আঙ্গুর নাহার মন্টি
প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:৪৬ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইইউ চায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন

ইইউ চায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন

উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) আশা করে, বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ হবে। ইউরোপের ২৭ দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জোটটি নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাতে আগ্রহী। একই সঙ্গে এ বছর কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে বহুমাত্রিক সহযোগিতার সম্পর্ক আরও জোরদার করতে চায়।

দৈনিক কালবেলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এ অভিমত জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত ইইউ ডেলিগেশন প্রধান ও রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দৈনিক কালবেলার কূটনৈতিক প্রতিবেদক আঙ্গুর নাহার মন্টি।

কালবেলা : ইইউর রাষ্ট্রদূত হিসেবে বাংলাদেশ ও ইইউর মধ্যকার সম্পর্ক আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

চার্লস হোয়াইটলি : ২০২৩ সাল ইইউ ও বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এ বছর আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি। বছরটি নানা আয়োজনে উদযাপন করতে চাই। ইইউ-বাংলাদেশ সম্পর্ক দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশ শিগগিরই এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে চলে আসবে। তাই দেশ ও বিদেশে আরও নিবিড়ভাবে একসঙ্গে কাজ করতে চাই। এরই মধ্যে জলবায়ুসহ বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলাকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছি। ইইউর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক ক্রমবর্ধমান। এখানে এরই মধ্যে ইইউ দেশগুলোর ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করছেন, বাংলাদেশেরও আগ্রহ রয়েছে। গত ১৮ জানুয়ারি ইউরোপিয়ান চেম্বার অব কমার্স যাত্রা শুরু করেছে। ইউরো চেম্বার এ দেশে বাণিজ্য ও বিনিয়োগকে সহজতর করার পরামর্শক হিসেবে কাজ করবে। আপনি জানেন, ২৭ ইইউ সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ঢাকায় মাত্র ৭টির দূতাবাস আছে। ২০টি সদস্য দেশ দিল্লি থেকে প্রতিনিধিত্ব করে। আমরা চেষ্টা করব ইউরো-চ্যাম সেই ২০ দেশের জন্য কাজ করবে। ২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত আমি এখানে ছিলাম। আমাদের উন্নয়ন সহযোগিতা শুধু শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন তা বিস্তৃত হয়ে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও বাণিজ্য খাতেও সম্প্রসারিত হয়েছে। এসবই গত ৫০ বছরে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের চিত্র, যা উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়াকে ত্বরান্বিত করবে। এখন আমাদের সম্পর্কও অনেক ম্যাচিউরড হয়েছে। এমনকি এ সম্পর্ক জাতিসংঘ ও অন্যান্য ফোরামেও দৃঢ় হচ্ছে।

কালবেলা : আপনি এরই মধ্যে বলেছেন, চলতি বছর বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ৫০ বছরে পৌঁছেছে। স্বাধীনতার পর থেকে গত ৫২ বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে ইইউ এ অগ্রগতিকে কীভাবে দেখে?

চার্লস হোয়াইটলি : বাংলাদেশের অর্জনকে অবশ্যই ইইউ স্বাগত জানায়। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গড় আয়ু বৃদ্ধি, শিশু মৃত্যুহার হ্রাস ও মাতৃমৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রে ইইউ বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের উন্নয়ন সহযোগী। আমরা অবশ্যই এ সংকটগুলো উত্তরণের প্রশংসা করি। বাংলাদেশের পরিবর্তন হচ্ছে। এলডিসি থেকেও উত্তরণ হতে যাচ্ছে। একটি নতুন বাংলাদেশ তৈরি হচ্ছে, অবশ্যই ব্যবসা হবে এর প্রোফাইল। পরিবর্তিত বিশ্বে সবার অগ্রগতি হচ্ছে। ইইউতেও এ পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। ফলে ইইউ আরও ঐক্যবদ্ধ, সুসংহত ও সুসমন্বিত হচ্ছে। আগামী দিনে বাংলাদেশ ও ইইউর পরিবর্তনের প্রতিফলন দ্বিপক্ষীয় বহুমাত্রিক সম্পর্কেও দৃশ্যমান হবে। যেমন, আগামী মাসে বাংলাদেশে অভিবাসন বিষয়ে কম্প্রিহেনসিভ সংলাপ করবে ইইউ। গত বছর প্রথম রাজনৈতিক সংলাপ হয়েছে। এতে প্রতীয়মান হয়, আমাদের সম্পর্ক আরও সম্প্রসারিত ও জোরদার হয়েছে।

কালবেলা : ইইউর সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাংলাদেশের অনুকূলে। আমরা এরই মধ্যে আলোচনা করেছি ২০২৬ সালে বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ হবে। এরপর আরও তিন বছর অর্থাৎ ২০২৯ সাল পর্যন্ত ইইউভুক্ত দেশগুলোতে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা ভোগ করার কথা রয়েছে। মহামারি কভিড-পরবর্তী পরিস্থিতি এবং ইউক্রেন যুদ্ধ বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশ ইউরোপকে এ সুবিধা আরও কয়েক বছর বাড়ানোর অনুরোধ করছে। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা ও নতুন পরিস্থিতি সামঞ্জস্য রক্ষায় এ অনুরোধ সম্পর্কে ইইউর অবস্থান কী?

