অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া
প্রকাশ : ৩০ জুন ২০২৪, ০২:৫৩ এএম
আপডেট : ৩০ জুন ২০২৪, ০৮:৪৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিদ্যমান পেনশনেই থাকতে চাই

বিদ্যমান পেনশনেই থাকতে চাই

চলতি বছরের ১৩ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারি করা হয় পেনশন-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন। এর আওতাধীন ‘প্রত্যয়’ স্কিমের মাধ্যমে সব স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং তাদের অধীন অঙ্গ-প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর এ প্রজ্ঞাপনকে ‘বৈষম্যমূলক’ আখ্যা দিয়ে তা প্রত্যাহারসহ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য সুপার গ্রেড কার্যকর ও স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তনে কিছুদিন ধরে বেশকিছু কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষকরা। আগামী মাস থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ না নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন তারা। সার্বিক বিষয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব ও ঢাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাবি প্রতিনিধি মো. জাফর আলী

কালবেলা: নতুন পেনশন ব্যবস্থার ‘প্রত্যয়’ স্কিমে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আওতায় আনার পর একে ‘বৈষম্যমূলক’ অভিহিত করে আপনারা আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। আপনাদের আপত্তির জায়গাটা আসলে কোথায়? কেন এটি বৈষম্যমূলক?

অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০২৩ সালের ২৭ আগস্ট যে চারটি স্কিম ঘোষণা করেছিলেন, সেটাকে আমরা অবশ্যই স্বাগত জানাই। সেটি নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমাদের আপত্তি হলো এ বছর জারি করা প্রত্যয় স্কিম নিয়ে। বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক চাকরি শেষে একসঙ্গে বড় অঙ্কের টাকা এবং প্রতি বছর ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট পেতেন, প্রত্যয় স্কিমে সেটা হবে না। এ ব্যবস্থায় বেতন থেকে ন্যূনতম ৫ হাজার টাকা করে জমা দিতে হচ্ছে। এভাবে সবকিছু মিলিয়েই এ প্রত্যয়ে স্কিমে নতুন এবং পুরোনোদের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য তৈরি হবে। এ ছাড়া আমাদের মধ্যে একটা সাংস্কৃতিক দূরত্বও তৈরি হবে। এজন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এই পেনশন ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আরও কিছু দাবি-দাওয়া আছে। যেমন, ২০১৫ সালে আমাদের সুপার গ্রেডের ৬টি পদ দেওয়ার কথা ছিল, সেটা প্ৰতিশ্ৰুতি থাকা সত্ত্বেও দেওয়া হয়নি। আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছি যে, শিক্ষকদের জন্য আলাদা স্বাধীন শিক্ষা কমিশন অথবা স্বতন্ত্র বেতন স্কেল চালু করতে হবে, যা শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে চালু আছে। অর্থাৎ শিক্ষকরা যেন নিজেদের জায়গা থেকে স্বাধীনভাবে তাদের কাজকর্ম করতে পারেন, আমরা সেটাই চাচ্ছি।

কালবেলা: আপনারা বলছেন, প্রত্যয় স্কিমের কারণে ভবিষ্যতে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীরা আসতে নিরুৎসাহিত হবেন। এর কারণ কী বলে আপনারা মনে করেন?

ভূঁইয়া: একজন ছাত্র মনে করছে যে, যেদিন থেকে সে চাকরিতে জয়েন করবে এবং পরে অবসরে যাবে তখন তার বেতন থেকে কোনো টাকা কাটবে না, যেটা এখন বর্তমানে চলমান আছে। কেউ মারা গেলে বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থা অনুযায়ী তার স্পাউস আমৃত্যু পেনশন পায়। কিন্তু প্রত্যয় স্কিমে ৭৫ বছর পর্যন্ত পাওয়ার কথা বলা আছে। ৭৫ বছরের পর সেটা আর থাকবে না। প্রত্যয় স্কিমে বয়সসীমা ৬৫-এর পরিবর্তে ভিন্ন একটি কৌশলের মাধ্যমে ৬০ বছরের মধ্যে আনার পাঁয়তারা করা হচ্ছে। পৃথিবীর সব জায়গায়ই আমলাতন্ত্র আছে। এক্ষেত্রে আমলারা তাদের জায়গায় থেকে সরকারি কাজ করবে, আর শিক্ষকরা তাদের কাজ করবে, সেটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সম্মানটাও আলাদা। কিন্তু আমরা দেখছি, আমলাদের মধ্যকার কোনো একটা গ্রুপ সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য মাঝেমধ্যে বৈষম্য করে থাকে। এজন্য ২০১৫ সালেও বেতন স্কেল নিয়ে আমাদের একটি আন্দোলন করতে হয়েছে। শিক্ষকদের সঙ্গে এমন আচরণ কখনো কাম্য নয়।

