ইসলামের পাঁচটি মূল ভিত্তির একটি হজ। বছর ঘুরে আবারও এসেছে পবিত্র হজের মৌসুম। হজ পালনের মৌসুম হিসেবে মহান আল্লাহ তিনটি মাসকে নির্ধারণ করেছেন, যথা—শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ। এজন্য এই মাসগুলোকে ‘আশহুরুল হজ’ তথা ‘হজের মাসসমূহ’ বলা হয়। অবশ্য হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয় মাত্র এক থেকে পাঁচ দিনে। চাঁদের হিসাবে প্রতি বছর জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ সময়ের মধ্যে হজের কার্যক্রম আদায় করতে হয়। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে চলতি বছরের ৪ বা ৫ জুন (৯ জিলহজ) পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ থেকে এবার হজ ফ্লাইট শুরু হবে ২৯ এপ্রিল। এ বছর হজে যাওয়ার জন্য চূড়ান্ত নিবন্ধন করেছেন ৮৭ হাজার ১০০ জন বাংলাদেশি। এ হজব্রত পালনের জন্য প্রতিটি মুসলমান উদগ্রীব থাকে এবং সৌভাগ্যবান ব্যক্তিরা চরম আবেগ ও ব্যাকুলতা নিয়ে মক্কার তীর্থভূমিতে ভ্রমণ করে। উদ্দেশ্য, করুণাময় মহান প্রতিপালকের দান ও ইহসানে ধন্য হওয়া, পুরস্কার ও প্রতিদানে কৃতার্থ হওয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে অনেকে খালি হাতে যায়, আবার খালি হাতেই ফিরে আসে। প্রাপ্তির ঝুলিতে কিছুই পড়ে না। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই হজের উদ্দেশে রওনা হয়ে যাওয়া। তাই আল্লাহ যাদের বায়তুল্লাহ হজের জন্য কবুল করেছেন, তাদের কর্তব্য সফরে রওনা হওয়ার আগেই হজের প্রতি ঐকান্তিক হওয়া এবং সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করা।
হজের সফরে যারা যাচ্ছেন, তাদের বেশ কিছু প্রস্তুতি নিতে হয়। মানসিক ও শারীরিক দুই প্রকার প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। কারণ ইসলামের কিছু বিধান শারীরিক, কিছু আর্থিক আর কিছু শারীরিক ও আর্থিক উভয়টির সমন্বয়ে। নামাজ ও রোজা শুধু শারীরিক ইবাদত, জাকাত আর্থিক ইবাদত আর হজ হলো শারীরিক ও আর্থিকের সমন্বিত ইবাদত। ইসলামের এ বিধান পালনের জন্য বান্দাকে যেমন অর্থ খরচ করতে হয়, তেমনি শারীরিক অনেক পরিশ্রমও করার প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে হজের মূল দিনগুলোয় অর্থাৎ ওমরার তাওয়াফ, সাঈ, মিনা, জামারায় পাথর মারা, মিনা থেকে মক্কায় গিয়ে হজের তাওয়াফ, সাঈ ইত্যাদি কার্য সম্পাদন করতে প্রচুর হাঁটাচলা করতে হয়। চাইলে যখন-তখন যানবাহন পাওয়া যায় না। থাকা-খাওয়ার জন্যও বহু সমস্যা ও পেরেশানির মুখোমুখি হতে হয়। ইহরাম বাঁধার পর আর মুক্ত স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা যায় না এবং অভ্যস্ত ও নিয়মিত ক্রিয়াকলাপও সম্পাদন করা যায় না। বরং বহু অভ্যস্ত বিষয় পরিহার করে অনভ্যস্ত বিষয় পালন করতে হয় এবং নতুন নতুন কাজের মুখোমুখি হতে হয়। এমনকি হজ পালনকারী এতদিন নিজ এলাকায় নিয়মিত যেসব ইবাদত করেছেন তার মধ্যেও পরিবর্তন দেখা যায়। সারা জীবন জোহর-আসর, মাগরিব-এশা নির্দিষ্ট সময়েই আদায় করেছেন; কিন্তু হজে এসে জোহর-আসরকে জোহরের সময় এবং মাগরিব-এশাকে এশার সময় আদায় করতে হয়। তাই হজের যাবতীয় অনুষ্ঠান ও আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে এবং সুস্থ-সবল শরীরে গন্তব্যে রওনা হতে হবে।
