আকমল হোসেন
প্রকাশ : ০৪ জুলাই ২০২৪, ০২:১৪ এএম
আপডেট : ০৪ জুলাই ২০২৪, ০৭:৫৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সংস্কৃতির বৈচিত্র্য যখন সমৃদ্ধ বিশ্বের সোপান

সংস্কৃতির বৈচিত্র্য যখন সমৃদ্ধ বিশ্বের সোপান

মানুষ জ্ঞানের আধার এবং আধুনিক বিশ্বের কারিগর। অসহায় দিগম্বর মানুষ আজ বিচরণ করছে আকাশ-পাতাল আর সমুদ্রের তলদেশে। এক সময়ের প্রকৃতির অপ্রতিরোধ্য এবং নেতিবাচক ঘটনাকে মানুষ আজ নিয়ন্ত্রণ করে নিজেদের ইতিবাচক প্রয়োজনে ব্যবহার করছে। নিজের পরিবার আর গোত্রেই শুধু তার বিচরণ নয়, সে আজ বিশ্ব নাগরিক, বিশ্ব সমাজের সদস্য। ধর্ম-বর্ণ আর ভাষার বিবেচনায় খণ্ডিত এবং সংখ্যার বিচারে ক্ষুদ্র অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে, সে হয়েছে পৃথিবীর ৮০০ কোটি মানুষের একজন। সবার সম্মিলিত সৃষ্টিশীলতায় পৃথিবী হয়েছে সমৃদ্ধ আর মানুষ হয়েছে সেই সমৃদ্ধ পৃথিবীর একজন সদস্য। ব্রাজিলের জঙ্গলের আদিম মানুষ আর চাঁদে যাওয়া মানুষটির জীবনবোধের সমষ্টিই আজকের সংস্কৃতি বা সভ্যতা। এগুলো তৈরির পেছনে কারও একক উদ্যোগ হয়তো আছে, তবে ভূমিকা আছে সবার, যেমন বিন্দু বিন্দু জলে সিন্ধুর জন্ম। সবার কাজের ফসল সবাই মিলে ভোগ করলে পৃথিবী হয়তো আরও সুন্দর থেকে সুন্দরতম হতো।

মানুষের অভাব বোধই মানুষকে নতুন সৃষ্টির প্রেরণা দিচ্ছে। এ প্রেরণার যেমন সর্বজনীনতা রয়েছে, তেমনি সংস্কৃতিরও সর্বজনীনতা রয়েছে। সংস্কৃতির বহুত্ববাদিতা পৃথিবীকে করেছে সমৃদ্ধ। পৃথিবীতে ছয় হাজার প্রকার ভাষাভাষী বা জাতিসত্তার বিচরণ লক্ষ্যযোগ্য, এর মধ্যে ভারতেই রয়েছে ১ হাজার ১০০ রকমের ভাষাভাষীর বিচরণ, বাংলাদেশে সংখ্যায় কম হলেও ৭০টি নৃগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। এদের প্রত্যেকেরই ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি ও জীবনবোধ রয়েছে। প্রাণীর জন্য শারীরিক খাদ্য (ভাত, রুটি, পানি, ফলফলারি, জামাকাপড় ইত্যাদি) যেমন অপরিহার্য, মানুষের জন্য মানসিক খাদ্যও (চিন্তা করা, বই পড়া, গান করা, লেখালেখি ইত্যাদি) তেমনি গুরুত্বপূর্ণ, মানুষের জন্যও শারীরিক খাদ্যও প্রয়োজন। মানসিক চাহিদা পূরণ করতেই মানুষ চর্চা শুরু করেছিল সংস্কৃতির। আর সংস্কৃতির চর্চাই মানুষকে সংস্কৃতিবান করেছে। মানুষ চর্চা করে সংগীত, নৃত্য, নাটক, কবিতা, খেলাধুলা। ধর্মীয় আচরণ পালন এক সময় তার গোত্রে, জীবনাচারণ আর ধর্মের আচরণ দিয়ে শুরু করেছিল, আজও সেটা আছে তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন ও বিশ্বায়নের আলোকে সংস্কৃতি চর্চার সংক্ষিপ্ত বাতাবরণ অতিক্রম করে আজ বৃহৎ পরিসরে, এগুলোর চর্চা শুরু হয়েছে। যেখানে সব মতের-পথের মানুষকে একই ধারায় সম্পৃক্ত করেছে, মানুষে মানুষে, সৃষ্টি হয়েছে সম্প্রীতি আর সৌহার্দ্যের। জাতিগত ভাষাগত আর জীবনাচরণের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা গারো সম্প্রদায়ের ওয়ানগালা অনুষ্ঠান। তাদের সংস্কৃতির চর্চার বিষয়টিও আজ বিশ্ব সংস্কৃতির অংশ। পৃথিবীকে সভ্য ও সমৃদ্ধ করতে সব জাতিসত্তার সব ধরনের জীবনাচার বিকাশের অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের একটা দায় আছে। সেটি পালন করলেই সমৃদ্ধ পৃথিবী গড়ার কাজ আরও এগিয়ে যাবে।

