জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতিতে মূল ইস্যু হয়ে উঠছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করেন, সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী রাজনীতি ও নির্বাচন করতে পারবেন কি পারবেন না—দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সে আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া বিএনপির অনেক নেতা মনে করেন, বিদেশিদের চাপে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে শেষ মুহূর্তে নির্বাহী আদেশে মামলা প্রত্যাহার করে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে দিতে পারে সরকার। তবে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিলেও একাদশ সংসদ নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতায় বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিএনপি নেতারা জানান, তারা এখন খালেদা জিয়ার বিদেশে সুচিকিৎসা ও নিঃশর্ত মুক্তির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। পরে পরিবেশ সৃষ্টি হলে এবং দল মনে করলে তিনি রাজনীতিতে ফিরবেন।
এদিকে খালেদা জিয়ার রাজনীতি ও নির্বাচন করতে পারা না পারা নিয়ে মন্ত্রীদের সাম্প্রতিক আলোচনায় ‘ষড়যন্ত্র’ দেখছে বিএনপি। দলটি মনে করছে, এখানে সরকারের ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকতে পারে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে চলমান আন্দোলন থেকে দেশবাসীর দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ফেরানোর জন্য এটি সরকারের একটি কূটকৌশল। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার ও মানবাধিকার নিয়ে বিদেশিদের অব্যাহত চাপ থেকে বের হতে ক্ষমতাসীনরা এমনটি করতে পারে। তা ছাড়া এই ইস্যুটি সামনে নিয়ে এসে বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত করতে চায় সরকার। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের এই ফাঁদে পা দেবে না বিএনপি। দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই ইস্যুতে মন্ত্রীদের বক্তব্যে কোনো জবাব দেননি নেতারা। তারা এখন বিভিন্ন সভা-সমাবেশ-সেমিনারে খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিটি আরও জোরালোভাবে তুলে ধরছেন। তবে রাজনৈতিক কূটকৌশলের অংশ হিসেবে সরকার খালেদা জিয়ার রাজনীতি ও নির্বাচনের বিষয়টি ভবিষ্যতে আবারও সামনে আনতে পারে বলে মনে করেন বিএনপির অনেক নেতা।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নিয়ে সরকার বিভিন্নভাবে নাটক করছে বলে অভিযোগ করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, সরকারের মন্ত্রীরা একবার বলেন খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন না। আরেকজন বলেন, তার রাজনীতি করতে বাধা নেই। এ কীসের মোজেজা? হঠাৎ করে আপনাদের এত দরদ উথলে উঠল কেন যে, খালেদা জিয়ার রাজনীতি করার ব্যাপারে একেবারে পাগল হয়ে গেলেন। তাদের উদ্দেশ্য একেবারেই খারাপ।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলার মধ্যে দুটিতে সাজা হয়েছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়।
সেদিনই কারাবন্দি হন তিনি। ওই বছরের ৩০ অক্টোবর উচ্চ আদালত সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করেন। তার আগে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় বিএনপি নেত্রীর সাত বছরের সাজা হয়। আইনি লড়াইয়ে খালেদা জিয়া মুক্ত না হওয়ায় পরে পরিবারের আবেদনে ২০২০ সালের ২৪ মার্চ সরকার নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে সাজা স্থগিত করে ছয় মাসের জন্য তাকে মুক্তি দেয়। পরের দিন তিনি কারামুক্ত হয়ে গুলশানের ভাড়া বাসা ফিরোজায় ওঠেন। পরে তার সাময়িক মুক্তির মেয়াদ আরও কয়েক দফা বাড়ায় সরকার। এদিকে সাময়িক মুক্তির পর সরকারের পক্ষ থেকে তখন দুটি শর্তে খালেদা জিয়ার মুক্তির কথা জানানো হয়েছিল। এর একটি ছিল বাসায় চিকিৎসা নেওয়া এবং দ্বিতীয়টি ছিল তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না।
এদিকে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে ‘দণ্ডপ্রাপ্ত’ খালেদা জিয়ার পক্ষে ফেনী-১, বগুড়া-৬ এবং বগুড়া-৭ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া হয়। তবে সাজার কারণে তিনটিই বাতিল হয়ে যায়। দীর্ঘ অসুস্থতা এবং আইনি বাধ্যবাধকতায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বর্তমানে রাজনীতির মাঠের বাইরে রয়েছেন। এ কারণে দল পরিচালনায় কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেন না তিনি। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান স্থায়ী কমিটির মতামতে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি দল পরিচালনা করছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভূমিধস পরাজয়ের ধাক্কা কাটিয়ে তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিভাগীয় সমাবেশসহ তৃণমূলের সাম্প্রতিক কর্মসূচিগুলোতে সেটা প্রমাণিত হয়েছে। ফলে সরকার বিএনপিকে ভয় পাচ্ছে।
