ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়া গুপ্তহত্যার শিকার হওয়ার পর যেন শোকে কাঁদছে গাজাসহ পুরো দেশটি। ইরানের রাজধানী তেহরানে মঙ্গলবার ইসরায়েলের গুপ্তহত্যার শিকার হন তিনি। প্রিয় জন্মভূমির স্বাধীনতার দাবিতে আমৃত্যু লড়ে যাওয়া এ নেতার মৃত্যুতে যেন অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষ। হত্যার প্রতিবাদে পশ্চিম তীরে চলছে সাধারণ ধর্মঘট। বিশ্বজুড়ে চলছে এ হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ। জানাচ্ছেন ওয়াহেদুজ্জামান সরকার
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা করা হয়েছে। ইরানের রাজধানী তেহরানে ইসমাইল হানিয়া গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) একটি বিবৃতিতে বলা হয়, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হানিয়া মঙ্গলবার থেকে তেহরানে অবস্থান করছিলেন। হামাস নেতারা যে ভবনে অবস্থান করছিলেন সেখান থেকে বুধবার সকালে হানিয়া এবং তার একজন দেহরক্ষীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ইসমাইল হানিয়া হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান হলেও তাকেই গোষ্ঠীটির সর্বোচ্চ নেতার সম্মান দেওয়া হতো। ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায়ের এ লড়াকু সৈনিক কখনো মাথানত করেননি ইহুদিবাদী ইসরায়েলের কাছে। ফিলিস্তিনিদের হৃদয় জয় করা এ নেতাকে হারিয়ে তাই অনেকটা অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছেন দেশটির সাধারণ মানুষ।
জানা গেছে, ১৯৬২ সালে ফিলিস্তিনি শরণার্থীশিবিরে হানিয়ার জন্ম। শিশু বয়স থেকেই তার জীবন দুঃখ-দুর্দশায় ভরা। জাতিসংঘ পরিচালিত শরণার্থী স্কুলে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। পরে গাজার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি সাহিত্যে স্নাতক সম্পন্ন করেন। হানিয়া প্রথম ইন্তিফাদার প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলেন এবং ইসরায়েলি সামরিক আদালত তাকে কারাদণ্ড দেয়। ১৯৮৯ সালে তিন বছরের জন্য কারাবরণ করেন তিনি। এরপর ১৯৯২ সালে আরও কয়েকজন হামাস নেতার সঙ্গে হানিয়াকে ইসরায়েল ও লেবানন সীমান্তের শূন্যরেখায় ছেড়ে দেয় ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। এক বছর নির্বাসনে থাকার পর ইসমাইল হানিয়া গাজায় ফিরে রাজনীতিতে আরও সক্রিয় হন। তার বিচক্ষণতায় ১৯৯৭ সালে হামাসের মতাদর্শিক গুরুর কার্যালয়ের প্রধানের দায়িত্ব পান তিনি। এর সূত্র ধরে গাজা উপত্যকায় হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে ওঠেন ইসমাইল হানিয়া। ২০০৪ সালে ইসরায়েলি বিমান হামলায় শেখ আহমেদ ইয়াসিন নিহত হন। এরপর উপত্যকায় ইসমাইল হানিয়ার প্রভাব বাড়তে থাকে। এ নেতার সরাসরি রাজনীতিতে উত্থান ঘটে ২০০৬ সালের জানুয়ারির নির্বাচনের আগে। তখন মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন বিভক্ত ফাতাহ দলকে হারিয়ে চমক দেখায় হামাস। ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান হানিয়া। কিন্তু খুব বেশি দিন তিনি এ পদে টিকে থাকতে পারেননি। কিছুদিন পরই গাজায় হামাস ও ফাতাহের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত শুরু হলে হানিয়াকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেন আব্বাস। তবে হানিয়া এ সিদ্ধান্তকে ‘অসাংবিধানিক’ আখ্যা দিয়ে সে সময় বলেছিলেন, তার সরকার ফিলিস্তিনের জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালন থেকে তিনি বা তার সরকার সরবেন না। তারপর থেকেই মূলত গাজার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চলে যায় হামাসের হাতে। ২০১৭ সালে হামাসের রাজনৈতিক বিভাগের প্রধান হন হানিয়া। মৃত্যুর আগপর্যন্ত এ দায়িত্বই পালন করে আসছিলেন। জনপ্রিয়তার কারণে তিনি বারবার গোষ্ঠীটির নেতা নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে তাকে ‘সন্ত্রাসী’ তকমা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর। এ ঘোষণার পর গাজা ছেড়ে কাতারে চলে যান হানিয়া। গত কয়েক বছর সেখানেই বসবাস করছিলেন। তিনি গাজা থেকে কাতারে চলে আসার পর সেখানে প্রধান নেতার দায়িত্ব চলে যায় ইয়াহিয়া সিনাওয়ারের হাতে।