মুহাম্মাদ শাওন মাহমুদ
প্রকাশ : ১৯ মে ২০২৪, ০২:৪২ এএম
আপডেট : ২০ মে ২০২৪, ০২:৫৮ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কোয়ান্টাম ইন্টারনেটের সুপারপাওয়ার!

কোয়ান্টাম ইন্টারনেটের সুপারপাওয়ার!

ধরুন, আপনি এমন একটা ইন্টারনেট সার্ভিস ব্যবহার করেন, যার মাধ্যমে কখনোই আপনার তথ্য চুরি করা যাবে না। যাকে এক কথায় বলা যায় ‘হ্যাকার—প্রুফ’! কিংবা সাড়ে ৮ হাজার মাইল দূরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আপনার আত্মীয় আপনাকে এক হাজার গিগাবাইটের একটি ভিডিও পাঠাবে। কিন্তু তা সময় নিয়ে ডাউনলোড করতে হবে না, বরং পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে আপনার ডিভাইসে দৃশ্যমান হবে! প্রচলিত ইন্টারনেট ব্যবস্থায় এটাকে অবাস্তব মনে হলেও, এটি সম্ভব কোয়ান্টাম ইন্টারনেটের রাজত্বে।

আমরা বর্তমানে যে ইন্টারনেট পদ্ধতি ব্যবহার করি, সেটিকে ‘ক্লাসিক্যাল ইন্টারনেট’ ব্যবস্থা বলা হয়। ধরুন দুটি পয়েন্ট A এবং B একটি অপটিকাল ফাইবার দ্বারা সংযুক্ত। এক পয়েন্ট থেকে আরেক পয়েন্টে বাইনারি (০ এবং ১) আকারে তথ্য বা ডাটা আদান-প্রদান করা হচ্ছে। এই ০ এবং ১ সংখ্যা দুটিকে বলা হয় বিট এবং ৮ বিটকে একসঙ্গে বলা হয় বাইট। এভাবে কাজ করে প্রচলিত ইন্টারনেট ব্যবস্থা। অন্যদিকে কোয়ান্টাম ইন্টারনেট ব্যবস্থাতেও এমন দুটি পয়েন্ট থাকবে, যা উন্নত টেলিযোগাযোগ মাধ্যম দ্বারা সংযুক্ত থাকবে, এবং দুটি পয়েন্টে বিট নয় বরং আলোর ‘কিউবিট’ আকারে ডাটা স্থানান্তর হবে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ‘হার্ভার্ড কোয়ান্টাম ইনিশিয়েটিভ’ টিমের পদার্থবিদরা দুটি ‘কোয়ান্টাম মেমোরি’কে (অসম্পূর্ণ কোয়ান্টাম কম্পিউটার) সফলভাবে একটি টেলিযোগাযোগ কেবল দ্বারা সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রায় ২২ মাইল লুপে ঘুরে আসা এই সংযোগ কোয়ান্টাম ইন্টারনেটের গবেষণায় বড় এক মাইলফলক! কেননা, কোয়ান্টাম ইন্টারনেটের ‘সুপার-পাওয়ার’ সম্পর্কে এতদিন যা ছিল শুধু কাগজে-পাতায়, তা এখন রূপ নেবে বাস্তবে।

কোয়ান্টাম ইন্টারনেট সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পেতে প্রথমে আমাদের কোয়ান্টাম তত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটার সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকা প্রয়োজন।

কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের কাণ্ডজ্ঞান!

