মুফতি আব্দুর রহমান
প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:০২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সমগ্র সৃষ্টি এক অভিন্ন পরিবার

সমগ্র সৃষ্টি এক অভিন্ন পরিবার

পৃথিবীর সব মানুষকে একটি অভিন্ন সূত্রে গেঁথে দেয় ইসলাম। পৃথিবীর সব মানুষ এক আদম-হাওয়া দম্পতির সন্তান—এই মানবিক পরিচয়ে পৃথিবীর সব মানুষ একীভূত। পৃথিবীর প্রথম দম্পতির মাধ্যমেই বিস্তার লাভ করেছে মানবজাতি। পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে মানববংশ গড়ে তুলেছে হাজারো সমাজ। প্রতিটি সমাজের অতীত ও সূচনা একবিন্দুতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। তাই পৃথিবীতে শান্তি ও স্থিতি গড়ে তুলতে হলে এ মানবিক ও সামাজিক সূত্রে সবাইকে একীভূত হতে হবে। সমাজে মানুষ তার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও গ্রাম-মহল্লার লোকজনের সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করে। তাই সমাজজীবনে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে হলে সমাজের সব ব্যক্তির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। সমাজবদ্ধ হয়েই মানুষকে বসবাস করতে হয়। সমাজে একে অন্যের সহযোগী হয়ে জীবনের পথ চলতে হয়। তাই সামাজিক জীবনে পারস্পরিক বন্ধন ও সাহায্য-সহযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্বজগতের সমগ্র সৃষ্টি একটি অভিন্ন পরিবারের মতো। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার। অতএব আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় সেই ব্যক্তি যে তার সৃষ্টির প্রতি উত্তম আচরণ করে।’ (শুআবুল ইমান: ৭০৪৮)। যেহেতু গোটা সৃষ্টিকুল একটি পরিবারের মতো, তাই সৃষ্টি জীবের সঙ্গে ব্যবহার হবে পরিবারের সদস্যদের মতো ও আত্মীয়স্বজনের মতো। আবার সব মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক হচ্ছে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক। কারণ সব মানুষের পিতা একজন, স্রষ্টাও একজন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানবসমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় করো, যিনি তোমাদের এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছেন; আর বিস্তার করেছেন তাদের দুজন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী।’ (সুরা নিসা: ১)। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘হে মানুষ! নিশ্চয়ই তোমাদের প্রভু একজন। তোমাদের বাবা একজন। তোমরা সবাই আদম-সন্তান। সাবধান! আরবের ওপর কোনো অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই এবং কোনো অনারবের ওপরও আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কোনো কালোর ওপর লাল তথা সুদর্শন ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্ব নেই, শ্রেষ্ঠত্ব নেই সুদর্শনের ওপর কোনো কালোর। শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করা যাবে কেবল তাকওয়া তথা আল্লাহভীতির মাধ্যমে।’ (মুসনাদে আহমাদ: ২৩৪৮৯)।

মানুষের সমাজকে আরও উপমা দেওয়া হয়েছে একটি অভিন্ন দেয়ালের সঙ্গে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘এক মুমিন অন্য মুমিনের জন্য একটি দেয়ালের ইটগুলোর মতো সম্পূরকস্বরূপ—তারা একে অন্যের দ্বারা স্থিতি অর্জন করে। এই বলে তিনি নিজের দুই হাতের আঙুলগুলো পরস্পরের মধ্যে ঢোকালেন।’ (বোখারি: ২৬৪৬)। এ হাদিসে রাসুল (সা.) মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্কের গুরুত্বের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। অন্য হাদিসে আছে, মুসলমান জাতি একটি দেহের মতো। চোখ অসুস্থ হলে গোটা দেহ অসুস্থ হয়। আবার মাথা অসুস্থ হলেও গোটা দেহে এর প্রতিক্রিয়া হয়। মুমিনরা যদি প্রকৃতই পরস্পরের সহমর্মী হয়, তাহলে তাদের একের ব্যথায় অন্যরা ব্যথিত হবে, একের সুখে অন্যরা আনন্দিত হবে। ইসলাম যেহেতু গোটা মানবতাকে একই পরিবারের সদস্য বলে বিবেচনা করে, সুতরাং তাদের মধ্যকার সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য নানাভাবে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ইসলামে বিভিন্ন ইবাদত, বন্দেগির নিয়মপদ্ধতি এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে যে, তার মাধ্যমে যেন মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গে মানবসমাজে শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি ও উন্নয়ন সম্ভব হয়।