চার্লস হোয়াইটলি : এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি, আমাদের সামনে খুবই বাস্তবসম্মত বিকল্প জিএসপি প্লাস রয়েছে। যদি সব ঠিক থাকে তাহলে বাংলাদেশ ২০২৯ সালের পরও ইইউর বাণিজ্যিক সব সুবিধা পাবে। অবশ্যই এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অতিরিক্ত শর্ত হিসেবে পরিবেশ, সামাজিক মান ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক ৩২টি কনভেনশন অনুসমর্থন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। তাই আমি মনে করি, এ মুহূর্তে ফোকাস হওয়া উচিত জিএসপি প্লাসে যুক্ত হওয়া। সেই সঙ্গে অবশ্যই বর্তমান সুবিধা বর্ধিত করার ব্যাপারে আলোচনাও হতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় ইইউর সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে জিএসপি প্লাস ও এর অতিরিক্ত শর্তাবলি পূরণের যোগ্যতা অর্জন করতেই হবে। তাই ২০২৯ সালের বাস্তবতা ধরে নিয়ে আমরা এটা অর্জনে কাজ করছি। বাংলাদেশও তা অর্জনে কঠোর পরিশ্রম করছে। তাই আমি মনে করি, জিএসপি প্লাস এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত শর্তগুলোর ওপর এখনই ফোকাস করা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ।

কালবেলা : এলডিসি উত্তরণের পরবর্তী পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও একটু স্পষ্ট ধারণা পেতে চাই। বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী, এলডিসি থেকে উত্তরণের পরই বাংলাদেশ জিএসপি বা জিএসপি প্লাস সুবিধা পাচ্ছে না। অবাধ বাণিজ্য চুক্তিতেও (এফটিএ) নেই বাংলাদেশ। ২০২৯ সালের মধ্যে কোনো ব্যবস্থার মধ্যে যেতে না পারলে বাংলাদেশকে ১১% শুল্ক দিয়ে বাণিজ্য সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে হবে, যা খুবই চ্যালেঞ্জিং। এ সংকট থেকে উত্তরণের পথ কী হবে?

চার্লস হোয়াইটলি : আমি আবারও বলছি, এ ক্ষেত্রে জিএসপি প্লাস খুবই বাস্তবসম্মত বিকল্প যা ২০২৯ সাল থেকে শুরু হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ইউরোপের বাজারে পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশকে শর্তগুলো পূরণ করতেই হবে। এরই মধ্যে বাংলাদেশে সব কনভেনশন অনুসমর্থন করেছে। সমস্যা হচ্ছে বাস্তবায়নে। যদিও কনভেনশনগুলো বাস্তবায়ন যে কোনো দেশের জন্যই কঠিন। উদাহরণস্বরূপ, কনভেনশনগুলোর মধ্যে রয়েছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাতিসংঘের কনভেনশন ও পরিবেশবিষয়ক প্যারিস চুক্তি। এদিকে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নেতৃত্বদানকারী দেশও। এখানে অনেক জটিলতা ও চ্যালেঞ্জ থাকলেও আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ এগুলো বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। আর এ ক্ষেত্রে বিজিএমইএসহ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো সহযোগিতা করছে। তাই এফটিএর চেয়ে জিএসপি প্লাসে ফোকাস থাকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এফটিএ এখন আর ইউরোপের আলোচনার টেবিলে নেই। আমি মনে করি, জিএসপি প্লাসের জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গীকারের পাশাপাশি এলডিসি উত্তরণে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন কমিটি বিষয়গুলো দেখছে। আমরাও এ ব্যাপারে সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত আছি।

কালবেলা : আমরা জানি তৈরি পোশাকের বড় বাজার ইইউ। এ ছাড়া ইইউর বাজারে বাংলাদেশের আর কী কী পণ্যের চাহিদা রয়েছে?

চার্লস হোয়াইটলি : এ ক্ষেত্রে আমি বলব, স্কাই ইজ লিমিট। সুনির্দিষ্ট করে বললে চা, পাট, চামড়া ও ওষুধের পাশাপাশি প্রথাগত বাণিজ্য ও পণ্যের বাইরে ইউরোপে পরিষেবারও চাহিদা আছে। একদিকে বাংলাদেশে শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে ইউরোপীয়রা বৃদ্ধ হচ্ছে। তাই বাংলাদেশের সেখানে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। এখন বাংলাদেশকে ভাবতে হবে, তারা কোন কোন খাতে কী কী দিতে পারবে। এ ছাড়াও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাধাগুলো দূর করতেও কাজ করতে হবে। ইউরো-চেম্বার এটা নিয়ে কাজ করবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে একটি গঠনমূলক ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির পাশাপাশি এবং সরকারের বাইরেও বিভিন্ন সেক্টরে সচেতনতা গড়ে তোলার ওপর জোর দিতে হবে। এ বিষয়ে আমরা সবাই কাজ করছি। বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ বার্তার সঙ্গে বাস্তবতারও সমন্বয় থাকতে হবে। আমি আনন্দের সঙ্গে জানাতে চাই, ইউরোপের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে আসতে চায়। তাই তারা যেন সহজে এখানে বিনিয়োগ করতে পারে। এ পর্যায়ে আমি বলতে চাই, বাংলাদেশ ও ইইউর মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে মাত্র ৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বাংলাদেশে আসে। তবে বিনিয়োগ এখনো খুব বেশি নয়। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা ব্যাপক রয়েছে।