একটি শিশু যখন প্রথম হাঁটতে শেখে, তখন সে দেয়ালের সঙ্গে অনেকবার ধাক্কা খেয়ে বুঝে ফেলে যে, দেয়াল ভেদ করে ওপারে যাওয়া সম্ভব নয়। কোয়ান্টাম তত্ত্বে এমনটা ঘটে না। এখানে কোয়ান্টাম কণা দেয়াল ভেদ করেও চলে যেতে পারে।

আবার ধরুন একটি বাক্সে একটি কালো ও একটি সাদা বল আছে। আপনি ও আপনার বন্ধু চোখ বন্ধ করে দুটি বল তুলে নিয়ে একজন জাপানে আরেকজন হনুলুলু চলে গেলেন। জাপান পৌঁছে যদি দেখতে পান আপনি সাদা বল নিয়ে এসেছেন, তখন কিন্তু আপনি নিশ্চিত হয়ে গেলেন, পৃথিবীর অন্য প্রান্তে আপনার বন্ধুটি নিঃসন্দেহে কালো বল নিয়ে গেছে। এটাই আপাতদৃষ্টিতে যৌক্তিক মনে হলেও কোয়ান্টাম জগতে এমনটা হবে না। কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুযায়ী পুরো যাত্রা—পথে আপনার কাছে যে বলটি ছিল, তা সাদা ও কালো দুটি রঙেরই ছিল। বলটা সাদা নাকি কালো তা শুধু সম্ভাবনা দিয়েই বোঝানো যাবে। মনে হবে যেন একসঙ্গে সাদা-কালোর একটা স্যুপ।

যখনই আপনি বলটির দিকে তাকিয়েছেন, (মানে বলের ওপর একটি ফোটন কণা পড়ছে), ওটা নির্দিষ্ট একটি রঙে থেমে গেছে। সাধেই আইনস্টাইন কোয়ান্টাম তত্ত্বকে ‘স্পুকি অ্যাকশন অ্যাট আ ডিসটেন্স’ বা ‘দূর থেকে ভুতুড়ে কাণ্ড’ বলে ব্যঙ্গ করতেন না।

পরমাণুতে ইলেকট্রন সবসময় জোড়ায় জোড়ায় অবস্থান করে। এদের ইলেকট্রন-জোড় বলা হয়। দুটি ইলেকট্রন একে অন্যর থেকে যত দূরেই থাকুক না কেন, এদের অবস্থান, ভরবেগ, ঘূর্ণন পুরোপুরি অন্য ইলেকট্রনের ওপর নির্ভর করে। এদের মাঝে দূরত্ব শত শত কোটি আলোকবর্ষ হলেও একটির যে কোনো বৈশিষ্ট্য পরিমাপ করা মাত্রই অন্যটির বৈশিষ্ট্য জানা যাবে। যেমন একটির স্পিন যদি ‘আপ’ হয়, তবে নিশ্চিত করে বলা যাবে, অন্যটি স্পিন হচ্ছে ‘ডাউন’। যদি জানা যায়, একটি ঘুরছে ঘড়ির কাঁটার দিকে, তবে সঙ্গে সঙ্গে বলে দেওয়া যাবে, অন্যটি ঘুরবে ঘড়ির কাঁটার উল্টো দিকে। তাদের দূরত্ব ১ সেন্টিমিটার হোক কিংবা তারা মহাবিশ্বের দুই আলাদা প্রান্তেই থাকুক সেটা বিবেচ্য নয়। খেয়াল করুন, এখানে দুটি বিষয় ব্যখ্যা করেছি। একটি কণার একই সময়ে দুটি ভিন্ন স্থানে অবস্থান এবং দুটি ভিন্ন কণার মধ্যে সংযোগ বা ‘কানেকশন’। ইলেকট্রন বা অতিপারমাণবিক কোয়ান্টাম কণাগুলোর এ দুটি আচরণের প্রথমটিকে বলা হয় ‘কোয়ান্টাম সুপারপজিশন’ এবং দ্বিতীয়টি ‘কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গেলমেন্ট’।

১৯৮০ সালে মার্কিন পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান কণাগুলোর এ সুপারপজিশন ধর্মটি ব্যবহার করে কম্পিউটার তৈরির ব্যপারে চিন্তা করেন। শুরু হয় কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের গবেষণা।

