ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম
প্রকাশ : ৩০ জুন ২০২৪, ০২:৫৩ এএম
আপডেট : ৩০ জুন ২০২৪, ০৮:৩১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

অর্থ পাচার বন্ধে সরকারের কি কিছুই করার নেই

অর্থ পাচার বন্ধে সরকারের কি কিছুই করার নেই

সম্প্রতি প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিকের প্রধান শিরোনাম ছিল ‘বছরে ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি ডলার পাচার’, আরেকটি দৈনিকের শিরোনাম ছিল ‘গত অর্থবছরের (২০২২-২৩) তুলনায় চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) পাচারের ঘটনা বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ’। অর্থ পাচার একটি মামুলি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর বেশিরভাগই পাচার হচ্ছে কালো টাকা। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে মোট পুঞ্জীভূত কালো টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৩২ লাখ কোটি টাকা। আর পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ১১ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা। এই হিসাব ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত। আর এই তথ্যটি প্রকাশ করেছে অর্থনীতি সমিতি।

ব্যাংক লেনদেন, হুন্ডি ও মোবাইল ব্যাংকিং এবং গেমিং-বেটিংয়ের মাধ্যমেই টাকা পাচারের ঘটনা ঘটছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের সন্দেহে প্রায় সাড়ে ৫০০ ব্যাংক হিসাব শনাক্ত করা হয়। পাশাপাশি হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচারের অভিযোগে ব্যক্তিগত ২৭ হাজার ৬৮০ মোবাইল ব্যাংকিং (এমএফএস) স্থগিত এবং ৫ হাজার ২৯টি এমএফএস এজেন্টশিপ বাতিল করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া ব্যাংকিং ব্যবস্থায় চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) প্রথম আট মাস জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যাংক লেনদেন হয়েছে ২৩ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। এটি প্রস্তাবিত বাজেটের প্রায় তিন গুণ। পাশাপাশি একই সময়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে ৯ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এ লেনদেনও প্রস্তাবিত বাজেটের চেয়ে বেশি।

পাচারে জড়িত অনলাইন গেম, বেটিং ও অবৈধ ফরেক্স ট্রেডিং পরিচালনাকারী ২৯১টি ওয়েবসাইট, ৪৬৪টি সোশ্যাল মিডিয়া (ফেসবুক, ইউটিউব ও ইনস্টাগ্রাম) ও ৩৩টি মোবাইল অ্যাপস শনাক্ত করা হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে পাঠানো হয়েছে। হুন্ডির সংশ্লিষ্টতা সন্দেহে ২১টি মানি চেঞ্জারের তালিকা এবং স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ৩৯টি হিসাবের তথ্য প্রদান করা হয়েছে পুলিশের সিআইডিকে। হুন্ডি এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচারের অভিযোগে ফ্রিজ করা হিসাব অধিকাংশ হচ্ছে রেমিট্যান্স সংক্রান্ত।

অর্থ পাচার রোধে দেশে প্রয়োজনীয় আইন রয়েছে। আইনে পাচারকারীর দ্বিগুণ জরিমানা, ৪ থেকে ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং সম্পদ বাজেয়াপ্তের বিধান আছে। অর্থ সংক্রান্ত অপরাধ ঠেকাতে সরকার এ-সংক্রান্ত আইন আধুনিকায়ন করেছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ নামে এটি পরিচিত। এই আইনের ৪(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি মানি লন্ডারিং বা মানি লন্ডারিং অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা, সহায়তা বা ষড়যন্ত্র করলে তিনি অন্যূন ৪ (চার) বছর এবং অনধিক ১২ (বারো) বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুণ মূল্যের সমপরিমাণ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’ আইনের ১৭(১) ধারায় বলা আছে, ‘এই আইনের অধীন কোনো ব্যক্তি বা সত্তা মানি লন্ডারিং অপরাধে দোষীসাব্যস্ত হলে আদালত অপরাধের সহিত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত দেশে বা দেশের বাইরে অবস্থিত যে কোনো সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার আদেশ প্রদান করিতে পারিবেন।’

টাকা পাচারের বিষয়টি গভীর উদ্বেগজনক। কারণ সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের যে টাকা রাখা হয়েছে, সেটা মূলত দুর্নীতির। বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের মূলত তিনটি কারণ। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতি বেড়েছে বলেই অর্থ পাচারও বেড়েছে। এ ছাড়া দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণেও অর্থ পাচার বাড়ছে। অর্থ পাচার রোধ করতে হলে দুর্নীতি কমিয়ে আনার বিকল্প নেই।

যারা অর্থ পাচার করছেন, তারা রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী। তাদের ক্ষমতা অনেক বেশি। সবসময় তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। সরকারি সংস্থাগুলো তাদের ধরতে সাহস পায় না। তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করে পাচারকারীদের বার্তা দেওয়া উচিত। কিন্তু এ ধরনের বার্তা দেওয়া হচ্ছে না। যখন ইস্যুটি সামনে আসে, তখন চুনোপুঁটি কাউকে ধরা হয়। কিন্তু রাঘববোয়ালরা নিরাপদেই থাকেন। এ ছাড়া পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের অভাব রয়েছে। দক্ষতাসম্পন্ন এবং প্রতিশ্রুতিশীল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে বিদেশ থেকে টাকা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

আরেকটা বিষয় উল্লেখ করতে হয় যে, বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে এখানে বিনিয়োগের নিরাপত্তা নেই। একজন ব্যবসায়ী তার অর্থ এ দেশে বিনিয়োগ করে নিশ্চিত থাকতে পারেন না। বিভিন্নভাবে সরকারি ও বেসরকারি হুমকির মুখে তাদের বিনিয়োগ পাহারা দিয়ে রাখতে হয়। একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে গেলে একজন উদ্যোক্তাকে হাজার রকমের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অপ্রদর্শিত আয় ট্যাক্স ফাইলে ঘোষণা প্রদান, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে উপহার বা দান গ্রহণ, কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন, নানা রকম সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সেবা গ্রহণের ব্যবস্থাকরণ, যেমন—টেলিফোন, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট ইত্যাদির কানেকশন গ্রহণ খুবই ঝামেলাপূর্ণ এবং কালক্ষেপণ।

পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করা অনেক বেশি জটিল ও ব্যয়সাধ্য। ব্যবসায়ীদের টাকা বাংলাদেশে স্বচ্ছন্দে বিনিয়োগ করতে পারলে হয়তো অনেকেই অর্থ পাচারের চিন্তা করত না। ব্যবসা এবং ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তাদান, চাঁদাবাজি বন্ধকরণ ও রাজনৈতিক অঙ্গনের বিভিন্নমুখী চাপ থেকে ব্যবসায়ীদের মুক্ত রাখতে হবে। সর্বোপরি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সরকারি অফিসগুলো হতে হবে ব্যবসা সহায়ক। তাহলে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার বন্ধ হবে এবং বাংলাদেশে বিদেশি পুঁজি আসবে। যারা অর্থের মালিক তাদের কাছে পুঁজির নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে অন্যায় ও দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত টাকার বেলায় শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং সেটিও প্রকৃত অর্থে হবে ব্যবসা সহায়ক। কারণ সরকারি কর্মকর্তারা দুর্নীতিমুক্তভাবে কাজ করলে দেশে ব্যবসায়িক পরিবেশ অধিকতর পরিচ্ছন্ন হবে। আর সেইসঙ্গে বিধ্যমান আইনের প্রয়োগ বা কার্যকর করতে হবে।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক-বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মাদারীপুরে ‘কোপা শামসু’ গ্রেপ্তার

রাতের অন্ধকারে ভারতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা, ৬ বাংলাদেশি আটক

এবার গাজার যোদ্ধাদের নেতৃত্ব দেবেন যিনি

ছাত্র আন্দোলনের নেতাসহ ২ শিক্ষার্থীর ওপর হামলা

নির্বাচন কবে হতে পারে, জানালেন আসিফ নজরুল

মুক্তি পেল দুই সিনেমা

মধ্যরাতে ৩০০ ফিট সড়কে সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযান

নোয়াখালীতে দখলমুক্ত ফুটপাত, ব্যবসায়ীদের জরিমানা

একুশে পদকপ্রাপ্ত সংগীতশিল্পী সুজেয় শ্যাম আর নেই

ছিলেন জন্মগত বয়রা, গ্রেনেড হামলার ভুক্তভোগী সেজে ‘আওয়ামী গডফাদার’

১০

গাজার যোদ্ধাদের প্রধান নিহত, যা বলছে পশ্চিমা বিশ্ব

১১

ত্রাণের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ যুবদলকর্মীর বিরুদ্ধে

১২

মন খারাপ হলেই বিল্লাল দখলে নিতেন অন্যের সম্পদ

১৩

কে এই ইয়াহিয়া সিনওয়ার

১৪

খাতা না দেখেই মনগড়া রেজাল্ট দিয়েছে, অভিযোগ শিক্ষার্থীদের

১৫

দেশের ৬ অঞ্চলে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস

১৬

চিলমারীতে নদীতে ৫০০ হেক্টর জমি, নিঃস্ব ৩০০ পরিবার

১৭

বায়তুল মোকাররম মসজিদে নতুন খতিব নিযুক্ত 

১৮

১৮ অক্টোবর : ইতিহাসের এই দিনে আলোচিত যত ঘটনা

১৯

১৮ অক্টোবর : নামাজের সময়সূচি

২০
X