কালবেলা: কেউ কেউ প্রত্যয় স্কিম হয় বাতিল, না হয় সর্বজনীন করার কথা বলছেন। এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

ভূঁইয়া: সরকার যদি সর্বজনীন করতে চায়, সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু এ মুহূর্তে আমরা দেখছি, এটা আমাদেরই সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। এজন্য আমরা এটাকে প্রত্যাহার করেছি বা উচিত বলেও মনে করি।

কালবেলা: শিক্ষকদের অনেকেই মনে করছেন, এই স্কিমটি চালু করে একটি মহল সরকার ও শিক্ষকদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?

ভূঁইয়া: স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষা খাতে সবচেয়ে বেশি বাজেট দিয়েছিলেন, কারণ এখানে করা বিনিয়োগই হচ্ছে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ। এমনকি উনার সময়ে প্রথম শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন একজন শিক্ষক। পর্যায়ক্রমে তিনজন শিক্ষককে সচিবও বানানো হয়েছিল তখন। বঙ্গবন্ধু শিক্ষাকেই সবসময় বেশি প্রাধান্য দিতেন। আর পৃথিবীর সব উন্নত দেশগুলোতেও তাই হয়। আজ তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য শিক্ষা খাতে নোবেল পুরস্কার পাচ্ছে কেন? কারণ, তারা এই খাতে বেশি বাজেট বরাদ্দ করছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও শিক্ষাবান্ধব। তিনিও শিক্ষার হার বাড়ানো, সাক্ষরতার হার বাড়ানো এবং গণমুখী থেকে শুরু করে নারী শিক্ষা, প্রতিটি পর্যায়েই পদক্ষেপ নিতে চাচ্ছেন। কিন্তু সরকারের ভেতর থেকে কোনো একটা গ্রুপ হয়ত শিক্ষকদের পছন্দ করছে না। শিক্ষকরা সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন, এখনো আছেন এবং আমরা মনে করি, ভবিষ্যতেও থাকা উচিত। আপনারা সেই সম্মানটুকু যদি না দেন, তা আসলে দুঃখজনক। শিক্ষকদের সঙ্গে কারও দ্বন্দ্ব নেই। সরকারি কর্মকর্তার সম্মান সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে। রাজনীতিকদের সম্মান তাদের কাছে। আমরা সবাই সবার জায়গা থেকে নিজেদের সম্মানটুকু বজায় রাখব। কিন্তু যখন শ্রেণিভেদ করা হয়, তা গ্রহণযোগ্য নয়।

কালবেলা: আপনারা তো বেশ কিছুদিন ধরে নতুন পেনশন ব্যবস্থার ‘প্রত্যয়’ স্কিম বাতিলে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন বা আন্দোলন করছেন। এখন পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে আপনাদের আলোচনা হয়েছে কি? আর দাবি অনুযায়ী কোনো পদক্ষেপ না নিলে আপনাদের অবস্থান কেমন হবে?

ভূঁইয়া: মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। আমরা আমাদের দাবি-দাওয়া জানিয়েছি এবং স্মারকলিপি দিয়েছি। তিনি বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছেন। এ ছাড়া শিক্ষা সচিব ও শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গেও আমাদের শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের কথা হয়েছে। আমরা আশা করছি, সরকার আমাদের যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নেবে।

কালবেলা: প্রত্যয় স্কিম বাতিলের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য সুপার গ্রেড চালুর দাবিও তোলা হচ্ছে। এ বিষয়কে কীভাবে দেখছেন?

