শান্তিতে নোবেলজয়ী একমাত্র বাংলাদেশি ড. মুহাম্মদ ইউনূস দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে নতুন একটি ধারণা ও তত্ত্ব নিয়ে পৃথিবীব্যাপী কাজ করে যাচ্ছেন। আর সেটি হলো সোশ্যাল বিজনেস বা সামাজিক ব্যবসা। সামাজিক ব্যবসার এ ধারণাটি পৃথিবীর প্রতিটি দেশই ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে। এ মডেল প্রয়োগ করে বদলে যাচ্ছে বিশ্বের অনেক দরিদ্র দেশও। কী সেই সামাজিক ব্যবসা, যা নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বব্যাপী নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। গ্রন্থনা: ওয়াহেদুজ্জামান সরকার
বিশ্বের অর্থনৈতিক মানচিত্রে দুটি তত্ত্ব দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত। আর তা হলো পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র। নানা কারণে এখন আর সমাজতন্ত্র আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নেই। কিন্তু দোর্দণ্ড প্রতাপে পুঁজিবাদ বিরাজ করছে পৃথিবীজুড়ে। সেই পুঁজিবাদও আজ নানা কারণে সংকট ও প্রশ্নের সম্মুখীন। বিশ্বের ধনবাদী দেশগুলো এখন আর সনাতন পুঁজিবাদে সন্তুষ্ট নয়। তাদের অনেকে মনে করেন, পুঁজিবাদের একটা সংস্কার হওয়া দরকার। এরকম বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ক্ষুদ্র ঋণের উদ্ভাবক, বাংলাদেশের গর্ব, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছেন তার সাম্প্রতিক ‘সামাজিক ব্যবসা’ তত্ত্ব। এই ব্যবসায় বিনিয়োগকারী একটা সামাজিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিনিয়োগ করবেন; কিন্তু সেই ব্যবসা থেকে বিনিয়োগকারী কোনো ধরনের মুনাফা গ্রহণ করবেন না। শুধু বিনিয়োগের অর্থ তুলে নিতে পারবেন। মুনাফার অর্থ দিয়ে নতুন কোনো সামাজিক ব্যবসা শুরু করতে পারেন অথবা বর্তমান ব্যবসার সম্প্রসারণ করতে পারবেন। অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী ব্যবসায় মুনাফা বৃদ্ধির যে উন্মাদনা দেখা যায়, তার বাইরে ব্যবসাকে সামাজিক কল্যাণের জন্য নিয়ে আসাই সামাজিক ব্যবসার মূলকথা। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশে বিরাজমান নানা সমস্যার সমাধান করা হবে অনুদান বা চ্যারিটির ভঙ্গিতে নয় সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক ভঙ্গিতে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আজ সামাজিক ব্যবসা ছড়িয়ে পড়েছে। ইউরোপের দেশ আলবেনিয়ার রাজধানী তিরানায় সামাজিক ব্যবসার আওতায় বৃদ্ধ নিবাস করা হয়েছে। ২০১২ সালে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। বর্তমানে এই বৃদ্ধ নিবাসে ২৫০ জন বয়স্ক ব্যক্তি রয়েছেন। চীন, জার্মানি, জাপান, স্পেন, হাইতি, মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান, হংকং, উগান্ডাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিনিয়ত সামাজিক ব্যবসার প্রসার ঘটছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতে, বেকারত্ব দূর করতে সামাজিক ব্যবসা একটি কার্যকর ব্যবস্থা। বেকারত্ব এখন পুঁজিবাদের নতুন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার মতে, এই সামাজিক ব্যবসা দিয়েই বর্তমান বিশ্বের বেকারত্বের সমাধান করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তরুণ-তরুণীদের স্বপ্ন ও উদ্যোগ দিয়ে বেকারত্ব দূর করতে হবে। তার মতে, পৃথিবীতে এমন পরিস্থিতি আসবে যখন বেকারত্ব বলে কিছু থাকবে না। একজন সুস্থ শরীরের লোক বেকার থাকবে, এটা হতে পারে না। তিনি তরুণ প্রজন্মের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘তোমরা ব্যবসার ধারণা নিয়ে আসো। আমরা তোমাদের সহযোগিতা করব।’ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতে, কাজের ক্ষেত্রে বয়সের কোনো সীমা থাকা উচিত নয়। অবসর বলে কোনো শব্দই থাকা উচিত নয়। রিটায়ারমেন্টকেই রিটায়ারমেন্টে পাঠানো উচিত। তাই সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূরীকরণের মাধ্যমে মানুষকে সচ্ছল ও স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার এই সুদীর্ঘ সংগ্রামের পথে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশ এগিয়ে আসবে—এটাই তার প্রত্যাশা।
সামাজিক ব্যবসার ৭ মূলনীতি
২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে দাভোসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সামাজিক ব্যবসার সাতটি মূলনীতি ঘোষণা করেন। সামাজিক ব্যবসার সাতটি মূলনীতি হলো:
১. দারিদ্র্য বিমোচনসহ এক বা একাধিক বিষয় যেমন—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি ও পরিবেশগত খাতে বিরাজমান সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিগত মুনাফাবিহীন কল্যাণকর ব্যবসা এটি।
২. সবার অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করাই এ ব্যবসার লক্ষ্য।
৩. সামাজিক ব্যবসায় বিনিয়োগকারীরা শুধু তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থই ফেরত পাবে, এর বাইরে কোনো প্রকার লভ্যাংশ নিতে পারবে না।
৪. বিনিয়োগকারী তার বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত নেওয়ার পর বিনিয়োগকৃত অর্থের মুনাফা কোম্পানির সম্প্রসারণ কাজে ব্যবহৃত হবে।
৫. এ ব্যবসা হবে পরিবেশবান্ধব।
৬. এখানে যারা কাজ করবেন তারা ভালো কাজের পরিবেশ ও চলমান বাজার অনুযায়ী বেতন-ভাতা পাবেন।
৭. সামাজিক ব্যবসা হবে আনন্দের সঙ্গে ব্যবসা।
তিন নির্দেশনায় ফোকাস
প্রথমত. দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী গড়ে তুলতে হবে।
দ্বিতীয়ত. বেকারত্বকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে চাকরি খোঁজার দিকে মনোনিবেশ না করে ভবিষ্যতে উদ্যোক্তা হয়ে নিজেকে একজন চাকরিদাতা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
তৃতীয়ত. ভবিষ্যতের পৃথিবীকে রক্ষায় কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে।
দারিদ্র্য দূরীকরণে
ড. ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসার মডেল পৃথিবীর ৪০টির বেশি দেশে ১৩০টির বেশি প্রতিষ্ঠান ধারণ করে চলেছে। বিভিন্ন দেশে ৮০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে তার নামে ‘ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে