পানি নিয়ে বিরোধ আজকের ব্যাপার নয়। বস্তুত মানুষে মানুষের যত দ্বন্দ্ব ঘটে থাকে, পানি তার এক প্রাচীনতম কারণ। ইংরেজি রাইভাল (প্রতিদ্বন্দ্বী) শব্দের উৎপত্তি লাতিন রিভেলিস শব্দ থেকে, যার অর্থ ‘একই নদীর জল যারা ব্যবহার করে’। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় নদীর পানি সেচের জন্য টেনে নিয়ে যাওয়া শুরু হওয়ার পর ক্রমেই সেই পানির অনেক রিভেলিস জোটে। পানির শান্তিপূর্ণ বিলিবন্দোবস্তের জন্য নিয়মকানুনের দরকার হয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টাদশ শতকে সুমের রাজা হামুরাবি কিউনিফর্ম হরফে যেসব আইন লিপিবদ্ধ করে গেছেন (যার চেয়ে পুরোনো লিখিত আইনের নজির পৃথিবীতে নেই), তাতে সেচের পানি চুরির জন্য শাস্তির বিধান লেখা আছে।
অনুমান করা যায়, এমন অপরাধ খুব কম হতো না। এই বাংলাদেশে ৫৩ বছরের ইতিহাসে প্রথম তিন বছর সাত মাস আওয়ামী লীগ সরকার দেশ পরিচালনা করেছে। বাকি সময়টা ছিল আওয়ামী সরকারের হাতে দেশ শাসিত হয়েছে এবং সেই সরকারগুলো নিকট প্রতিবেশীর সঙ্গে বৈরিতাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করেছিল। তিস্তা সংকটের সূচনাও বিএনপি সরকার করেছিল। ১৯৭৬ সালে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান তিস্তা ব্যারাজ পরিকল্পনার মাধ্যমে এই সংকট উসকে দেয়। ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করে জিয়া তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণ শুরু করলে ভারতও পাল্টা হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবায় তিস্তা সেচ প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করে। এরপর ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে দ্বিপক্ষীয় সংকট দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান না করে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলে নিয়ে ভারত-বিরোধিতার রাজনীতিকে উসকে দেয়।
১৬ এপ্রিল ১৯৭৫: ঢাকায় ফারাক্কা বাঁধ প্রশ্নে শুরু হয় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মন্ত্রিপর্যায়ের বৈঠক। ১৮ এপ্রিল ফারাক্কা চুক্তি হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী ৫৫ হাজার কিউসেক পানির মধ্যে ৪৪ হাজার কিউসেক পানি বাংলাদেশের জন্য সুনিশ্চিত করা হয়।
১৯৭৭: যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে গঙ্গার পানির হিস্যা ৪৫ হাজার কিউসেক থেকে কমিয়ে ২০ হাজার কিউসেক করা হয়। বিএম আব্বাস এটি-র নেতৃত্বে বাংলাদেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
১৯৭৮: যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে ভারত টিপাইমুখ ব্যারাজের নকশা উপস্থাপন করলে বাংলাদেশ তাতে সম্মতি জানায়।
গঙ্গার পানি বণ্টন সমস্যার সমাধানও করে আওয়ামী লীগ সরকার। দীর্ঘ ২১ বছরে যে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়নি, ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের মাত্র ৯ মাসের মধ্যে সেই সংকটের সমাধান হয়। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত পানি বণ্টন সমস্যার সমাধানে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হয়। সে সময় তিস্তার পানি বণ্টন নিয়েও আলোচনা হয়, যৌথ নদী কমিশনও গঠন করা হয়। কিন্তু কিছু বিষয় নিয়ে পারস্পরিক মতপার্থক্য থাকায় এ নিয়ে চুক্তি হয়নি। সর্বশেষ ভারত সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যমান তিস্তার পানি সমস্যার সমাধানে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। সবচেয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে—এবারে ‘ম্যানেজমেন্ট ও কনজারভেশনের’ মাধ্যমে তিস্তার পানি সংকটেরও সমাধান করা হচ্ছে।
বস্তুত, তিস্তা চুক্তি হওয়ার কথা ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সময়ে। চুক্তিটি না হওয়ার কারণ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধিতা করেছিলেন। তবে এবার তিস্তা বাঁধের বাংলাদেশ অংশে জলাধার নির্মাণ করে বর্ষায় পানি সংরক্ষণ করে শীতের সময়ে ব্যবহারের যে প্রস্তাব চীন দিয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে নদী খনন, নদী শাসন কিংবা অন্যান্য বাঁধের বিষয়ও রয়েছে। চীন পুরো বিষয়ে ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’ তথা বাস্তবায়নযোগ্যতা যাচাইয়ের কথা বলেছে। তবে এখনো ফিজিবিলিটি স্টাডি হয়নি। এরই মধ্যে ভারতও তাতে আগ্রহ দেখিয়েছে। এখানে ভারতের একটি দল এসে তা বাস্তবায়নে কী করা যায়, সেটি দেখবে। স্বাভাবিকভাবে আমরা সেখানে জলাধার নির্মাণ বা যাই করি, তা করতে গেলেও ভারত সরকারের সঙ্গে চুক্তি করা লাগবে। কারণ আমরা ভাটির দেশ। সেজন্য কোন সময় কত পানি পাব, তার ওপর নির্ভর করেই পরিকল্পনা এগোতে হবে।
ধারণা করা যায়, যেহেতু এটি অনেক বড় প্রকল্প হবে, সেজন্য ভারত কিংবা চীনের বাইরেও আন্তর্জাতিকভাবে অন্যান্য দেশকে আমরা এর সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি। যেসব দেশের এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা আছে, যেমন—নেদারল্যান্ডস বা জার্মানি কিংবা যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ যদি এগিয়ে আসতে চায়, তাদেরও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে গঙ্গা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। ২০২৬ সালে গঙ্গার পানি চুক্তির ৩০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। তখন উভয় দেশ আবার এ নিয়ে আলোচনা করবে। তবে গঙ্গা চুক্তি নিয়ে পর্যবেক্ষণ বা অভিমত দেওয়া যেতে পারে। আমরা যখন চুক্তিটি স্বাক্ষর করি, তখন ভারতে কোয়ালিশন সরকার ছিল। সে সময় পশ্চিমবঙ্গের সিপিআইএম ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের অংশ। তা ছাড়া জ্যোতি বসুরও বাংলাদেশের প্রতি বিশেষ সমর্থন ছিল। এখন ৩০ বছর পর নবায়ন আলোচনায় পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূল কংগ্রেস কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধী বলে নরেন্দ্র মোদি চাইলে যে সব করতে পারবেন, তা নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলতে পারেন, আপনারা তো এ সময়ে চুক্তিকে কাজে লাগাননি। সেজন্যই কঠিন দরকষাকষির বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি উত্তর প্রদেশ ও বিহারও তাতে ভেটো দিতে পারে। সেজন্য আমাদের পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে কঠোর অবস্থানের বিকল্প নেই। গঙ্গা এবং তিস্তা-সংক্রান্ত বিষয়গুলো ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত।
আমাদের মনে রাখতে হবে, পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু গঙ্গা চুক্তিকে সমর্থন করেছিলেন, আর সেই কারণে আমরা গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তিটি স্বাক্ষর করতে পেরেছি। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সবসময়ই এ ধরনের চুক্তি বা চুক্তির পক্ষে, তবে তাদের অবশ্যই রাজ্য সরকারের মতামতকে মূল্য দিতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের ভূমিকা, বিশেষ করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সংলাপ এবং কারিগরি পর্যায়ের আলোচনায় তাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের গুরুত্ব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনুধাবন করতে হবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তিস্তাকে ঘিরে আলোচনায় মুখ্যমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের যুক্ত করা দরকার।