কালবেলা : আপনি জানেন, বাংলাদেশ সরকার বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ইইউর অগ্রাধিকার কী? এ দেশে কি ইউরোপীয় বিনিয়োগ কোনো বাধার সম্মুখীন হচ্ছে?

চার্লস হোয়াইটলি : আসলে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সমস্যা সবখানেই রয়েছে। আমরা সমস্যাগুলো নিয়ে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও সরকারের সঙ্গে কথা বলি। প্রতিবছর আমাদের মধ্যে বিজনেস ক্লাইমেট সংলাপ হয়। সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি তা তুলে ধরার একটা সুযোগ আছে। আমরা বলি, সরকারও শোনে। এরপরও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বাংলাদেশে ২০৪১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশ থেকে উন্নত দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রচেষ্টায় রয়েছে। তার মানে এখানকার অর্থনীতির ইতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে এবং এখানে অভ্যন্তরীণ ব্যবসাও শক্তিশালী। তবে মাঝেমধ্যে অভ্যন্তরীণ ব্যবসা সুরক্ষিত রাখা হয়। এটা কমিয়ে ইউরোপীয় বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত হওয়া দরকার। আমি বিনিয়োগ আকর্ষণে কোনো সুপারিশ না করেই বলছি, এ দেশের ব্যবসায় বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরিচালিত হতে হবে। কারণ আমলাতন্ত্রের প্রভাব ব্যবসায় সবসময় কাজ করে না। আমি যখন প্রথম এ দেশে এসেছিলাম তখন বাণিজ্য খাতে প্রযুক্তিগত সহযোগিতার সম্পর্ক তৈরিতে কাজ করেছিলাম। বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা চলছে। তবে লজিস্টিক খাতে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে ৪৯ শতাংশের বেশি শেয়ার না দেওয়ার নীতিগত একটি সিদ্ধান্ত এ দেশে আছে, যা বড় কোম্পানিগুলো মানতে চাইবে না। এ দেশে ইউরোপীয় বিনিয়োগ বাড়াতে এসব সমস্যা সমাধানে কাজ করতে হবে।

কালবেলা : আগামী জাতীয় নির্বাচন বাংলাদেশের দরজায় কড়া নাড়ছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে কূটনীতিতে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ কী হতে পারে?

চার্লস হোয়াইটলি : বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি এরই মধ্যে শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে আমরা এ দেশে সহিংসতামুক্ত, নিরাপদ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চাই। তাই আমরা সব রাজনৈতিক দলকে একসঙ্গে কাজ করতে উৎসাহিত করি। তবে অবশ্যই এটা বাংলাদেশের জনগণ ঠিক করবে। নির্বাচনের এখনো এক বছর বাকি, তাই সামনে প্রচুর সময়ও রয়েছে।

কালবেলা : আমরা জানি, ইইউ নির্বাচনের আগে, নির্বাচন চলাকালে এবং নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। আসন্ন নির্বাচনে ইইউর পর্যবেক্ষক মিশন পাঠানোর পরিকল্পনা কী?

চার্লস হোয়াইটলি : সারা বিশ্বে বছরে বেশ কয়েকবার ইইউ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে। বাংলাদেশ সরকার ও নির্বাচন কমিশনও বিদেশি পর্যবেক্ষকদের বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে। তাই আমন্ত্রণ পেলে পর্যবেক্ষক মিশন পাঠাবে ইইউ। এ ক্ষেত্রে আমি অবশ্যই বলতে চাই, ইইউর পর্যবেক্ষকরা সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। তারা গত কয়েক দশকে অত্যন্ত কঠোর পদ্ধতি অনুসরণ করে এবং অনেক দেশে তা খুব ভালোভাবে কাজ করেছে। আমি ২০০৮-৯ সালে যখন বাংলাদেশে ছিলাম, তখনো এ দেশে ইইউর বড় পর্যবেক্ষক মিশন ছিল এবং তা খুব ভালো ছিল। সামনে কী হবে তা এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংশ্লিষ্ট দেশের অনুমতি ও ইউরোপীয় কমিশন দ্বারা গৃহীত হওয়ার ওপর নির্ভর করে। দুপক্ষ সম্মত হলে নির্বাচনের ছয় মাস আগে নির্বাচন-পূর্ব পরিস্থিতি দেখতে প্রাথমিকভাবে একটি পর্যবেক্ষক প্রতিনিধি দল পাঠায় ইইউ।