ওয়ানগালা গারো সম্প্রদায়ের ফসল তোলার উৎসব বাঙালিদের নবান্ন উৎসবের মতো এ অনুষ্ঠান করা হয়। সাধারণত শরৎকালে পাহাড়ে মেগং ফুল ফুটলে ওয়ানগালা অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শুরু হয় এবং পূর্ণিমা চাঁদের মধ্যেই অনুষ্ঠান শেষ করতে হয়। গ্রামের সবার ফসল ঘরে তোলার পর নকমা (গ্রাম প্রধান) সবাইকে ডেকে এনে আপ্যায়ন করেন এবং ওয়ানগালা অনুষ্ঠানের দিন-তারিখ নির্ধারণ করেন। সাধারণত তিন দিন, তিন রাত ধরে ওয়ানগালার অনুষ্ঠান করে থাকে। তবে বর্তমানে সেটি কমিয়ে এক দিনেই শেষ করার রীতি চালু হয়েছে। নকমা/গ্রামপ্রধান নিজের বাড়ির মূল ঘরের মাঝখানের খুঁটিতে ভাত, কচু ও আলুজাতীয় সবজি কুমড়া, আদা, জামবুরা, লেবুজাতীয় ফলাদি কমলা ও চিচিঙ্গা ফল রেখে আসে। সেই একই স্থানে জুমচাষে ব্যবহৃত কাস্তে, দা রাখা হয় তার ওপর। এর ওপর কিছু চাল ছিটিয়ে দেওয়া হয়। সেগুলো কলাপাতায় ঢেকে দেওয়া হয়। তার ওপর চু-জাকরা দেবদেবীর উদ্দেশে তৈরি উৎকৃষ্ট মদ ঢেলে দেওয়া হয়। রক্সি মেমার উদ্দেশে উঃস্বর্গ করে তাকে বাড়িতে অবস্থানের জন্য আহ্বান জানানো হয়, হিন্দু ধর্মে লক্ষ্মীকে যেমন আরাধনা করা হয়, অনেকটা সে রকম। নকমার বাড়িতে অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠানকে বলে ওয়ানগালা অনুষ্ঠান। গারোদের মধ্যে অনেক উপদল রয়েছে, এদের মধ্যে আওং, আমরেং বা আরেংদুয়ার, ব্রাক, চীবক ও মেগাম। তবে ধর্মীয় আচরণে ৯৯ ভাগ খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। প্রাচীনকালে গারোরা ফলমূল খেয়ে জীবনধারণ করত, কারণ তখনো তারা ধান-চাল উৎপাদন করতে শেখেনি। পৃথিবীতে একজন মানুষ যার নাম আ.নি.আ ফিরফা চিনি গারফারের সঙ্গে মিদ্দে দেবতা মিসি আ.ফিলফার সালজং গারফার সঙ্গে পরিচয় হয় এবং গালফা তাকে ধানের বীজ প্রদান করে। সেই বীজ থেকে ধান উৎপাদন হয়। দেবতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেই ঘরের মূল খুঁটির পাশে ধূপ, ধুনা ও মদিরা উৎসর্গ করে। সেই ঘটনার আলোকেই অনুষ্ঠিত হয় ওয়ানগালা।