ভূঁইয়া: ২০১৫ সালে যখন সুপার গ্রেডের দাবিতে আন্দোলন হয়েছে তখন আমাদের বলা হয়েছিল যে, এটা দেওয়া হবে। এটাও সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, শিক্ষকদের ৬টা পদ দেওয়া হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বারবার দাবি জানানোর পরও তা দেওয়া হচ্ছে না। এটা খুবই দুঃখজনক।

কালবেলা: আপনারা কি মনে করেন যে শিক্ষকদের মতামতের ভিত্তিতে প্রত্যয় স্কিম চালু করা উচিত ছিল?

ভূঁইয়া: প্রত্যয় স্কিম চালু করতে আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি। আলোচনা হলে ম্যানেজমেন্ট, অর্থনীতি এবং কমার্সে আমাদের অভিজ্ঞ শিক্ষকরা এ বিষয়ে মতামত দিতে পারতেন। মূলত, এ সিদ্ধান্তটা এসেছে একটি গ্রুপকে টার্গেট করে।

কালবেলা: যদি কখনো প্রত্যয় স্কিম বাতিল হয়, তারপর সরকার কেমন পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে পারে? আপনাদের কোনো প্রস্তাবনা বা চিন্তা ভাবনা আছে কি না—এ বিষয়ে?

ভূঁইয়া: আমরা বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থাতেই থাকতে চাই, নতুন কিছুতে যেতে চাই না। আর আমাদের একটা দাবি হলো, মেধাবীদের দেশে রাখার জন্য এবং শিক্ষা-গবেষণায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনের জন্য এ খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধিসহ শিক্ষকদের বেতন কাঠামো পরিবর্তন করতে হবে। বঙ্গবন্ধু যেমন শিক্ষাবান্ধব ছিলেন, ঠিক তেমনই আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও শিক্ষা, শিক্ষক ও বিজ্ঞানবান্ধব। আমরা খুব আশাবাদী যে, তিনি আমাদের দাবিগুলো মেনে নেবেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইরাকে তুর্কি বিমান হামলা, ২৪ স্থাপনা ধ্বংস

দ্বিতীয় সেশনেও টাইগারদের দাপট

ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব রক্ষায় ৮ দফা বাস্তবায়নের দাবি ঐক্য পরিষদের

ভিসার মেয়াদ শেষ আজ, কী ঘটবে শেখ হাসিনার ভাগ্যে

লক্ষ্মীপুরে পিটিআই প্রশিক্ষকের অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ

সালমানকে নিয়ে যা বললেন শাবনূর

ট্রাম্পের তথ্য হ্যাক করে বাইডেনকে দিয়েছে ইরান!

শেষ ম্যাচে ৮ উইকেটের বড় জয় বাংলাদেশের

নামাজ পড়ে বাসায় যাওয়া হলো না পুলিশ সদস্য জহিরুলের

বিদেশি শিক্ষার্থী-কর্মীদের কানাডার দুঃসংবাদ

১০

পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ঢাবি প্রশাসনের মামলা

১১

জবির নতুন রেজিস্ট্রার অধ্যাপক শেখ গিয়াস উদ্দিন

১২

ঢাবিতে মব জাস্টিসের প্রতিবাদে ‘ব্রিং ব্যাক জাস্টিস’ কর্মসূচি

১৩

ঢাবিতে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িতদের পরিচয় মিলল

১৪

আ.লীগ নেতা তুষার কান্তি মন্ডল ৭ দিনের রিমান্ডে

১৫

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই গ্রামবাসীর সংঘর্ষে আহত ১৫

১৬

ঢাবি ও জাবিতে ‘পিটিয়ে হত্যা’ দুঃখজনক : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

১৭

জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সম্প্রদায়িক সহিংসতার তদন্ত দাবি ঐক্য পরিষদের

১৮

ঢাবির হলে পিটিয়ে হত্যা, তদন্তে প্রত্যক্ষদর্শীদের সহায়তার আহ্বান

১৯

জাবিতে ছাত্রলীগ নেতা হত্যা নিয়ে আ.লীগের বিবৃতি

২০
X