জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দিন দিন মারাত্মক উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পৃথিবী। ফলস্বরূপ বিশ্বব্যাপী বেড়ে গেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এ ধরনের পরিবর্তনের লাগাম টানতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধে প্রতি বছরই জাতিসংঘের আয়োজনে জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সেসব সম্মেলনে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও তার বাস্তবায়ন সেরকম দেখা যাচ্ছে না। আজারবাইজানের বাকুতে চলমান জলবায়ু সম্মেলনেও (কপ২৯) বরাবরের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের আহ্বান জানানো হচ্ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তেলসমৃদ্ধ ও উন্নত দেশগুলোর যে অনীহা দেখা যাচ্ছে, তাতে এবারের সম্মেলনের সফলতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন ওয়াহেদুজ্জামান সরকার
আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে গত সোমবার শুরু হয়েছে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন। সম্মেলন চলবে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত। এবারের সম্মেলনের মূল লক্ষ্য জলবায়ু সংকটের ভুক্তভোগী দরিদ্র দেশগুলোকে আরও অর্থসহায়তা দেওয়ার পথ খুঁজে বের করা। সেইসঙ্গে গত বছর আরব আমিরাতে কপ সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর বিষয়ে যে ঐকমত্য হয়েছিল, সেটিও এবার এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা থাকবে। জাতিসংঘের বার্ষিক এ জলবায়ু সম্মেলন ‘কপ’ নামে পরিচিত। এর পূর্ণ রূপ ‘কনফারেন্স অব পার্টিস’। এবার বাকুতে কপের ২৯তম আসর বসেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি। তাই ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তিতে ঠিক হয়েছিল, বৈশ্বিক তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে ধরে রাখা। সেজন্য ২০৩০ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে কার্বন ও গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ৫০ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত যেন কাগজে-কলমেই রয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ গত বছর আরব আমিরাতে কপ সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর বিষয়ে একটা ঐকমত্য হয়েছিল। কিন্তু এর সফলতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, চলতি বছর জি২০ সম্মেলনে কিছু দেশ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর প্রতিশ্রুতি থেকে সরে দাঁড়ানোর আভাস দিয়েছে। আর সম্প্রতি কলম্বিয়ায় জাতিসংঘের পরিবেশ সংরক্ষণবিষয়ক আলোচনাও কোনো ঐকমত্য ছাড়া শেষ হয়। জ্বালানি তেলের রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেক জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ তো দূরের কথা, কমানোরও ঘোরবিরোধী। কারণ তাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিই হচ্ছে তেল-গ্যাস। ওপেক সদস্যভুক্ত দেশগুলোর কথা হচ্ছে, জলবায়ু সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার করা না করা নয়, বরং দূষণ কমিয়ে আনায় অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। ওপেকের সদস্য দেশ সৌদি আরব। রাশিয়া ওপেক প্লাস জোটের প্রভাবশালী সদস্য। দেশ দুটির মিলিত প্রচেষ্টায় ওপেকের অনেক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। জ্বালানি তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ ও মূল্য নির্ধারণে সৌদি আরব ও রাশিয়ার প্রভাব রয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বলছে, গতবারের কপ আয়োজক সংযুক্ত আরব আমিরাত, এবারের আয়োজক আজারবাইজান এবং ২০২৫ জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজক ব্রাজিলসহ উল্লেখযোগ্য সব দেশই জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। অর্থাৎ যারা আয়োজক দেশ তারাই এ স্ববিরোধী আচরণ করছে। একই ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রেও। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে যে, এবারের কপ সম্মেলনে কয়েকটি বড় অর্থনীতি এবং সর্বাধিক কার্বন নিঃসরণকারী দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতারা উপস্থিত থাকছেন না। তাদের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাদের অনুপস্থিতি এ সম্মেলনের গুরুত্ব অনেক কমিয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের পর জলবায়ু নিয়ে নানা আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পরিবেশবান্ধব জ্বালানিকে তিনি বরাবরই একটি ‘প্রতারণা’ বলে উল্লেখ করেছেন। প্যারিস চুক্তি থেকেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিতে চান। ফলে জলবায়ু সহায়তা তহবিলে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সার্বিকভাবে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করা বা কমানোর বিষয়টি মারাত্মকভাবে হোঁচট খেতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।