হাসান আজাদ
প্রকাশ : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০১:৫৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

গ্যাস না দিলে বিল পাবে না বিতরণ কোম্পানি

গ্যাস না দিলে বিল পাবে না বিতরণ কোম্পানি

পাইপলাইনের গ্রাহকদের গ্যাস না দিলে আইন অনুযায়ী বিল পাবে না বিতরণকারী কোম্পানি। সম্প্রতি গ্রাহকদের এক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানি শেষে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) দেওয়া এক আদেশে এমনই রায় দেওয়া হয়। জ্বালানি খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের আইন অনুযায়ী গ্যাস না দিয়েই প্রতি মাসে নির্দিষ্ট অঙ্কের বিল নিচ্ছে। এজন্য বিইআরসির এই আদেশ জনস্বার্থের জন্য একটি উদাহরণ এবং যুগান্তকারী।

সংশ্লিষ্টরা আরও বলেন, বছরের প্রায় সব সময়ই গ্যাস সংকট থাকে। ফলে গ্রাহকরা সঠিক চাপে গ্যাসের সরবরাহ পান না। কিন্তু নিয়মিত বিল দিতে হচ্ছে। এমনকি শীতে গ্যাস সরবরাহ একেবারে নাজুক অবস্থায় গেলেও বিল থেকে রেহাই নেই। অন্যদিকে, গ্যাস না পেলে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, সে বিষয়েও গ্রাহকদের পরিষ্কার কোনো ধারণা নেই। এই রায়ের ফলে এখন থেকে গ্রাহকরা পর্যাপ্ত গ্যাস না পেলে বিইআরসির কাছে গিয়ে প্রতিকার চেয়ে অভিযোগ দাখিলের বিধান যে রয়েছে, সেটা জানতে পারবে। একইভাবে বিইআরসির রায় যদি কোনো পক্ষ না মানে, তাহলে হাইকোর্টে যেতে পারবে। আর হাইকোর্টে যেতে না চাইলে অবশ্যই বিইআরসির আদেশ মানতে হবে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি ও জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, বিতরণ কোম্পানিগুলো চুক্তি অনুযায়ী মিটারবিহীন গ্রাহককে গ্যাস দেয় না। অথচ প্রতি মাসে নির্দিষ্ট অঙ্কের বিল নিচ্ছে। এটা লুণ্ঠনমূলক আয়। আর চুক্তি ভঙ্গ করা ফৌজদারি অপরাধ। এই রায়ের ফলে এখন গ্যাস না পেলে কীভাবে প্রতিকার পেতে হবে, সেটা গ্রাহকরা জানতে পারবেন। আর এই রায় বাতিল করতে হলে হাইকোর্টে যেতে হবে। অন্যথায় বিইআরসির রায় বাস্তবায়ন করতেই হবে। জনস্বার্থে, ভোক্তার স্বার্থে এই রায় একটা উদাহরণ এবং সময়োপযোগী।

গ্রাহকের অভিযোগে শুরু :

২০১৮ সালের ২১ ডিসেম্বর গাজীপুরের শ্রীফলতলী থানার বড়ইতলী, শ্রীফলতলী ও টেংলাবাড়ী গ্রামের বাসিন্দারা ‘বড়ইতলী, শ্রীফলতলী ও টেংলাবাড়ী গ্রামের তিতাস গ্যাস গ্রাহক কল্যাণ সমিতি’ নামে একটি সমিতি গঠন করে। সমিতিতে গ্রাহকের সংখ্যা ১৪৯ জন। সমিতি গঠনের আগে ২০১৭ সালের জুন থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৮ মাস ধরে উপরোক্ত তিন গ্রামের তিতাসের গ্রাহকরা গ্যাস পাচ্ছিলেন না। অভিযোগে বলা হয়, ২০১৭ সালের জুন থেকে তিতাসের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। বিষয়টি একই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর ও ১০ অক্টোবর তিতাস গ্যাসকে জানানো হয়। এ প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি তিতাসের গঠিত কমিটি সরেজমিন পরীক্ষা করে গাজীপুর আঞ্চলিক অফিস ‘শূন্য গ্যাস চাপের/গ্যাস সরবরাহ না থাকার’ বিষয়টি অবহিত করে প্রতিবেদন দেয়। সচিত্র এই প্রতিবেদন তিতাসের প্রধান কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক (নেটওর্য়াক এনালাইসিস শাখা), পিডিডি কাছে জমা দেওয়া হয়।