কালবেলা : নির্বাচন কমিশনকে ইইউ কি কোনো ধরনের নির্বাচনী সহায়তা দিচ্ছে? বহুল আলোচিত ইভিএম পদ্ধতিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

চার্লস হোয়াইটলি : এখনো কোনো সহায়তা দিচ্ছে না ইইউ। এমনকি তাৎক্ষণিক পরিকল্পনাও নেই। তবে আমরা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দেখা করে এ ব্যাপারে আলোচনা করে বলেছি, যে কোনো প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রয়োজন হলে এবং তারা চাইলে ইইউ দিতে প্রস্তুত রয়েছে। আমি ইভিএম বিশেষজ্ঞ নই। তাই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।

কালবেলা : পশ্চিম বিশ্বের দেশগুলোর ইইউর সদস্য দেশসহ মানবাধিকার, সুশাসন ও গণতন্ত্র অগ্রাধিকার আমরা জানি। তবে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে তাদের বেশি সোচ্চার দেখা যায় কেন?

চার্লস হোয়াইটলি : ইইউ একশরও বেশি দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে। অগ্রাধিকারের বিষয়গুলোতে ইইউ বাংলাদেশের সঙ্গেও সারা বছর কাজ করে। আমরা মানবাধিকার নিয়ে নিয়মিত সংলাপ করেছি। ২০০১ সাল থেকে ব্রাসেলসে এ নিয়ে আমাদের কমিশনের একটি সাব গ্রুপে প্রতিবছর আলোচনা হয়। এর সঙ্গে নির্বাচনের সম্পর্ক নেই। ইউরোপে ইসলামোফোবিয়া নিয়ে আলোচনা হয়। জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মৃত্যুদণ্ড নিয়ে আলোচনা হয়। তেমনি এ দেশেও উদ্বেগের ইস্যুগুলোতে আমরা খোলামেলা কথা বলি। আর এটি আমাদের ম্যাচিউরড সম্পর্কের কারণেই হয়েছে। বাংলাদেশে সারা বছরই আমরা কখনো জলবায়ু, কখনো বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা করেছি। তবে নির্বাচনের আগে এ দেশের গণমাধ্যম সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আমি ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে এ দেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে আসার পর প্রথম প্রশ্নটি ছিল ২০২৪ সালের নির্বাচন নিয়ে। তাই এটা বলা যায়, এ দেশে সবসময় নির্বাচন প্রাধান্য পায়।

কালবেলা : বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ বর্তমানে কৃষি খাতে জোর দেওয়ার চেষ্টা করছে। এ ব্যাপারে ইইউ কী ধরনের সহযোগিতা দিতে পারে?

চার্লস হোয়াইটলি : সরাসরি ইইউ ও বাংলাদেশের মধ্যে কৃষি খাতে সহযোগিতা না থাকলেও ইইউর সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে সম্ভাবনা রয়েছে। আপনি জানেন, বিশাল কৃষি রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে নেদারল্যান্ডস বিশ্বের ৫১তম স্থানে রয়েছে। সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়ে আমি দেখেছি, সেখানে ড্রাগন ফল চাষ করা হতো, এখন রপ্তানি পণ্য কফি চাষ করা হচ্ছে। এখানে আমি অবশ্যই সম্ভাবনা দেখছি। ইইউ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছে। বাংলাদেশ গত দুই দশক ধরে খাদ্য সুরক্ষায় কাজ করছে বলে ধানসহ অনেক ফসলে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে পারছে। নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে। তবে আমি মনে করি, কৃষি রপ্তানিকারক হিসেবে বাংলাদেশের প্রোফাইল গড়ে তোলারও অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইইউ সহযোগিতা দিতে পারে।

কালবেলা : আপনি বলেছেন, ইইউ বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গে বহুপক্ষীয় সম্পর্কে গুরুত্ব দিচ্ছে। এমন বাস্তবতায় জলবায়ু পরিবর্তন, নিরাপত্তা, মানবাধিকার, শ্রম অধিকার, সুশাসন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মানব পাচার, নারীর ক্ষমতায়ন, যুব উন্নয়ন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো বিষয়ে আগামীতে ইইউ বাংলাদেশকে কীভাবে সহায়তা করবে?

চার্লস হোয়াইটলি : এগুলোর অনেক বিষয়ে আমরা বর্তমানে একসঙ্গে কাজ করছি। আমাদের একটি সাত বছরমেয়াদি তহবিল রয়েছে, যার আওতায় আমরা সবুজ পরিবেশের পথে এগিয়ে যাচ্ছি। এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়েও কাজ করছি। একটি চমৎকার দিক হচ্ছে, এখন আমরা অনুদানের ঋণের মাধ্যমে আমাদের অর্থায়ন প্রক্রিয়াকে উন্নীত করতে পারব। এখন আমাদের বড় অগ্রাধিকারগুলোর অন্যতম মানব উন্নয়ন। তাই আমরা প্রাথমিক শিক্ষার সহযোগিতার পথ পেরিয়ে প্রযুক্তিগত ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। সুশাসনকে অগ্রাধিকার দিয়ে এ দেশের সরকারের সঙ্গে গ্রাম্য আদালতের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা দেওয়ার কর্মসূচিও রয়েছে। আমি গর্বের সঙ্গে বলতে চাই, গ্রাম-আদালত স্থানীয়দের দ্রুত ও কার্যকরী পদ্ধতিতে বিচার করছে যা অনেক দেশে বড় আদালতেও হয় না। নিরাপদ অভিবাসন এবং পাচার প্রতিরোধেও আমরা নিবিড়ভাবে কাজ করছি। এ লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা ও ব্র্যাকের সঙ্গে আমরা একটি বিস্তৃত অভিবাসন সংলাপ শুরু করব। আমাদের একসঙ্গে কাজ করার অনেক ক্ষেত্র রয়েছে, অনেক ক্ষেত্র তৈরিও হবে।

কালবেলা : ভূ-রাজনীতি ও কৌশলগত বাস্তবতায় ইইউর কাছে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়? বিশেষ করে ইইউর ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলগত পরিকল্পনাটি কী?

চার্লস হোয়াইটলি : এটি বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশ এ অঞ্চলে একটি অত্যন্ত কৌশলগত অংশীদার। মানচিত্রে চোখ রাখলে এটি আরও স্পষ্ট হবে। তবে বাংলাদেশ শুধু ভৌগোলিক সম্পর্কে নয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সংকট নিরসনে বাংলাদেশের ভূমিকার কারণেও তারা এ অবস্থানে এসেছে। তাই ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে বাংলাদেশকে পাশে চায় ইইউ। অনেকেই বলছেন, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ইইউর ব্যবসা কোথায়? তাদের উদ্দেশে বলব, ইইউ সদস্য ২৭ দেশের আমদানি ও রপ্তানির বিশাল অংশই এ অঞ্চলকে ঘিরে হয়। তাই আমরা এ অঞ্চলের শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার পাশাপাশি উন্মুক্ত করার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। এ ছাড়াও কানেকটিভিটি, অভিবাসনসহ ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অগ্রাধিকারের বেশ কয়েকটি বিষয়ে ইইউ বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশকে সঙ্গে রাখা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই ইইউর প্রটোকলেও বাংলাদেশ অগ্রাধিকারে রয়েছে।

কালবেলা : কভিড-পরবর্তী বিশ্বে ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক সংকটকে আরও জটিল করে তোলায় রোহিঙ্গা সংকট অগ্রাধিকার হারাতে বসেছে। অথচ রোহিঙ্গা সংকট শুধু বাংলাদেশ বা এ অঞ্চলের সংকট নয়, বরং আঞ্চলিক নিরাপত্তা সুরক্ষিত রাখতে দ্রুত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে ইইউর ভূমিকা ও অবস্থান কী?

চার্লস হোয়াইটলি : আমি এ ব্যাপারে একমত যে, যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন জরুরি। তবে ইইউ সেই প্রত্যাবাসন স্বেচ্ছায় এবং নিরাপদ চায়। এটিও সত্যি যে, বৈশ্বিক নানা সংকটের মধ্যে ভুলে যাওয়ার তালিকায় চলে যাচ্ছে বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। আর অবশ্যই টানা পাঁচ বছর ধরে এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা আশ্রয় দেওয়াও বাংলাদেশের জন্য বিশাল বোঝা। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও জোরালোভাবে কাজ করতে হবে। ইইউ বাংলাদেশের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে। অর্থায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এ সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ। ইউক্রেনসহ বিশ্বজুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনাগুলো আমরা দেখছি। তাই রোহিঙ্গা সংকটে রাজনৈতিক মনোযোগ ধরে রাখাটাও আমাদের অঙ্গীকারের মধ্যে রয়েছে। এরই মধ্যে নিরাপত্তা পরিষদে এ ব্যাপারে প্রস্তাব পাস হয়েছে। স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ইইউ বাংলাদেশকে সহযোগিতা দিচ্ছে। যদিও আমরা জানি, আগামী মাস বা বছরে রোহিঙ্গা ইস্যুর কোনো সহজ সমাধান নেই। কারণ এখন মিয়ানমারের পরিস্থিতি ভয়াবহ। এরই মধ্যে মিয়ানমারে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি সে দেশে উন্নয়ন সহযোগিতা বাতিল করেছে ইইউ। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আগপর্যন্ত বাংলাদেশকে ইইউ যথাসাধ্য সহযোগিতা করবে।

কালবেলা : রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সহজে হচ্ছে না এমন বাস্তবতায় তাদের শরণার্থী হিসেবে তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানোর উদ্যোগের কথা চলছে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা এরই মধ্যে খুবই স্বল্পসংখ্যক হলেও বাংলাদেশের ওপর থেকে বোঝা কমানোর প্রচেষ্টা নিয়েছে। ইইউর এমন কোনো পরিকল্পনা আছে কি?

