সম্প্রতি নওগাঁ শহর থেকে আটক করার পর র্যাব হেফাজতে মারা যান সুলতানা জেসমিন। মৃত্যুর পর তার বিরুদ্ধে মামলা হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। এ ক্ষেত্রে আইনটির অপব্যবহার হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ তথ্য দিয়েছেন। এর আগে গত বুধবার হাইকোর্ট জেসমিনকে র্যাবের হেফাজতে নেওয়া থেকে শুরু করে হাসপাতালে নেওয়া পর্যন্ত আইনগত প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। পাশাপাশি কোন ক্ষমতাবলে ওই নারীকে র্যাব হেফাজতে রেখেছিল, সে ব্যাপারেও আদালত ব্যাখ্যা চেয়েছেন। আগামী বুধবারের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষকে এর জবাব দিতে বলে ওই দিন ফের শুনানির জন্য রেখেছেন।
এরই মধ্যে গতকাল জেসমিনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আমি একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে বলতে পারি, সেটা হচ্ছে নওগাঁ থেকে ওই ভদ্রমহিলাকে যখন তুলে নেওয়া হয়, তখন তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কোনো মামলা ছিল না। ভদ্রমহিলার দুর্ভাগ্য, তিনি যখন মারা যান তখনো কিন্তু তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কোনো মামলা ছিল না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে তার মারা যাওয়ার পরের দিন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এখানে অপব্যবহার করা হয়েছে এবং এ মামলার কোনো প্রসিড (অগ্রসর) করা হয়নি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে কিন্তু মহিলাকে ধরা হয়নি।’ এ সময় সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, তাহলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার হচ্ছে? এ প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘দু-একটি অপব্যবহার হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। যেখানে দেখছি অপব্যবহার হচ্ছে, সেখানে অপব্যবহার বন্ধ করার জন্য যা করার তা করছি।’ গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেখা করতে আসেন। দুই মন্ত্রীর বৈঠকের পর আইন মন্ত্রণালয়ের বারান্দায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী এ কথা জানান।
এদিকে আইন বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে নওগাঁর ঘটনাসহ অনেক ঘটনার ক্ষেত্রেই র্যাব আইনবহির্ভূত অনেক কাজ করে ফেলছে বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহ্দীন মালিক। তিনি বলেন, প্রথমত কেউ মারা যাওয়ার পর ফৌজদারি মামলা হতে পারে না। এ ছাড়া ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় কোনো আসামি মারা গেলে তার বিরুদ্ধে আর মামলাও থাকে না। দ্বিতীয়ত এসব ঘটনা হচ্ছে তার কারণ, পুলিশকে কমবেশি হলেও ফৌজদারি কার্যবিধি, ফৌজদারি আইনের ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু র্যাবে যারা সেনাসদস্য আছেন, তাদের কখনো ফৌজদারি আইন পড়ানো হয় না। ফলে আইন না জানার কারণে আইনের বাইরে অনেক কাজ করে ফেলছে। ড. মালিক বলেন, র্যাব একটি বিশেষ বাহিনী। জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ, বোমা উদ্ধার, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা—এসব গুরুতর অপরাধ দমনের মধ্যে তাদের সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। ছোটখাটো ফৌজদারি অপরাদ যেমন—প্রতারণা, চাঁদাবাজি, মানহানি এসব নরমাল অপরাধের বিষয়ে সাধারণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নওগাঁর ঘটনায় উচিত ছিল যুগ্ম সচিবের থানায় অভিযোগ দেওয়া। অথবা র্যাবের কাছে অভিযোগ করলেও উচিত ছিল, থানায় গিয়ে প্রথমে মামলা করা। থানায় মামলা করার পর তাকে ধরতে বের হওয়া আইন সংগত হতো।’
জানা যায়, ২২ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টায় নওগাঁ শহরের নওজোয়ান মাঠের সামনে থেকে ভূমি অফিসের কর্মচারী সুলতানা জেসমিনকে আটক করে র্যাব। ওই দিন দুপুর পৌনে ১টায় তাকে নওগাঁ হাসপাতালে, পরে অবস্থার অবনতি হলে রাত ৯টার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়। ২৪ মার্চ সকালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। স্বজনদের দাবি, হেফাজতে থাকা অবস্থায় ওই নারীকে নির্যাতন করা হয়েছে। র্যাব শুরু থেকেই তা অস্বীকার করে এসেছে। র্যাবের দাবি, জেসমিনকে একজন যুগ্ম সচিবের অভিযোগের ভিত্তিতে আটক করা হয়েছিল। রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে কর্মরত ওই যুগ্ম সচিবের নাম এনামুল হক। জেসমিনকে র্যাব আটক করার সময়ও ওই যুগ্ম সচিব সেখানে ছিলেন। কিন্তু কোনো মামলা ছাড়াই একটি মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে ওই নারীকে আটক ও পরে মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়। বিষয়টি হাইকোর্টের নজরের আনেন এক আইনজীবী। হাইকোর্ট গত বুধবার কোনো মামলা ছাড়াই তাকে র্যাবের হেফাজতে নেওয়া থেকে শুরু করে হাসপাতালে নেওয়ার আগ পর্যন্ত যে প্রক্রিয়া তা আইনগতভাবে কতটুকু সঠিক ছিল তা জানতে চেয়েছেন। আদালত বলেছেন, আটকের পর সুলতানা জেসমিনকে সম্মানজনক জায়গায় (থানা অথবা কার্যালয়ে) নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল কি না? উঠিয়ে নেওয়া থেকে শুরু করে হাসপাতালে নেওয়ার আগ পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া আইনগতভাবে হয়েছে কি না? তাকে একটা অভিযোগের ভিত্তিতে তুলে নেওয়া র্যাবের জুরিসডিকশনে (এখতিয়ার) ছিল কি না? রাষ্ট্রপক্ষকে আগামী বুধবারের মধ্যে এসব প্রশ্নের জবাব দাখিল করতে বলেছেন। একই সঙ্গে ওইদিন বেলা ২টায় এ ব্যাপারে পরবর্তী শুনানির জন্য ধার্য করেছেন।
সাংবাদিকের বিরুদ্ধে নয়, মামলা অন্যায়ের বিরুদ্ধে : আইনমন্ত্রী
এদিকে সাভারে কর্মরত প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে বা হচ্ছে, সেটা সাংবাদিকের বিরুদ্ধে নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলে দাবি করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। গতকাল সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, আমি স্বীকার করি আপনারা নির্ভীক সাংবাদিক। আপনারা যদি জনগণকে সত্য তথ্য প্রকাশ করেন তাহলে কোনো মতেই এই সরকার সাংবাদিকদের বাধা দেবে না।
প্রথম আলোর রিপোর্টারের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা হয়েছে। অথচ এই আইনে মামলা হলে প্রথমে সেলে পাঠানোর কথা। কিন্তু দেখা গেল তাকে সরাসরি গ্রেপ্তার করা হলো—এ বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় যখন তথ্য দেওয়া হবে তখন যদি প্রাইমাফেসি কেস না থাকে তখন প্রাইমাফেসি কেস নির্ধারণের জন্য আগে সেলে পাঠানো হবে এবং সেলের পরীক্ষার পর মামলা নেওয়া হবে। কিন্তু গতকাল (বুধবার) ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যে মামলাটি করা হয়েছে তার যে বিবরণী, সেটা যদি দেখে থাকেন তাহলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যে মামলা হয় সেটার তথ্য-উপাত্ত কিন্তু সেখানে ছিল। সে ক্ষেত্রে পরীক্ষার জন্য পাঠানোর প্রয়োজন পড়ে না বলে এই মামলা গ্রহণ করা হয়েছে।