এরপরও কোনো প্রতিকার না পাওয়ায় ব্যবহারকারীরা ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর ও ১৮ ডিসেম্বর ফের তিতাসে অভিযোগ করেন। অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, ২০১৭ সালের জুন থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পাইপলাইনের গ্যাস না পাওয়ায় সিলিন্ডারের গ্যাস (এলপিজি) ব্যবহার করায় গ্রাহকদের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। কোনো প্রতিকার না পেয়ে তিতাস গ্যাস গ্রাহক সমিতি গঠন করা হয়।

সমিতি গঠনের পর সব গ্রাহকের পক্ষে ২০১৯ সালের ২১ মার্চ গ্যাস না পাওয়া ১৮ মাসের বিল সমন্বয়ের জন্য তিতাস কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়। কিন্তু বিল সমন্বয় বা মওকুফের কোনো সুযোগ নেই বলে তিতাস থেকে জানিয়ে বিল পরিশোধের অনুরোধ জানানো হয়। পাশাপাশি এও জানানো হয়, বিল না দিলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরে ২০২১ সালের ৯ মার্চ এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে গ্রাহক সমিতি বিইআরসিতে বিরোধ নিষ্পত্তির আবেদন করে। আবেদনটি ভোক্তা অভিযোগ সম্পর্কিত হওয়ায় ২০২১ সালের ২৬ আগস্ট বিইআরসি আইন, ২০০৩-এর ৫৪ ধারা অনুযায়ী নিষ্পত্তির জন্য কমিশনের কনজ্যুমার অ্যাফেয়ার্স শাখায় পাঠানো হয়। একই সঙ্গে অভিযোগটি নিষ্পত্তির জন্য সদস্যকে (গ্যাস) দায়িত্ব দেওয়া হয়। বিইআরসির সদস্য (গ্যাস) ২০২১ সালের ২০ ডিসেম্বর, ২০২২ সালের ২০ জানুয়ারি, ৯ ফেব্রুয়ারি, দুই মার্চ ও ১০ মে উভয়পক্ষের উপস্থিতিতে শুনানি করে।

শুনানিতে তিতাসের মিথ্যাচার :

পরেও শুনানি চলাকালে তিতাস কর্তৃপক্ষ ২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বরের কোম্পানির গঠিত একটি কমিটির পরিদর্শন প্রতিবেদন দাখিল করে বিইআরসিতে। দাখিল করা প্রতিবেদনে তিতাসের পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়, ইভিসি মিটারের রেকর্ডার অনুযায়ী ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন চাপ ছিল যথাক্রমে ২৭ দশমিক ৭৬ পিএসআইজি এবং ৬ দশমিক ৩৯ পিএসআইজি। উক্ত এলাকার গ্রাহক/আবেদনকারীর ভাষ্যমতে, বর্তমানে ওই এলাকায় বাসার কাজে গ্যাসের কোনো চাপ স্বল্পতা নেই। তিতাস গ্যাস থেকে আরও জানানো হয় যে, অভিযোগকারীরা যেহেতু মিটারবিহীন গ্রাহক, সেহেতু ২০১৭ সালের জুন থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সময়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কখন গ্যাসের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে বা কখন ব্যবহৃত হয়েছে, এ বিষয়ে ব্যবহারের মাত্রা সুনিদিষ্টভাবে নিরূপণ করা দুরূহ। কারণ, সে সময়ের কোনো তথ্য নেই।

শুনানিতে তিতাসের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়, তিতাস গ্যাস ও গ্রাহকের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির ৮নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, তিতাস গ্যাস গ্রাহকদের সম্পূর্ণ বা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকায় বিল মওকুফের দাবি গ্রহণযোগ্য নয়।

বিইআরসির পর্যবেক্ষণ ও আদেশ :

শুনানি শেষে বিইআরসির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ২০১৮ সালের দুই জানুয়ারি তিতাস গঠিত কমিটির দেওয়া শূন্য গ্যাস চাপের সচিত্র প্রতিবেদন (জোবিঅ/১০৯/চন্দ্রা২৫/৯০৬) থাকা সত্ত্বেও তিতাস গ্যাস গঠিত ২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বরের প্রতিবেদনে ২০১৭ সালের জুন থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো তথ্য নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যা একটি ডাহা মিথ্যা অথবা প্রতিবেদনকারীরা প্রতিবেদন প্রণয়নকালীন কোনো গুরুত্ব দেননি। যা ন্যায়বিচার ও চাকরি প্রবিধান অনুসারে গুরুতর অপরাধ। এমনকি বিরোধী সময়ে গ্যাস সরবরাহের চেষ্টার পক্ষে শুনানিতে কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি।

