মুসলিম উম্মাহর জীবনে পবিত্র রমজানের আগমন হয় বহুমুখী শিক্ষা ও দীক্ষার বার্তা নিয়ে। মানুষের দৈহিক, মানসিক, আত্মিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নের মাস রমজান। সংযম, সহিষ্ণুতা ও আত্মশুদ্ধির অনন্য চেতনায় ভাস্বর পবিত্র রমজান। মহানবী (সা.) এ মাসকে এক সুমহান মাস হিসেবে অভিহিত করেছেন। পবিত্র কোরআন ও হাদিস শরিফে রোজার অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। আমরা রোজার ফাজায়েল-মাসায়েল কমবেশি জানলেও রোজাকে পবিত্র ও ত্রুটিমুক্ত রাখার বিষয়টি অনেকেই জানি না বা জানলেও মেনে চলার চেষ্টা করি না। মহান আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের আশায় ১২-১৪ ঘণ্টা উপোস থেকে, কষ্ট করে রমজানের রোজা রাখছি, কিন্তু আমার রোজা আল্লাহর দরবারে কবুল হচ্ছে না। সওয়াব পাচ্ছি না। সেহরি থেকে ইফতার পর্যন্ত উপোস থাকা ছাড়া কিছু অর্জন হচ্ছে না।
হাদিস শরিফে আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, অনেক রোজাদার এমন আছে যে, তাদের রোজা থেকে উপোস থাকা ছাড়া আর কিছুই অর্জিত হয় না। আর অনেক রাত্রি জেগে ইবাদতকারী এমন আছে যে, তাদের সে ইবাদত থেকে রাত জাগরণ ছাড়া আর কিছুই থাকে না (মেশকাত: ১১৭)। যেসব কারণে আমাদের রোজা ত্রুটিযুক্ত হয় এবং সওয়াব কম হয় তার একটি হচ্ছে মিথ্যা বলা। অনেকে রোজা রেখেও অবলীলায় মিথ্যাচার করে যাচ্ছে। রোজা রেখে মিথ্যা কথা বললে সে রোজা ত্রুটিযুক্ত হয়ে যায়। আল্লাহর কাছে কবুল হয় না। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা বলা ও তার ওপর আমল করা পরিহার করল না, তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই (বোখারি: ১৯০৩)। মিথ্যা কথা ও মন্দ কাজ পরিত্যাগ না করলে তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই—এর ব্যাখ্যা হলো, রোজার উদ্দেশ্য হচ্ছে মনোবাসনাকে পরিত্যাগ ও কুমন্ত্রণা দানকারী আত্মাকে বশে আনা। অতএব, রোজা রেখে যখন এর উদ্দেশ্য অর্জন করা যায়নি তখন সেই রোজার পরোয়া আল্লাহ করেন না। অতএব, আল্লাহর প্রয়োজন না হওয়ার অর্থ দাঁড়াল, আল্লাহতায়ালা তার রোজার প্রতি ভ্রুক্ষেপ ও কবুল করেন না। (ফয়জুল কালাম: ৩৯৮)।
মিথ্যা কথা বলা মারাত্মক বড় একটি গুনাহ। মিথ্যা ইসলামের দৃষ্টিতে অতি গর্হিত, অবশ্যবর্জনীয়। মিথ্যাবাদিতা মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ মিথ্যাবাদীর শাস্তির কথা উল্লেখ করে ইরশাদ করেছেন, ‘তাদের হৃদয়ে আছে একটি রোগ, আল্লাহ সে রোগ আরও বেশি বাড়িয়ে দিয়েছেন, আর যে মিথ্যা বলে তার বিনিময়ে তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি (সুরা বাকারা: ১০-১২)। আল্লাহতায়ালা বলেন, মিথ্যা তো তারাই বানায় যারা আল্লাহর নিদর্শনগুলোর ওপর ইমান রাখে না। বস্তুত তারাই মিথ্যাবাদী (সুরা নাহল: ১০৫)। অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘মিথ্যাবাদীদের ওপর অভিসম্পাত।’ (সুরা আলে ইমরান: ৬১)। আল্লাহতায়ালার লানত বা অভিশাপের চেয়ে বড় বিষয় আর কী হতে পারে!
