মহসীন হাবিব
প্রকাশ : ০২ জুলাই ২০২৪, ০২:২৪ এএম
আপডেট : ০২ জুলাই ২০২৪, ০৮:৫০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্ব এখন বারুদের গুদাম!

বিশ্ব এখন বারুদের গুদাম!

বেশ কয়েক দিন ধরে আন্তর্জাতিক মহলে গুঞ্জন, ইসরায়েল লেবাননে আক্রমণ করতে যাচ্ছে। ইসরায়েলের বডি ল্যাঙ্গুয়েজেও সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রীতিমতো ফুঁসছে এবং স্বল্পবিস্তর হামলাও চালাচ্ছে থেকে থেকে। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফের উচ্চপর্যায়ের কমান্ডারদের নিয়ে সাদার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টারে এক জরুরি মিটিংয়ে বসেছিলেন সম্প্রতি। তার সঙ্গে ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জাচি হ্যানেগবি এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট। এর প্রধান উদ্দেশ্য, গাজায় অপারেশন সম্পন্ন করে লেবাননে হামলার সময় উপস্থিত হয়েছে কি না, সে বিষয়ে আলোচনা করা। অন্তত বিশেষজ্ঞরা তাই মনে করছেন। কারণ প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সম্প্রতি বলেছেন, ইসরায়েল লেবানন সীমান্তে চরম অপারেশনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট ওয়াশিংটন সফরের সময় বলেছেন, ‘আমরা লেবাননের সঙ্গে রাজনৈতিক সমাধান চাই, সেটাই উৎকৃষ্ট পথ। কিন্তু ইসরায়েলের বাহিনী প্রস্তুত আছে যে কোনো যুদ্ধের জন্য। হিজবুল্লাহ ভালো করেই জানে যে, আমরা তাদের ধ্বংস করে ফেলতে পারি।’

ওদিকে ইরান বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছে। ফলে জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরানের প্রতিনিধিদল সতর্ক করে বলেছে, ইসরায়েল যদি লেবাননে পূর্ণ সামরিক আগ্রাসন চালায়, তাহলে ইসরায়েল দেশটি মানচিত্র থেকে মুছে যাবে। সব ধরনের ব্যবস্থার কথাই নাকি ভেবে রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে গত ২৯ জুন ইসরায়েলের জঙ্গিবিমান লেবাননে অবস্থিত দুটি হিজবুল্লাহ ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলের মতে, দুটি ঘাঁটিরই ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই যুদ্ধ কি বিমান হামলা চালিয়ে এবার স্বল্প সময়েই শেষ করতে পারবে ইসরায়েল? পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠল ১ জুলাই (সোমবার) আইডিএফ ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারে বুরকান রকেট হামলার মধ্য দিয়ে। এ লেখার সময় গণমাধ্যমে খবর আসছে, ইসরায়েলের সেনারা দক্ষিণ লেবাননে হামলা শুরু করেছে। এ যুদ্ধ এখন পশ্চিম এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়বে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

২০০৬ সালে হিজবুল্লাহ এবং ইসরায়েলের মধ্যে ৩৪ দিনব্যাপী যুদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধটি সীমাবদ্ধ ছিল লেবানন, ইসরায়েলের উত্তরাংশ এবং গোলান হাইটসের মধ্যে। সেই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল হিজবুল্লাহ গেরিলারা ইসরায়েলের সীমান্ত অতিক্রম করে মিলিটারি টহলের ওপর হামলা চালানোর পর। আর যুদ্ধটি থেমেছিল লেবাননের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ফওয়াদ সিনিওরা যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘকে অতিসত্বর যুদ্ধ বন্ধের আহ্বানের পর যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের প্রচেষ্টায়। সেই যুদ্ধে লেবাননের সেনাবাহিনী সরাসরি ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়ায়নি। কিন্তু সে যুদ্ধও ছিল ইরানের প্রক্সি ওয়ার হিজবুল্লাহর মাধ্যমে।

এবারও তাই। হিজবুল্লাহর পেছনে রয়েছে ইরান। গত বছর ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েলের অভ্যন্তরে হামলার পর যে যুদ্ধ শুরু হয়, সেই মুহূর্ত থেকেই হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে রকেট ছুড়তে শুরু করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এবার কি ইসরায়েলের জন্য একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করা সম্ভব হবে? প্রথমত, ইসরায়েলকে গাজার হামাস, ইয়েমেনের হুতি (যদিও তারা ভৌগোলিকভাবে দূরে) এবং লেবাননের হিজবুল্লাহর সঙ্গে লড়তে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ২০০৬ সালের হিজবুল্লাহর সঙ্গে বর্তমান হিজবুল্লাহর পার্থক্য যোজন যোজন। শিয়া মুসলিম এই হিজবুল্লাহ সদস্যরা এখন ছড়িয়ে আছে লেবানন, সিরিয়া, ইরাকে। পশ্চিম এশিয়ার সবচেয়ে দুর্ধর্ষ প্যারামিলিটারি এই হিজবুল্লাহ। তাদের হাতে আছে এখন দেড় লাখ বিস্ফোরকযুক্ত ড্রোন, ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট এবং গাইডেড মিসাইল ও ব্যালিস্টিক মিসাইল। হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহর দাবি, হিজবুল্লাহর রয়েছে এক লাখ প্রশিক্ষিত যোদ্ধা! হিজবুল্লাহ এরই মধ্যে বলেছে, তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি অপারেশন শুরু করলে তারা ইসরায়েলের নিউক্লিয়ার প্লান্টে হামলা চালাবে। এ ছাড়া সার্বিকভাবে বিশ্ব পরিস্থিতি অনেক জটিল। সে কথায় পরে আসছি।

বর্তমান ইসরায়েল-লেবানন পরিস্থিতিকে যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত উদ্বেগের বলে মনে করছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে বৈঠককালে বলেছেন, ইসরায়েল-লেবানন যুদ্ধ শুরু হলে তা পুরো আরব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে এবং ভয়ংকর পরিণতি ভোগ করতে হবে। তার এ কথা বলা মোটেই অনর্থক নয়। ভূমধ্যসাগরে সাইপ্রাসে আছে ব্রিটিশ রয়্যাল ফোর্সের ঘাঁটি। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের যে সামরিক সহায়তা দেয় তার অন্যতম উৎস এই ঘাঁটি। এরই মধ্যে হাসান নাসরুল্লাহ হুমকি দিয়েছেন, যদি ইসরায়েল পূর্ণশক্তি নিয়ে লেবাননে হিজবুল্লাহর ওপর হামলা চালায় তাহলে সাইপ্রাসও হিজবুল্লাহর হামলা থেকে রেহাই পাবে না। অর্থাৎ সাইপ্রাসের বিমানঘাঁটিতে হিজবুল্লাহ হামলা চালালে তা সরাসরি রয়্যাল এয়ারফোর্সের গায়ে আঘাত করবে, যা ব্রিটেনসহ যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি যুদ্ধে নিয়ে আসতে পারে।

এদিকে ইরানে ৫ জুলাই রানঅফ ইলেকশন। গত ২৯ জুন প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে দুজন লড়াইয়ে টিকে থাকা প্রার্থীর কেউ ৫০ শতাংশ ভোট না পাওয়ায় এ নির্বাচন। সে নির্বাচনে কট্টরপন্থি জালিলি অপেক্ষাকৃত মডারেট মাসোদ পেজেসকিয়ানের চেয়ে দল লাখ ভোট কম পেয়েছে। এই নির্বাচনের ফলাফলের ওপর যদিও ইরানের ইসরায়েল নীতি নির্ভর করছে না, তথাপি হয়তো নির্বাচনের পর ইসরায়েলের সঙ্গে হিজবুল্লাহর বোঝাপড়ার তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে।

এর চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ইউক্রেন ঘিরে। রাশিয়া ইউক্রেনের প্রায় এক-চতুর্থাংশ দখল করে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট অস্ত্র-রসদ দিয়ে ইউক্রেনকে সহায়তা করলেও রাশিয়াকে পিছু হটাতে পারবে এমন সম্ভাবনা নেই। এ যুদ্ধ শেষ হওয়ার জন্য এখন দুটি পথ খোলা আছে—এক. হয় রাশিয়াকে দখলীকৃত অঞ্চল ছেড়ে দিতে হবে এবং ইউক্রেনকে কথা দিতে হবে যে, তারা ন্যাটো জোটে যাবে না; দুই. রাশিয়াকে ন্যাটোর সহায়তায় অথবা সরাসরি ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলোর অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে পরাজিত করতে হবে। বাস্তবে এ দুটোর কোনোটাই সম্ভব নয়। রাশিয়া এরই মধ্যে পশ্চিমা বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহার এবং ইউক্রেনকে সহায়তা নিয়ে বারবার পরমাণু যুদ্ধের হুমকি দিয়ে আসছে। রাশিয়ার হাতে রয়েছে সর্বাধিক সংখ্যক নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড। বিশাল আয়তনের রাশিয়াকে সহসা কাবু করা যাবে না, এটা পরিষ্কার। অন্যদিকে ঘুমন্ত দৈত্যের মতো নীরবে অবলোকন করছে চীন। তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সাপে-নেউলে। যদি বড় যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে চীনের সহানুভূতি-সহযোগিতা থাকবে রাশিয়ার দিকে। অর্থাৎ বিশ্বকে দেখতে হবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। দেখতে হবে বললে ভুল হবে। অংশগ্রহণ করতে হবে ছোট-বড় প্রায় সব দেশকেই।

সবদিক বিবেচনা করে সম্প্রতি সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার ভুসিক বলেছেন, বিপদটা আসছে আগামী তিন-চার মাসের মধ্যেই। তার কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে আমাদের বিপদের আর বেশি দেরি নেই। পৃথিবী এখন বারুদের গুদাম। এই গুদামের কোনো প্রান্ত আরেকটু জ্বলে উঠলেই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে আগুন। প্রায় ৭০ বছর আগে আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কী ধরনের অস্ত্র দিয়ে হবে, তা বলতে পারব না। কিন্তু চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ হবে লাঠি ও পাথর দিয়ে।’ অর্থাৎ মানবসমাজ এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে যে, যুদ্ধ করার মতো কোনো প্রযুক্তিই মানুষের কাছে অবশিষ্ট থাকবে না। আমরা কোন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছি, তা একটু চিন্তা করলেই ভড়কে যেতে হয়!

লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দেশে ফিরলেন আমিরাতে ক্ষমা পাওয়া ১৪ বাংলাদেশি

আজকের নামাজের সময়সূচি

শহীদ আমিনুলের সন্তানদের দায়িত্ব নিল ইত্তেফাকুল উলামা

রোববার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

মিছিলে বিএনপি নেতার গুলির প্রতিবাদে বিক্ষোভ

রৌমারীতে ব্যবসায়ীদের আহ্বায়ক কমিটির শপথ অনুষ্ঠিত

৬৫ ভরি স্বর্ণ ছিনিয়ে নেয়ায় মামুনের বিরুদ্ধে যুবদলের মামলা

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ইসলামী আন্দোলনে যোগদান

ক্ষমা পেয়ে আমিরাত থেকে ১২ জন ফিরছেন চট্টগ্রামে

‘ছাত্র জনতার আন্দোলনে হাসিনা সরকার দুই ভাবে পরাজিত’

১০

মহানবীকে (সা.) কটূক্তিকারী সেই যুবকের বিরুদ্ধে মামলা

১১

শিবচর আঞ্চলিক সড়কে গ্রামবাসীর বৃক্ষরোপণ

১২

মাদ্রাসাছাত্রকে বলাৎকার চেষ্টার অভিযোগ ধামাচাপা, ৭ দিন পর ফাঁস

১৩

১২ দিনেও মেলেনি রানীনগরে নিখোঁজ নার্গিসের সন্ধান

১৪

দায়িত্বশীলদের নিয়ে সাতক্ষীরায় ছাত্র শিবিরের সমাবেশ

১৫

আযহারী শিক্ষার্থীরা হবে বাংলাদেশ ও মিশরীয় ঐতিহ্যের সেতুবন্ধন : মিশরীয় রাষ্ট্রদূত

১৬

রাজশাহীতে বস্তাভর্তি দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার

১৭

আন্দোলনের ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ছাত্রলীগ কর্মীকে গণধোলাই

১৮

আশুলিয়ায় গার্মেন্টস শ্রমিক অসন্তোষ ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে শ্রমিক সমাবেশ

১৯

কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি

২০
X