হজ যেমন একটি শারীরিক ইবাদত, তেমনি একটি অর্থনৈতিক ইবাদতও। কষ্ট, ক্লেশ ও শ্রম ব্যয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর টাকা-পয়সারও প্রয়োজন হয়। তাই হজের সফরে রওনা হওয়ার আগে অর্থনৈতিক প্রস্তুতিও পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে হয় এবং হজ পালনের যাবতীয় ব্যয় হালাল ও বৈধ উৎস থেকে বহন করতে হয়। কেননা ইবাদত-বন্দেগি ও দোয়া-প্রার্থনা কবুলের জন্য হালাল, পবিত্র ও অনুমোদিত রিজিক হওয়া অন্যতম প্রধান শর্ত। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, একদিন রাসুল (সা.) বললেন, ‘হে লোকসকল! নিঃসন্দেহে আল্লাহ পবিত্র। তিনি কেবল পবিত্র বস্তুই গ্রহণ করেন। সব রাসুলকে তিনি যে আদেশ দিয়েছেন, মুমিনদেরও সেই আদেশ দিয়েছেন।’ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে রাসুলগণ! আপনারা উত্তম ও পবিত্র রিজিক আহার করুন এবং সৎকর্ম করুন। আপনারা যেসব আমল করেন আমি সে সম্পর্কে পূর্ণ অবগত।’ (সুরা মুমিনুন: ৫১)। আরও বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা হালাল ও উত্তম রিজিক আহার করো, যা আমি তোমাদের দিয়েছি।’ (সুরা বাকারা: ১৭২)। অতঃপর নবীজি এলোকেশী ও ধুলোমলিন হয়ে দীর্ঘ সফরকারী এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যাক আসলে দেখে হাত প্রসারিত করে হে আমার প্রতিপালক! হে আমার প্রতিপালক! বলতে থাকে। অথচ তার খাবার হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম এবং হারাম বস্তু দ্বারায় প্রতিপালিত। তো এসবের পর কীভাবে তার দোয়া কবুল করা হবে! (মুসলিম: ১০১৫)।
ইসলামে হজের ইবাদত মূলত আধ্যাত্মিক প্রেমের অবগাহন। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যকার আবেগ ও ভক্তির মহামিলন। শুভ্র-সুন্দর পোশাক পরে সমস্বরে তালবিয়া ধ্বনি, কাবার চারিপাশে তাওয়াফ, সাফা-মারওয়ার মাঝে সাঈ, মুজদালিফা ও আরাফায় অবস্থান, জমারায় রমি, মিনায় কোরবানি—মহান স্রষ্টার প্রতি নগণ্য সৃষ্টির প্রেম নিবেদনমূলক এসব কীর্তি একজন মানুষ নিবিষ্ট চিত্তে তখনই আদায় করতে পারে; যখন দুনিয়ার সব ঝামেলা ও ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর ঘর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। তাই দুনিয়ার ঝক্কি-ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ একাগ্র চিত্ত নিয়ে হজব্রত পালন করতে যেতে হবে। দুনিয়াবি ব্যস্ততা ও কাজকর্ম থেকে ফারেগ হয়ে আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন হওয়ার উৎসাহ এসেছে হাদিসে কুদসিতে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে আদম সন্তান! আমার ইবাদতের জন্য তুমি ঝামেলামুক্ত হও, আমি তোমার অন্তরকে প্রাচুর্য দিয়ে ভরে দেব এবং তোমার দারিদ্র্য ঘুচিয়ে দেব। যদি তা না করো তবে তোমার হাত ব্যস্ততায় ভরে দেব আবার অভাবও দূর করব না।’ (তিরমিজি: ২৪৬৬)।