২০১১ সালে যখন সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছিল, তখন পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র চুক্তি না করার পক্ষে মতামত দিয়েছিলেন। মূলত, সে সময়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যয় শ্রী কল্যাণ রুদ্রের মতামতের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কয়েক বছর ধরে যা জানা যাচ্ছে, শ্রী রুদ্র আগের অবস্থানে নেই। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর নদীগুলোর ব্যবস্থাপনা বিভক্ত হয়; কিন্তু নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ কিন্তু একই রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা যদি অধ্যাপক কল্যাণ রুদ্রের মতো বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারি, তবে এটি সত্যিই ভালো হবে।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর নদীগুলোর ব্যবস্থাপনা বিভক্ত হয়; কিন্তু নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ কিন্তু একই রয়ে গেছে। ১৯৯৭ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সে লক্ষ্যে জ্যোতি বসুকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ওয়ার্কার্স পার্টির একটি আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার জন্য। জ্যোতি বসু সেই আলোচনা সভায় যোগ দিয়েছিলেন। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত তিস্তাসহ অন্যান্য যৌথ নদী নিয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় পশ্চিমবঙ্গের বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানানো। তা না হলে কেন্দ্রীয় স্তরে পানি বা নদী ব্যবস্থাপনা ঘিরে কী ঘটছে, তা রাজ্য সরকার জানতে পারবে না। তিস্তা নিয়ে যৌথ নদী কমিশন স্তরে এবং দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ে উভয় সরকারই চুক্তির প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে একমত, তবে একটি ঐক্যমতে পৌঁছানোর জন্য আমাদের পশ্চিমবঙ্গকে এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা অত্যন্ত জরুরি।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি যৌথ নদী রয়েছে। তবে শুধু একটি নদী নিয়ে চুক্তি করা গেছে। সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে যৌথ নদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমাদের মধ্যে যৌথ প্রচেষ্টা এবং সমন্বয়ে কোনো ঘাটতি নেই। যেমন এখনকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বর্তমান অবস্থা নিয়ে খোদ পশ্চিমবঙ্গের সুশীল সমাজের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া রয়েছে। আমরা যখনই জেআরসি পর্যায়ে বৈঠক করি, তখন সবসময়ই ২০১১ সালের সমঝোতা স্মারকের নির্দেশাবলি মাথায় রেখে আলোচনা পরিচালিত করি। আমাদের উদ্দেশ্যই থাকে অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনা। ৫৪টি নদীর প্রতিটির জন্য চুক্তি করা বাস্তবসম্মত নয়, সেটি করতে হলে আমাদের বহু বছর অপেক্ষা করতে হবে। তাই আমরা জেআরসিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছি প্রাথমিকভাবে আমরা বেশকিছু নদীকে নিয়ে অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনাকে বিবেচনা করব। এর মধ্যে রয়েছে তিস্তা, মহানন্দা, দুধকুমার, ধরলা, ফেনী, মনু ও খোয়াই। সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নদী ড্রেজিংয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময়ে দাবিনামার মধ্যে নদী ড্রেজিংয়ের দাবি ছিল। ১৯৭৩ সালেই বঙ্গবন্ধু নদী খননে উদ্যোগী হয়েছিলেন। রাজবাড়ীর পাংশায় চন্দনা-বারাসিয়া নদী খননের মধ্য দিয়ে এই কাজের উদ্বোধন করেছিলেন। তিনি তখনই রাষ্ট্রের সীমিত সামর্থ্যরে মধ্যেও কিনেছিলেন অন্ততপক্ষে ৭টি ড্রেজার। সমুদ্র ও নদীবন্দর সংস্কার, নৌযান মেরামত এবং বিদেশ থেকে বার্জ-টাগবোট কেনার ক্ষেত্রে তিনি মোটেও কালক্ষেপণ করেননি। তিনি পাকিস্তানের কারাগার থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে ফিরলেন আর ১৯ মার্চে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকে নদীর প্রসঙ্গ তুলেছিলেন।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক