করি, দেশে একই মানের কম মূল্যের দেশি ওষুধ থাকার পরও উচ্চমূল্যের ওষুধ লেখা অনৈতিক ও অমানবিক। আমরা চাই, এসব বিদেশি ওষুধ অনুমোদিত কি না, তা স্বাস্থ্য প্রশাসন যথাযথ নজরদারি করবে। পাশাপাশি হাসপাতালটিতে যেসব নীতিহীন চিকিৎসকের লোভের শিকার হচ্ছেন রোগী ও স্বজনরা, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।