যে কোনো কাজ সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে পালনের অন্যতম শর্ত হচ্ছে, কাজটি সম্পর্কে সম্যক অবগতি লাভ করা এবং ইতিপূর্বে যারা কাজটি করেছেন তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া। ইসলামের অন্যতম রোকন হজের বিধান সর্বাঙ্গ সুন্দররূপে আদায় করতে হলেও এ সম্পর্কে পূর্ণ অবগতি লাভ করতে হবে। ইহরাম, তালবিয়া, তাওয়াফ, সায়ি, উকুফে মুজদালিফা, উকুফে আরাফা, রমি, কোরবানি প্রভৃতি বিধিবিধান সম্পর্কে জানতে হবে। প্রয়োজনীয় বিভিন্ন দোয়া, বিশেষ করে তালবিয়া তথা ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্নিমাতা লাকা ওয়ালমুল্ক লা শারিকা লাক’ শিখতে হবে। তা ছাড়া আল্লাহতায়ালা যাদের হজ পালনের অপূর্ব সৌভাগ্য দ্বারা ধন্য করেছেন এমন প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা থেকে উপকৃত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হজ ক্যাম্প বা এজেন্সিগুলোও হজের প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। হজে যাওয়ার আগে এসব ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ নিলে হজের আমলগুলো আদায়ের নিয়ম খুব সহজে রপ্ত হয়। রাসুল (সা.) হজ পালন করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে এই বলে হজের বিধান শিখতে উদ্বুদ্ধ করেছেন যে, ‘তোমরা আমার থেকে হজের বিধিবিধান শিখে নাও।’ (নাসায়ি: ৩০৬২)।। সাহাবা, তাবেঈন, তাবে তাবেঈনসহ পরবর্তী সবাই নবীর শিক্ষা ও উপদেশ মেনে হজের বিধান পালন করেছেন। আল্লাহ পাকের যে কোনো বিধান পালনের আগে সে বিধান সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা ফরজ। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ইলম অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ।’ (ইবনে মাজা: ২২৪)।
হজ ফরজ হওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে সফরকালে পরিবারের খাদ্যবস্ত্রের ব্যবস্থা করে যাওয়ার সামর্থ্য থাকা। তাই সফরের এক-দেড় মাস সময়ে পরিবারের সদস্যরা কোথা থেকে প্রয়োজন মেটাবে তার ব্যবস্থা, দিকনির্দেশনা ও অর্থে জোগান দিয়ে যেতে হবে। যাতে গৃহকর্তার অবর্তমানে পরিবারের কেউ সংকট-সমস্যার সম্মুখীন না হয়। কেউ যদি কোনো টাকা পায় তাহলে যথাসম্ভব আদায় করে যেতে হবে। আদায় করা সম্ভব না হলে সময় চেয়ে নিতে হবে এবং এ ধরনের ঋণের কথা পরিবারের লোকজনের কাছে বলে যেতে হবে। কেননা জীবন-মৃত্যুর সময়-সন্ধিক্ষণ অনিশ্চিত। যে কোনো সময় যে কারও মৃত্যুর যবনিকাপাত ঘটতে পারে। একইভাবে যদি বোনের অংশ না দেওয়া হয়ে থাকে অথবা শয়তানের প্ররোচনায় যদি কারও হক নষ্ট করা হয়ে থাকে, তাহলে হজের আগে অবশ্যই তার সমাধান করে যেতে হবে। মানুষের হক মেরে, অধিকার খর্ব করে হজের প্রকৃত প্রাপ্তি ও সুফল লাভ করা সম্ভাব হবে না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, হজে যাওয়ার সময় অন্তরে রিয়া, লৌকিকতা ও মানুষের স্তুতি-বন্দনার লোভ না রেখে শুধু আল্লাহতায়ালার সন্তোষ ও সন্তুষ্টি লাভের প্রত্যাশা রাখতে হবে। কেননা যে কোনো আমল আল্লাহতায়ালার দরবারে গ্রহণযোগ্য ও পুরস্কারের উপযুক্ত হওয়ার জন্য জরুরি হলো ইখলাস ও লিল্লাহিয়াত। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সব আমল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল; মানুষ যা নিয়ত করবে তাই পাবে।’ (বোখারি: ১)।
সুতরাং হজ পালনে যদি লোকদেখানো উদ্দেশ্য থাকে এবং ইখলাস ও লিল্লাহিয়াত অনুপস্থিত থাকে তাহলে পুরস্কার পাওয়া তো দূরের কথা, আল্লাহতায়ালার কাছে তা গ্রহণীয় বলেই বিবেচিত হবে না। মহান আল্লাহ সবাইকে তওফিক দান করুন।
লেখক: ইমাম ও খতিব
মন্তব্য করুন