ইসলাম যেমনিভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নফল রোজা, জিকির, তাসবিহ-তাহলিলের মতো ইবাদতে উৎসাহ দিয়েছে, তেমনি সমাজের মানুষের কল্যাণে কাজ করাকেও ইবাদত হিসেবে ঘোষণা করেছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, তোমরা পূর্ব ও পশ্চিমে মুখ ফেরাবে। বরং সৎকাজ হলো, তোমরা ইমান আনবে আল্লাহর ওপর, পরকালের ওপর, ফেরেশতাদের ওপর এবং সব কিতাব ও নবী-রাসুলগণের ওপর। পাশাপাশি তোমরা সম্পদ ব্যয় করবে তারই মহব্বতে আত্মীয়স্বজন, এতিম-মিসকিন, মুসাফির, ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্য। আর যারা নামাজ কায়েম করে, জাকাত আদায় করে এবং যারা কৃতপ্রতিজ্ঞা পালনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য ধারণকারী; তারাই সত্যাশ্রয়ী ও আল্লাহভীরু।’ (সুরা বাকারা: ১৭৭)। এ আয়াতে আল্লাহতায়ালা মুত্তাকি তথা আল্লাহভীরুদের গুণাবলিতে একদিকে যেমন ইমান ও নামাজের মতো মৌলিক ইবাদতের কথা উল্লেখ করেছেন, তেমনি অন্যদিকে তিনি জাকাত এবং সমাজের অসহায় নিঃস্বদের সাহায্য-সহায়তার মতো সামাজিক কার্যক্রমের কথাও উল্লেখ করেছেন। এ থেকে বোঝা যায়, ব্যক্তিগত ইবাদত-বন্দেগির পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্ব পালনও ইবাদত হিসেবে গণ্য।

সমাজ জীবনের ভারসাম্য, শৃঙ্খলা, উন্নতি ও অগ্রসরতা অব্যাহত রাখতে পারস্পরিক সৌজন্যতা, মূল্যবোধ ও শিষ্টাচারের গুরুত্ব অপরিসীম। কোনো জাতিকে সুসভ্য ও সফল রূপে প্রতিষ্ঠিত হতে এর বিকল্প নেই। আমাদের বিদ্যমান অশান্ত সমাজে শান্তি ও স্থিতি আনতে হলে সবাইকে শিষ্টাচারসম্পন্ন হতে হবে। কারণ শিষ্টাচারসম্পন্ন মানুষ কোনো তুচ্ছ বিষয়ে নিজেকে জড়ায় না, কারও সঙ্গে শত্রুতা করে না বা কারও স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটানোর চেষ্টা করে না। শিষ্টাচার হচ্ছে ভদ্র, মার্জিত ও রুচিসম্মত আচরণ। একজন মানুষ ভালো না মন্দ, তা বিবেচিত হয় মূলত সে ব্যক্তির আচরণ দেখেই। এ গুণ মানুষকে সংযমী ও বিনয়ী করে তোলে। শিষ্টাচারসম্পন্ন ব্যক্তি তার ভদ্র ও সংযত ব্যবহার দিয়ে যে কোনো পরিস্থিতিতে যে কোনো পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে। এমন মানুষকে সবাই শ্রদ্ধা করে; হোক সে ব্যক্তি অসুন্দর কিংবা গরিব। ইসলামেও আদব শিষ্টাচার ও সৌজন্যতাকে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছে।

শিষ্টাচারের গুরুত্ব সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই উত্তম চরিত্র, ভালো ব্যবহার ও পরিমিত ব্যয় বা মধ্যপন্থা অবলম্বন করা নবুয়তের পঁচিশ ভাগের এক ভাগ।’ (আবু দাউদ: ৪৭৭৬)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘তুমি আদব ও শিষ্টাচার অন্বেষণ করো। কারণ আদব হলো বুদ্ধির পরিপূরক, ব্যক্তিত্বের প্রমাণ, নিঃসঙ্গতায় ঘনিষ্ঠ সহচর, প্রবাসজীবনের সঙ্গী এবং অভাবের সময়ে সম্পদ।’ (গিজাউল আলবাব: ১/৩৬-৩৭)। বিশিষ্ট ফকিহ আহনাফ আল-কায়েস বলেন, ‘আদব বা শিষ্টাচার বিবেকের জ্যোতি, যেমন আগুন দৃষ্টিশক্তির জ্যোতি।’ (ফাতাওয়া আল মিসরিয়া: ১০/৩৫৯)। রুওয়াইম ইবনে আহমাদ আল-বাগদাদি তার ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘তুমি তোমার আমলকে লবণ ভাববে আর তোমার আদবকে মনে করবে ময়দা।’ (ড. আলী আব্দুল হামীদ, আত-তাহজিলুদ দিরাসি বিল কাইয়েমিল ইসলামিয়াহ: পৃ. ১৫৪; আল-কুরাফি, আল-ফুরূক: ৩/৯৬)। অর্থাৎ তুমি আমলের চেয়ে আদব ও শিষ্টাচারকে এত অধিক গুরুত্ব দেবে, লবণ ও ময়দার স্বাভাবিক মিশ্রণে উভয়ের অনুপাত যেভাবে কমবেশি হয়।

আল্লাহ পৃথিবীর সব মানুষকে সম্মান দিয়েছেন। সম্মানিত করেই সৃষ্টি করেছেন। সব মানুষই সম্মানিত। মানবজাতির এ সম্মান ও মর্যাদা সর্বজনীন। প্রতিটি মানুষ সে বিশ্বাসী হোক বা অবিশ্বাসী মৌলিক সম্মান ও অধিকারের ক্ষেত্রে সমান। পবিত্র কোরআনের বর্ণনা থেকেও ‘সাধারণ সম্মান সব মানুষের জন্য’ প্রমাণিত হয়। আল্লাহ বলেন, ‘আমি মানবজাতিকে সম্মানিত করেছি, তাকে কর্তৃত্ব দিয়েছি স্থলে ও জলে, তাদের দিয়েছি উত্তম জীবিকা এবং তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি আমার সৃষ্টিজগতের অনেকের ওপর।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ৭০)। রাসুলুল্লাহ (সা.)ও ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে মানুষকে সম্মান দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পাশ দিয়ে একটি লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। তাকে বলা হলো, লাশটি একজন ইহুদির। রাসুল (সা.) বললেন, সে কি মানুষ নয়?’ (মুসলিম, হাদিস: ৯৬১)। মানুষের সম্মানসংক্রান্ত আয়াতে আল্লাহ যেমন বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীর মধ্যে পার্থক্য করেননি, তেমন মৌলিক অধিকারসংক্রান্ত আয়াতেও তা করা হয়নি। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ যাকে হত্যা করা নিষিদ্ধ করেছেন তাকে তোমরা আইনানুগ কারণ ছাড়া হত্যা কোরো না।’ (সুরা আনআম, আয়াত: ১৫১)। এসব আয়াতের ভিত্তিতে ইসলামী আইনবেত্তারা বলেন, ‘মানুষ সত্তাগতভাবে সম্মানী। সুতরাং তাকে অপমান করা, তার প্রতি অবিচার করা, তার অধিকার নষ্ট করা, সম্মানহানি করা অন্য কোনো মানুষের জন্য বৈধ নয়। সবার প্রতি সুবিচার নিশ্চিত করা আবশ্যক। মোটকথা, পৃথিবীর সব মানুষকেই মানুষ হিসেবে সম্মান দিতে হবে, অধিকার আদায় ও রক্ষা করতে হবে, মানবিক ও সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে হবে। সুন্দর সামাজিক সম্পর্ক প্রকৃত মুমিন ও বিশ্বাসী মানুষের বৈশিষ্ট্য।

লেখক: মাদ্রাসা শিক্ষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বেবিচক তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ : চেয়ারম্যান

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় টাকা ভাংতি নিয়ে বিরোধ, একজনকে কুপিয়ে হত্যা

তিন ঘণ্টা নিজ দপ্তরে অবরুদ্ধ এনবিআর চেয়ারম্যান

আদালত চত্বরে জামাই-শ্বশুরের মারামারি

‘অসাধারণ’ ছুটিতে ঢাবির সাবেক ভিসি অধ্যাপক মাকসুদ কামাল 

স্টারলিংকের লাইসেন্স হস্তান্তর করল বিটিআরসি

সেই অটোরিকশা নিয়ে বুয়েট শিক্ষকের স্ট্যাটাস

জাহাজ চলাচল নিরাপদ ও ডিজিটাল করতে বিএসসিএল-স্টারনুলারের এমওইউ

কেরানীগঞ্জে এলজিইডি অফিসে দুদকের অভিযান

পাকিস্তানকে ভয়ংকর ক্ষেপণাস্ত্র দিল চীন, উদ্বিগ্ন ভারত

১০

‘হানিট্র্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়’ : বছরে ৩৫০০ কোটি খরচ পাকিস্তানের

১১

‘আমরা সেই চোরাবালিতে ডোবার চেষ্টা করছি’

১২

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত হলো ‘গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফোরাম ফর ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস ২০২৫’

১৩

‘আ.লীগ নামে কোনো রাজনৈতিক দল রাজনীতি করতে পারবে না’

১৪

এসএসসির নবম দিনে অনুপস্থিত ২৮ হাজার, বহিষ্কার ৩৪

১৫

দেশে ফিরবেন খালেদা জিয়া, প্রস্তুত হচ্ছে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স

১৬

সব শর্ত মেনে আইএমএফের ঋণ নেওয়া হবে না : অর্থ উপদেষ্টা

১৭

জামায়াতের সদস্য ফরম পূরণ করলেন আ.লীগ নেতা, ছবি ভাইরাল

১৮

তিতাসে জেলের জালে ২৫ কেজির বোয়াল মাছ

১৯

রিশাদকে ‘অনুপ্রেরণা’ মানেন জিম্বাবুয়ের মাসাকেসা

২০
X