চার্লস হোয়াইটলি : রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে ইউরোপে নেওয়ার ব্যাপারে এই মুহূর্তে কোনো কাঠামোগত পরিকল্পনা নেই। ওমান ও সিরিয়ার শরণার্থীদের এরই মধ্যে ইউরোপ স্বাগত জানিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনীয়রাও ইউরোপ এলাকায় অবস্থান করছে। আমরা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশসহ অন্য দেশের জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়কে কিছু করতে দেখতে চাই। তাই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বাস্তু নীতিকে স্বাগত জানাই। আশা করব ইউরোপের মতো তারাও উদ্বাস্তুদের জন্য উদারভাবে দরজা খুলে দেবে। তবে তারা একটি খুব ক্ষুদ্র অংশকে পুনর্বাসনের প্রচেষ্টাকে আরও বড় পরিসরে সম্প্রসারিত করবে কিনা জানি না। তবুও চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে যাতে উদ্বাস্তুদের ন্যায্য বোঝা অন্যরাও বহন করে। ইইউ আপাতত বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সহযোগিতায় কাজ করছে। কারণ তারা সত্যিই বাংলাদেশের জন্য একটি বড় বোঝা।

কালবেলা : ভারত, চীন, রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কীভাবে মূল্যায়ন করে?

চার্লস হোয়াইটলি : আমরা জানি, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ এই পররাষ্ট্র নীতির কারণে বাংলাদেশ বিখ্যাত। বাংলাদেশ সার্বভৌম দেশ, তাই তারা নিজেদের মতো বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নেবে। তবে আমার ফোকাস হচ্ছে, এ দেশকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা। আবারও বলছি, বাণিজ্য, রাজনৈতিক, জলবায়ুসহ নানা খাতে সহযোগিতার সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে পেরে আমি আনন্দিত।

কালবেলা : আপনি এরই মধ্যে উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশ ও ইইউর মধ্যে প্রথম রাজনৈতিক সংলাপে উভয়ই একটি অংশীদারিত্ব সহযোগিতা চুক্তি (পিসিএ) স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়েছে। এ চুক্তিটি কেমন হবে?

চার্লস হোয়াইটলি : এটি একটি পরবর্তী প্রজন্মের চুক্তি, যা ইইউ সব দেশের সঙ্গে স্বাক্ষর করে না। এই পিসিএ চুক্তির আওতায় আমরা এতক্ষণ সম্পর্ক জোরদারের যেসব বিষয়ে কথা বলেছি, তার সবই থাকবে। এ নতুন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রাজনৈতিক এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা নিবিড় ও দৃঢ় হবে। আশা করছি, চুক্তিটি চলতি বছরই স্বাক্ষর ও বাস্তবায়ন শুরু হবে। একটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে, ইউরোপীয় পার্লামেন্টে সদস্য দেশগুলো এ চুক্তির ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছে। তাই এটি বেশ আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হলেও শর্তগুলো ঠিক রেখে আলোচনা এগিয়ে গেলে খুব দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।

কালবেলা : ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ এবং অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে ইইউর পরিকল্পনা কী?

চার্লস হোয়াইটলি : প্রথমেই বলব, এ যুদ্ধের কারণ বেশ স্পষ্ট। রুশ আগ্রাসনের কারণে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হয়েছে। এ যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক সংকটের চেয়ে বেশি আমরা মানুষের দুর্ভোগ দেখেছি। ভুলে গেলে চলবে না ইউক্রেনের জনগণকে হত্যা করা হয়েছে, বাড়িতে বোমা মেরেছে, গৃহহীন করেছে এবং নিরাপত্তার জন্য অন্য দেশে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। এবং এসব কারণে পুরো বিশ্বের অর্থনীতি সংকটে নিপতিত হয়েছে। মনে রাখতে হবে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইইউ রাশিয়ার যুদ্ধবাজ ব্যক্তি, অস্ত্র, যন্ত্রপাতি ও আগ্রাসনে জড়িত ব্যক্তিদের জন্য নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এ নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার সাধারণ মানুষ বা অন্য কোথাও মানুষকে শাস্তির জন্য দেওয়া হয়নি। এটি রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিক্রিয়া। তবে আমরা এ যুদ্ধটি আর একদিনও চলতে দেখতে চাই না। আর এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তটি রুশ সরকারকেই নিতে হবে। কারণ ইউক্রেনকে সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার স্বীকৃতি দিয়ে এই মুহূর্তে যুদ্ধ শেষ করতে তারাই পারে। এরই মধ্যে এ যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির দুর্ভোগ বাংলাদেশের মানুষকে পোহাতে হচ্ছে। যা একেবারেই অপ্রয়োজনীয় ছিল। এর প্রতিকার কে এবং কীভাবে করবে তা স্বচ্ছ কাচের মতোই স্পষ্ট।

কালবেলা : প্রায় ১৪ বছর পর আপনি বাংলাদেশে ইইউর রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নিয়ে ফিরেছেন। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে কী পরিবর্তন দেখছেন?