কিউবিট ও কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ধারণা

আগামী ১০ বছরের মধ্যে বিশ্বে তিনটি বড় বিপ্লব দেখতে পাব আমরা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), বায়োটেক এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিং। ল্যাপটপ, স্মার্ট-ওয়াচ, মোবাইল এমনকি ওয়াশিং মেশিনসহ সমস্ত ডিজিটাল যন্ত্রে স্মার্ট কম্পিউটারের ব্যবহার রয়েছে। ডিজিটাল কম্পিউটারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে সিপিইউ। সিপিইউকে অপারেট করে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ট্রানজিস্টর। ট্রানজিস্টর যখন অফ থাকে তখন ০ এবং যখন অন থাকে তখন ১ সিগন্যাল পাঠায়। ০ এবং ১ সংখ্যা দুটিকে বলা হয় বিট। ধরুন আপনি একটি শব্দ ‘Hi’ লিখে এক ডিভাইস থেকে আরেক ডিভাইসে পাঠাবেন। কী-প্যাডে Hi লিখে পাঠানোর পর এটি সিপিইউতে গিয়ে বাইনারিতে (01001000 01101001) রূপান্তরিত হবে। আর এই কাজটি একাধিকবার অন-অফ হওয়ার মাধ্যমে করবে ট্রানজিস্টর। অর্থাৎ, ট্রানজিস্টর যখন অফ থাকবে, তখন ০ সিগন্যালই যাবে; আর যখন অন থাকবে, তখন ১ সিগন্যালই যাবে।

কোয়ান্টাম কম্পিউটার উন্নত ভার্সন নয়, নতুন প্রযুক্তি

কিন্তু কিউবিটে ঘটে ভিন্ন ঘটনা। কোয়ান্টাম কম্পিউটার অপারেট হয় কোয়ান্টাম বিট বা কিউবিটের মাধ্যমে। ডিজিটাল কম্পিউটারে যেমন নির্দিষ্ট সময়ে ট্রানজিস্টর হয় ‘অফ’ বা ‘অন’ থাকতে পারে অর্থাৎ বিট হয় ০ অথবা ১— যে কোনো একটি অবস্থায় থাকতে পারে, অন্যদিকে কিউবিট নির্দিষ্ট সময়ে ০ বা ১ অবস্থায়ও থাকতে পারে, আবার একই সঙ্গে ০ এবং ১ দুই অবস্থাতেই থাকতে পারে। অর্থাৎ সুপার পজিশন। যদিও ব্যাপারটা যতটা অদ্ভুত মনে হচ্ছে, ততটা অদ্ভুত নয়।

কোয়ান্টাম কম্পিউটার এরই মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু এর আকারসহ বেশ কিছু সীমাবদ্ধতার দরুন প্রাত্যহিক জীবনে এটি এখনো ব্যবহারের উপযুক্ত নয়। তবে মনে রাখতে হবে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার ক্ল্যাসিক্যাল কম্পিউটারের উন্নত ভার্সন নয়। এটি সম্পূর্ণ নতুন একটি প্রযুক্তি।

কোয়ান্টাম ইন্টারনেট

বিটের বদলে কিউবিট আকারে ডাটা স্থানান্তর করার আইডিয়াই মূলত কোয়ান্টাম ইন্টারনেটের মূল ভিত্তি। কিউবিট দুই ধরণের হতে পারে। পদার্থ-কণার (ইলেকট্রন, প্রোটন) কিউবিট এবং আলোক-কণার (ফোটন) কিউবিট। লং ডিসট্যান্স ডেটা স্থানান্তরে পদার্থ-কণার কিউবিট ব্যবহার করা যায় না। তাই কোয়ান্টাম ইন্টারনেটে অপটিক্যাল ফাইবার দ্বারা আলোর কণার কিউবিট ব্যবহার করা হয়।

এখানে একটি মজার বিষয় খেয়াল করুন, যেহেতু কিউবিট একই সময় ০ এবং ১ - দুই অবস্থাতেই ‘সুপার ইমপোজড’ থাকতে পারে, তাই সম্পূর্ণ ডেটা স্থানান্তরের জন্য আলাদা আলাদা ‘স্পেস’ এর প্রয়োজন হয় না। অনেকটা একই বিমানের সিটে একই সময়ে একসাথে ১০ জন যাত্রী বসে আসার মতো। এটিই কোয়ান্টাম ইন্টারনেটের উচ্চগতির মূলমন্ত্র। আবার েএকই কারণে ডেটা স্থানান্তরের মধ্যবর্তী সময়ে কেউ যদি তথ্যগুলো হ্যাক করার সুযোগও পায়, সে একগুচ্ছ সুপার ইমপোজড কিউবিট তথ্য ছাড়া কিছুই পাবে না। তাছাড়া ‘সুপার পজিশন’ অবস্থা ভেঙে তথ্যগুলোকে উদ্ধার করাও সম্ভব নয়। এমনকি তথ্যগুলো হুবহু ক্লোনিং করাও সম্ভব নয়।

কোয়ান্টাম ইন্টারনেট একটি দৃশ্যমান বিপ্লব। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী দশ বছর কিংবা তার আগেই কোয়ান্টাম ইন্টানেট ব্যবহার দেখবো আমরা। প্রাথমিকভাবে হয়তো জাতীয় নিরাপত্তা, ব্যাংকিং ও স্বাস্থ্যখাতকে কোয়ান্টাম ইন্টারনেটের আওতায় আনা হতে পারে। তবে পরবর্তীতে বিমান যোগাযোগ, মোবাইল ফোন প্রযুক্তিসহ প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই কোয়ান্টাম ইন্টারনেটের ব্যবহার দেখা যাবে।

-লেখক: পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিজ্ঞানপ্রিয়’র প্রতিষ্ঠাতা।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আগামী দুই বছরে শরণার্থীর সংখ্যা ভয়াবহভাবে বাড়বে 

দুই বিভাগে ঝড়ের পূর্বাভাস, নদীবন্দরে সতর্কতা

ভারত ও পাকিস্তান থেকে এলো ৪৮ হাজার টন চাল

১৫ মার্চ : আজ টিভিতে দেখা যাবে যেসব খেলা

পুতিনের সঙ্গে খুব ভালো আলোচনা হয়েছে: ট্রাম্প

ইফতার মাহফিলে পদপিষ্ট হয়ে রোহিঙ্গার মৃত্যু, আহত ২

আজ জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক 

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল কলেজছাত্রের

কক্সবাজারে জমি নিয়ে বিরোধ, প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত ১

১৫ মার্চ : ইতিহাসের এই দিনে যা ঘটেছিল

১০

১৫ মার্চ : আজকের নামাজের সময়সূচি

১১

বগুড়ায় প্রতিবন্ধী নারীকে ধর্ষণ করা সেই খালু গ্রেপ্তার

১২

সেখ জুয়েল এখন বিধান মল্লিক!

১৩

নেইমারের ব্রাজিল দলে ফেরার স্বপ্নভঙ্গ!

১৪

ডেমরায় ছাত্রদল নেতাকে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টা

১৫

কসবা সীমান্তবর্তী উপজেলায় অবাধে ব্যবহার হচ্ছে ভারতীয় সিম!

১৬

চাঁদা না পেয়ে ব্যবসায়ীকে কোপালেন যুবদল নেতা

১৭

বরিশাল বিভাগ সমিতির ইফতার ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত

১৮

ফেলানীর পরিবারের সঙ্গে সাংবাদিকদের ইফতার ও ঈদ উপহার

১৯

নাশকতা মামলায় বিএসইসির পরিচালক মোহতাছিন বিল্লাহ গ্রেপ্তার

২০
X