সৃষ্টির শুরুতেই মানুষের মনে অসহায়ত্ব থেকে কারও প্রতি আস্থা বা বিশ্বাসের জন্ম হয়েছিল, সেটাও তার জীবনবোধের অংশ। জীবনবোধকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে নানান অনুষ্ঠান আর পার্বণের জন্ম। মুসলিমদের মধ্যে ঈদ উৎসব, সুফিবাদীদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ওরস, গাজির গান, গাজির মেলা, গাজি কালু চম্পাবতীর মেলা অনুষ্ঠিত হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে শারদীয় উৎসব গুপিনাথের মেলা, চৈত্র মাসে চরক পূজা, কথায় বলে তাদের বারো মাসে তেরো পার্বণ। শীতকালে বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে রাত ধরে চলে ওয়াজ-নসিহত, বাঙালির লাটিখেলা, হাডুডু আর দাড়িয়াবান্ধা এবং বর্ষা মৌসুমে চলে নৌকাবাইচ খেলা। এগুলো কেন্দ্র করে আত্মীয়স্বজন ও পরিজনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়। এভাবে মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্বের মেলবন্ধন সূচিত হয়। এসব পার্বণে তাদের নিজেস্ব সংস্কৃতি বিকাশে নানান কিছুর প্রদর্শন করে। মানুষের জন্য এগুলো খুবই প্রয়োজন কারণ মানুষ হওয়ার জন্য প্রয়োজন মানসিক খাদ্য আর এ সংস্কৃতিই হলো মানুষের জন্য, মানসিক খাদ্য।

লেখক: কলেজ অধ্যক্ষ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক

বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

তৃতীয় দিনের প্রথম সেশনের খেলাও হচ্ছে না

আ.লীগের দোসরদের চারপাশে বসিয়ে সংস্কার সম্ভব নয় : কাদের গনি

জবির নতুন পরিবহন প্রশাসক অধ্যাপক ওমর ফারুক

চবিতে হলে আটকে রেখে ছাত্রলীগ কর্মীকে মারধর

কোরআন পড়ে বাড়ি ফেরা হলো না চার শিশুর

আদালতে সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান

শাবিপ্রবি ছাত্রলীগ সভাপতি গ্রেপ্তার

নোয়াখালীতে গণপিটুনিতে যুবলীগ নেতা নিহত

সুসংবাদ পেতে পারে কন্যা

‘রাসুল (সা.) এর দেখানো পথে ইসলামী সমাজ বিনির্মাণে কাজ করতে হবে’

১০

চার জেলায় তীব্র বজ্রপাত ও ভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস

১১

ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কমিশন হচ্ছে : হাসনাত আবদুল্লাহ

১২

বিপৎসীমার ওপরে তিস্তার পানি

১৩

ঢাকা সিএমএইচে নেওয়া হয়েছে শিক্ষার্থী কাউসারকে

১৪

তাপমাত্রা নিয়ে নতুন তথ্য দিল আবহাওয়া অফিস

১৫

দেশে ফিরলেন ড. ইউনূস

১৬

২৯ সেপ্টেম্বর : নামাজের সময়সূচি

১৭

রোববার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

১৮

নীলফামারীতে শেয়ালের কামড়ে শিশুসহ আহত ৫০

১৯

রাণীশংকৈলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে জামায়াতের সম্প্রীতি সমাবেশ

২০
X