চার্লস হোয়াইটলি : গত দেড় দশকে বাংলাদেশ পরিবর্তিত অগ্রাধিকার, কাঠামো ও অর্থনীতি নিয়ে বিশ্বের সামনে দাঁড়িয়েছে। এটি বেশ দৃশ্যমান। এখন একটি নতুন বাংলাদেশকে সামনে দেখতে পাচ্ছি। তবে আমি মনে করি, যে বিষয়গুলো বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে বরাবর বিশেষ মর্যাদা দিয়ে রেখেছে, এ দেশের মানুষের উষ্ণতা, বন্ধুত্ব, বিদেশি বন্ধুদের সাদরে স্বাগত জানানো—এসব এ দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, যা এখনো বিদ্যমান। অবশ্যই এ বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি নতুন ও আধুনিক অবকাঠামো। এ দেশের সুউচ্চ ভবনগুলো, নতুন বিমানবন্দর, পদ্মা সেতু ও নতুন মেট্রোরেলের মাধ্যমে একটি মেগা লুক পেয়েছে এই দেশ। আমি আশা করি, শিগগিরই বাংলাদেশকে একটি পর্যটন গন্তব্য হিসেবে গড়ে উঠতে দেখব। আমার এ দেশে নতুন দায়িত্ব নিয়ে ফিরে আসার সময়ের মধ্যে এ ইতিবাচক অগ্রগতি প্রশংসাযোগ্য। এ ছাড়াও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বিভিন্ন খাতে তরুণ প্রজন্ম দক্ষ জনশক্তি হয়ে উঠছে। শিক্ষার প্রসার ঘটছে। বিশ্ববাসীর সামনে বাংলাদেশকে তুলে ধরার একটি ভালো সময়ে রয়েছে বাংলাদেশ। আর এ সময়ে ইইউ-বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপনও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়।

কালবেলা : এই বদলে যাওয়া অগ্রসর বাংলাদেশে আপনার রাষ্ট্রদূতের মেয়াদে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিশন কী হবে?

চার্লস হোয়াইটলি : এ ক্ষেত্রে আমি একটি সাধারণ ইচ্ছার কথাই বলব। আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে ইইউ-বাংলাদেশের সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে জোরদার হবে। অর্থাৎ ইউরোপীয় চেম্বার প্রতিষ্ঠা, পিসিএ চুক্তি, বাংলাদেশিদের বৈধভাবে ইউরোপে কর্মসংস্থানের সুযোগগুলোর মাধ্যমে এ সম্পর্ক সম্প্রসারিত হবে। এখন অবৈধভাবে ইউরোপমুখী হয়ে অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন, পাচারের শিকার হচ্ছেন, এমনকি জীবনও হারাচ্ছেন। আসন্ন বৈধ প্রক্রিয়ায় নার্স বা ইঞ্জিনিয়ার বা অন্য যে কোনো ক্ষেত্রে দক্ষ একজন বাংলাদেশি কর্মী চাইলেই কয়েক বছর ইউরোপে কাজ করতে পারবে। তারা ফিরে এসে সেই নতুন অভিজ্ঞতার আলোকে আরও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখতে পারবে। মরক্কোসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ইইউর এ অংশীদারিত্বের সম্পর্ক রয়েছে। এর মাধ্যমে মানুষে মানুষে যোগাযোগ ও সম্পর্ক তৈরি হবে।

কালবেলা : বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ইউরোপে কী ধরনের সুযোগ রয়েছে? একই সঙ্গে জানতে চাই, নারীর ক্ষমতায়নে ইইউ বাংলাদেশকে কী সহযোগিতা দিচ্ছে?

চার্লস হোয়াইটলি : আপনি জানেন, ইরাসমাস মান্দাস স্কলারশিপ স্কিমের আওতায় গত বছর ১৫০ জন শিক্ষার্থী ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। এটি আরও সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে সে দেশে কাজের সুযোগও তৈরি হবে। এ ছাড়াও ইইউ ভিজিট প্রোগ্রামও রয়েছে যেখানে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষদের ব্রাসেলসে পাঠানো হয়। এর মাধ্যমে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, কাউন্সিল ও কমিশনের মতো জটিল প্রক্রিয়া কীভাবে কাজ করে তা বুঝতে পারে। ইইউ তহবিলের ৩০ শতাংশ জেন্ডারভিত্তিক ক্ষমতায়নের জন্য নির্ধারিত। বাংলাদেশেও আমাদের সহায়তা কর্মসূচিগুলো মূলধারায় জেন্ডারভিত্তিক ক্ষমতায়নে জোর দেওয়া হয়। জলবায়ু ইস্যুতে স্থানীয় অভিযোজনের কর্মসূচিতে নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সম্পৃক্ত করার কারণে সচেতনতা সৃষ্টিতে ইতিবাচক প্রভাব এরই মধ্যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তবে ইইউ মনে করে, যে কোনো দেশে কার্যকর ক্ষমতায়নে নারীর সমঅধিকার ও সমমর্যাদা নিশ্চিত করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, ইউরোপে বড় বড় প্রতিষ্ঠানে ৩০-৪০ শতাংশ নারীকে বোর্ডে রাখার ব্যাপারে রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে আইন তৈরি করা হয়েছে। কারণ, সেখানেও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীর প্রতিনিধিত্ব কম। পরিবর্তন আনার চেষ্টা চলছে। এ অভিজ্ঞতাগুলো নিতে পারে বাংলাদেশ।

কালবেলা : বাংলাদেশ ও ইইউ কী ধরনের সাংস্কৃতিক বিনিময় করে?