রোজা আসে জাহান্নাম থেকে মুক্তির বার্তা নিয়ে। অথচ মিথ্যা বলে জাহান্নামের পথে এগিয়ে যায় মানুষ। মিথ্যা মানুষকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘সত্যবাদিতা হচ্ছে শুভ কাজ। আর শুভ কাজ জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। বান্দা যখন সত্য বলতে থাকে, একসময় আল্লাহর কাছে সে সত্যবাদী হিসেবে পরিগণিত হয়। আর মিথ্যা হচ্ছে পাপাচার, পাপাচার জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়, বান্দা যখন মিথ্যা বলতে থাকে, আল্লাহর কাছে একসময় সে মিথ্যুক হিসেবে গণ্য হয় (বোখারি: ৫৭৪৩)। রোজাকে ত্রুটিমুক্ত করে আল্লাহর দরবারে কবুলযোগ্য করতে এই মাহে রমজানে মিথ্যা বলা থেকে বাঁচতে হবে।
রোজা রেখে গালমন্দ ও অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ করা যাবে না। আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যখন তোমাদের কারও সিয়ামের দিন হবে, সে যেন অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ না করে এবং হৈ-হট্টগোল না করে। আর যদি কেউ গালাগালি করে অথবা তার সঙ্গে লড়াই ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে যে, ‘আমি সিয়াম পালনকারী’ (বোখারি: ১৯০৪)। অন্য হাদিসে আছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, কেবল পানাহার থেকে বিরত থাকার নামই সিয়াম নয়। সিয়াম তো অসার, বাজে ও অশ্লীল কথা থেকে বিরত থাকার নাম। যদি তোমাকে কেউ গালি দেয় অথবা তোমার সঙ্গে কেউ মূর্খতাসুলভ আচরণ করে তবে তাকে বলো, ‘আমি রোজাদার, আমি রোজা রেখেছি।’ (মুসতাদরাকে হাকেম: ১৫৭০)। যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা বলা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া, মিথ্যা অপবাদ দেওয়া, গিবত করার মতো অপরাধ থেকে বিরত হয় না, তার রোজা রোজা নয় বরং উপবাস থাকা। সে রোজার কোনো সওয়াব পায় না, তবে ফরজ আদায় হয়ে যায়।
আল্লাহতায়ালা sরোজার মাধ্যমে মানুষের কুপ্রবৃত্তিকে দমন করেন; রিপুর তাড়না থেকে মুক্ত করেন এবং অন্তরে জাগ্রত করেন প্রেম, তাকওয়া। আর এ ভালোবাসাই মানুষকে নিয়ে যায় সত্য-সুন্দর ও মুক্তির পথে। রোজা রাখার মাধ্যমে গুনাহের কাফফারা হয় এবং মাগফিরাত লাভ হয়। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় রমজানে রোজা রাখবে, তার আগের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। (বোখারি)। অন্য এক হাদিসে রাসুল (স.) এরশাদ করেন, জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে, যাকে বলা হয় ‘রাইয়ান’। কেয়ামতের দিন এ দরজা দিয়ে রোজাদাররা প্রবেশ করবে। অন্য কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (বোখারি)। রমজানে যতটা সম্ভব কোরআন তেলাওয়াত করতে হবে। কারণ কোরআন তেলাওয়াত হলো সর্বোত্তম জিকির। এ ছাড়া তসবিহ-তাহলিল আদায় করতে হবে। বেশি বেশি ইস্তেগফার পড়তে হবে। হৃদয়ছোঁয়া ছোট্ট এই দোয়া পড়ুন—রাব্বিগফির, ওয়ারহাম, ওয়া আন্তা খাইরুর রাহিমিন—হে আমার রব, আমাকে ক্ষমা করুন, দয়া করুন, আপনি তো দয়ার আধার, সর্বশ্রেষ্ঠ দয়াবান। এ ছাড়া নফল নামাজগুলো, যেমন—এশরাক, আওয়াবিন আদায় করুন। বিশেষ করে শেষ রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ুন। আল্লাহতায়ালা রাতের ওই নির্জনে বান্দার দোয়া কবুল করেন।
শুধু পানাহার বর্জন করার নামই রোজা নয়। আলেমরা বলেন, রোজা তিন ধরনের—১. সাধারণের রোজা: তারা শুধু পানাহার ও স্ত্রীগমন থেকেই বিরত থাকে। ২. বিশিষ্ট ব্যক্তিদের রোজা: তারা শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও ইন্দ্রিয় শক্তিগুলোকে সব ধরনের আনন্দ উপভোগ, হারাম-মাকরুহ এবং মনোবাসনা পূরণ থেকে বিরত রাখে এবং কুমন্ত্রণা দানকারী আত্মা দমন করার সব পথ অবলম্বন করে। ৩. সর্বোচ্চ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের রোজা: তারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য সবকিছু থেকে বিরত থাকে (ফয়জুল কালাম: ৩৯৮)।
মিথ্যা, গিবত, পরনিন্দা ইত্যাদি গর্হিত কাজ পরিত্যাগ করে আল্লাহতায়ালার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের জন্য রোজা রাখার তাওফিক দান করুন।
লেখক: ইমাম ও খতিব
মন্তব্য করুন