এই পরিপ্রেক্ষিতে চুক্তি আইন ১৮৭২ ধারা ২৫(১) অভিযোগকারী ভোক্তার অভিযোগ, অন্যান্য দলিল, উভয়পক্ষের বক্তব্য এবং সব বিষয় বিস্তারিত পর্যালোচনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করে বড়ইতলী, শ্রীফলতলী ও টেংলাবাড়ী গ্রামের তিতাস গ্যাস গ্রাহক কল্যাণ সমিতি এবং তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের মধ্যকার অভিযোগের বিষয়ে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন ২০০৩-এর ৫৪ ধারায় আদেশ দেয়। গেল বছরের ১০ অক্টোবর এ রায় দেওয়া হয়।

আদেশে দীর্ঘ ১৮ মাস গ্যাস সরবরাহ না করে উক্ত আবাসিক গ্রাহকদের অনুকূলে ইস্যুকৃত বিলগুলো আইনত এবং ন্যায়ত শুদ্ধ নয়। এমতাবস্থায় উক্ত সময়ের জন্য কোনো বিল পরিশোধযোগ্য নয়। পাশাপাশি কমিশনে মিথ্য প্রতিবেদন প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের বিরুদ্ধে চাকরি বিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আদেশ দেওয়া হয়। আদেশ বাস্তবায়নে তিন মাসের সময় বেঁধে দেয় কমিশন।

এ প্রসঙ্গে বিইআরসির সদ্য বিদায়ী সদস্য (গ্যাস) বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, গ্যাস না দিয়ে বিতরণ কোম্পানিগুলো বিল নেবে, এটা আইনত অপরাধ। এটা হতে পারে না। তিনি বলেন, এই রায় আমি দিয়েছি। একটা উদাহরণ তৈরি করেছি যে, গ্যাস না দিয়ে বিল নেওয়া যাবে না। এখন গ্রাহকরা জানতে পারবে, বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাস না দিলে কোথায় অভিযোগ দিতে হবে।

তিতাসের রিভিউ আবেদন খারিজ, যাচ্ছে হাইকোর্টে :

বিইআরসির আদেশের বিরুদ্ধে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর রিভিউ আবেদন করে তিতাস কর্তৃপক্ষ। আবেদন যাচাই-বাছাই করে রিভিউ আদেন খারিজ করে দেয় বিইআরসি। আবেদন খারিজ হওয়ার পর তিতাস কর্তৃপক্ষ বিইআরসির আদেশ বাতিল করতে হাইকোর্টে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এ বিষয়ে কথা বলতে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তবে কোম্পানিটির মহাব্যবস্থাপক (করপোরেট) এবং কোম্পানি সচিব মো. লুৎফুল হায়দার মাসুম এ বিষয়ে কালবেলাকে বলেন, বিইআরসির আদেশ আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই আমরা হাইকোর্টে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তিনি এর বেশি আর কথা বলতে চাননি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

খেলা দেখা নিয়ে অবাক তথ্য মোস্তাফিজের

চুয়াডাঙ্গায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড

মিরসরাইয়ে বৃষ্টির জন্য কাঁদলেন মুসল্লিরা

বিশ্বজয়ী অধিনায়কের সংগ্রহে ‘১০০০’ ব্যাট

মার্ক জাকারবার্গকে টপকে গেলেন ইলন মাস্ক

থাইল্যান্ডের কাছে চিকিৎসা খাতে বিনিয়োগ চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী

আমার দেখা ভিয়েতনাম

মানুষের কষ্টে যুবলীগ ঘরে বসে থাকে না: পরশ

মার্কিন সহায়তায় কি বাঁচবে ইউক্রেন?

গরমে গরিবের এসি যেন মাটির ঘর

১০

টানা তাপপ্রবাহে পুড়ছে দেশ, ভাঙল ৭৬ বছরের রেকর্ড

১১

বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠাকরণে বাজেটে বরাদ্দ প্রয়োজন

১২

দলবদলে সরগরম থাকবে বার্সা!

১৩

থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ সমঝোতা ও চুক্তি সই

১৪

ফ্লোরিডায় কনসাল জেনারেল হলেন সেহেলী সাবরীন

১৫

গুরুদাসপুরে বৃষ্টির প্রার্থনায় ইসতিসকার নামাজ

১৬

ভোজ্যতেলে নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে এসিআইয়ের সূর্যমুখীর হাইসান-৩৬ জাত

১৭

দেশের উন্নয়নে বাস্তুচ্যুতদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে সরকার বদ্ধপরিকর : ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী

১৮

দুবাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল ছাত্রলীগ নেতার

১৯

ডিএসসিসির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ গেল আইডিয়াল ছাত্রের

২০
*/ ?>
X