চার্লস হোয়াইটলি : সাংস্কৃতিক সম্পর্কের আওতায় পুরান ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান, ভবনগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও ঢাকাইয়া খাবার সম্পর্কে জানতে পেরে আমরা গর্বিত। ইইউ ও বাংলাদেশ একটি অনন্য নেটওয়ার্কিং সংস্কৃতির চর্চা করছে। এ সম্পর্ক সম্প্রসারণে চলচ্চিত্র উৎসবও হচ্ছে। সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তীতে ঢাকায় ও ব্রাসেলসে বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে সহযোগিতায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উদ্যোগেও অংশ নেবে ইইউ। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ইউরোপীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে পারস্পরিক বোঝাপড়ায় বৈচিত্র্যময় হবে। আপনি জানেন, ইইউর ২৭ সদস্য দেশের ২৩টি সরকারি ভাষা রয়েছে। মানুষে মানুষে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে আমরা ইউরোপে পর্যটকদের আরও আকৃষ্ট করার উদ্যোগ নিচ্ছি।

কালবেলা : আমরা জানি, জলবায়ু সহযোগিতা ইইউর অগ্রাধিকার। লবণাক্ত পানির কারণে উপকূলের মানুষের দুর্ভোগ কমাতে ইইউ কী ধরনের সহযোগিতা দিচ্ছে?

চার্লস হোয়াইটলি : অভিযোজন কর্মসূচির পাশাপাশি এ দেশে বিভিন্ন পরিবেশগত অর্থাৎ সবুজ পরিবর্তনের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে তহবিল অর্ধ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার চিন্তা রয়েছে। সুইডেন ও ইউএনডিপির সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাজ হচ্ছে। নোনা পানির কারণে উপকূলের দুর্ভোগ কমাতেও অভিযোজনের বিকল্প নেই।

কালবেলা : বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে আগামী দিনে ইইউ বাংলাদেশকে কোথায় দেখতে চায়?

চার্লস হোয়াইটলি : আমরা বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্যে পৌঁছাতে দেখতে চাই। সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশের সাফল্যে আমাদের ভূমিকা থাকবে। তবে আমরা একটি সফল ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে বন্ধন, বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করতে চাই।

কালবেলা : দৈনিক কালবেলাকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

চার্লস হোয়াইটলি : আপনাকেও ধন্যবাদ।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠাকরণে বাজেটে বরাদ্দ প্রয়োজন

দলবদলে সরগরম থাকবে বার্সা!

থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ সমঝোতা ও চুক্তি সই

ফ্লোরিডায় কনসাল জেনারেল হলেন সেহেলী সাবরীন

গুরুদাসপুরে বৃষ্টির প্রার্থনায় ইসতিসকার নামাজ

ভোজ্যতেলে নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে এসিআইয়ের সূর্যমুখীর হাইসান-৩৬ জাত

দেশের উন্নয়নে বাস্তুচ্যুতদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে সরকার বদ্ধপরিকর : ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী

দুবাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল ছাত্রলীগ নেতার

ডিএসসিসির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ গেল আইডিয়াল ছাত্রের

যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করল চীন

১০

চিকিৎসার জন্য সন্তান বিক্রি করলেন বাবা

১১

বন্দনা করা ছাড়া জাতীয় পার্টির রাজনীতি নেই: ফিরোজ রশিদ

১২

এক মিনিটেই তাদের বিসিএসের স্বপ্নভঙ্গ

১৩

পঞ্চগড়ে হিটস্ট্রোকে প্রাইভেটকার চালকের মৃত্যু

১৪

ফিলিস্তিন ইস্যুর স্থায়ী সমাধান চায় চীন

১৫

প্রেমিকার শোক সইতে না পেরে প্রেমিকের আত্মহত্যা

১৬

বাজে আম্পায়ারিংয়ের শিকার মুশফিক বললেন মাশাআল্লাহ

১৭

মার্কিন চাপকে পাত্তাই দিল না ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা

১৮

সমাবর্তনের অজুহাতে শিক্ষার্থীদের সনদ আটকে না রাখার নির্দেশ

১৯

তেঁতুলিয়ায় নেমে গেছে পানির স্তর, চরম সংকটে কয়েক গ্রামবাসী

২০
*/ ?>
X