সম্প্রতি সরকারের কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর বক্তব্যে খালেদা জিয়ার রাজনীতির প্রসঙ্গটি ফের আলোচনায় আসে। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে বাধা নেই, তবে নির্বাচন করতে পারবেন না।’ পরদিন ২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিএনপির নেতা হিসেবে খালেদা জিয়া যদি রাজনীতি করতে চান, সেক্ষেত্রে যে শর্তে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, সেটি মেনে তাকে করতে হবে।’ এরপর ২২ ফেব্রুয়ারি কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বলেন, খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে বাধা নেই। পরে ২ মার্চ একই বক্তব্য দেন তিনি। অবশ্য ২৩ ফেব্রুয়ারি তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, খালেদা জিয়ার বয়স ও স্বাস্থ্য বিবেচনায় শর্তসাপেক্ষে কারাগারের বাইরে ঘরে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সেই শর্ত অনুযায়ী তিনি রাজনীতি করতে পারেন না। খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে রাজনীতি নিয়ে শর্ত ছিল কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যে শর্তে তাকে ঘরে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে সেই শর্তে তিনি রাজনীতি করতে পারবেন এমন কথা নেই। শর্তে বলা আছে, তিনি ঘরে থেকে চিকিৎসা নেবেন এবং অন্য কোনো কর্মকাণ্ডে অংশ নেবেন না। সুতরাং তার রাজনীতি করতে পারার কথা নয়। এর আগে ক্ষমতাসীনরা দাবি করে আসছেন, রাজনীতি না করার মুচলেকা দিয়েই সাজা স্থগিত পেয়েছেন খালেদা জিয়া। যদিও তাদের এ দাবি বরাবরই প্রত্যাখ্যান করে আসছেন বিএনপি নেতারা।
খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে পারা না পারার প্রশ্নে সম্প্রতি সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীর দেওয়া ওই বক্তব্যের ব্যাপারে বিএনপি আগ্রহী নয় বলে জানান দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। তিনি বলেন, এই যে হঠাৎ করে বলা হচ্ছে, খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন। এ কথা বলার আগে যেসব কথাবার্তা বলেছে ওরা, সেগুলোকে এক করেন। বুঝবেন, ওরা কী মিন (বোঝাতে) করছে।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী কালবেলাকে বলেন, এই সরকারের একটা রাজনৈতিক কৌশল হলো বিএনপির দুর্বলতাগুলো কাজে লাগানো। সে কারণে একটা রাজনৈতিক দল হিসেবে খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে তারা ওটা করবেই, নিয়মই তাই। অবশ্য এটাও ঠিক, একটা ইস্যু যখন আসে, সেই ইস্যুটাকে ডাইভার্ট করার জন্য সরকারই আরেকটা নতুন ইস্যু সৃষ্টি করে। এটা করে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, একই সময়ে বিএনপির মধ্যে অবিশ্বাস যাতে বৃদ্ধি পায় সে চেষ্টাও করে।
খালেদা জিয়ার রাজনীতি ইস্যুতে মন্ত্রীদের বক্তব্যে বিএনপির চুপ থাকার কৌশল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিএনপি সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, এই বিষয়টা তারা গায়ে নিচ্ছে না, কথা বলছে না। এতে ক্ষমতাসীনরা হতাশ হয়ে পড়ছে। কারণ, তারা হয়তো নেতৃত্ব নিয়ে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে চেয়েছিল, যাতে নেতাকর্মীরা বিভ্রান্ত হয়। খালেদা জিয়ার অসুস্থতাজনিত অনুপস্থিতিতে তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি এখন অনেক শক্তিশালী। তারেক রহমান তার সাংগঠনিক দক্ষতার মাধ্যমে তৃণমূলকে এতটাই শক্তিশালী করেছেন যে, অনেকেই সেটা বিশ্বাসই করেনি। কিন্তু বিভাগীয় সমাবেশসহ তৃণমূলের সাম্প্রতিক কর্মসূচিগুলোতে সেটা প্রমাণিত হয়েছে। অনেকে মনে করেছিল, তারেক রহমানের হাতে বিএনপি বিলুপ্ত হয়ে যাবে; কিন্তু সেটা তো হয়ইনি বরং বিএনপি আরও শক্তিশালী হয়েছে। ফলে সরকার তাদের ভয় পাচ্ছে। এই ভয়ের জন্যই প্রকৃতপক্ষে তারা এই ধরনের গুজব ছড়িয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক এ অধ্যাপক বলেন, সরকার নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে খালেদা জিয়াকে সাময়িক মুক্তি দিয়েছে। বিএনপির প্রতি যদি প্রধানমন্ত্রীর এত দরদই থাকে, তাহলে তিনি নির্বাহী আদেশে মামলা প্রত্যাহার করে বেগম জিয়াকে মুক্ত করে দিতে পারেন। মানুষ বিশ্বাসই করে না যে, খালেদা জিয়া এতিমের টাকা চুরি করেছেন। সাধারণ মানুষও মনে করে, খালেদা জিয়া রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও ওয়ান-ইলেভেনের সময় অনেক মামলা হয়েছিল, কিন্তু সেগুলো এখন নেই। অথচ বেগম জিয়ার মামলাগুলো রয়েছে।
বিএনপির কিছু নেতাসহ রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করেন, বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে শেষ মুহূর্তে নির্বাহী আদেশে মামলা প্রত্যাহার করে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে দিতে পারে সরকার। এমন সম্ভাবনা প্রসঙ্গে এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, দেখা গেছে—তারেক রহমান কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, অন্যদিকে ম্যাডাম কিছুটা নমনীয় সিদ্ধান্ত নেন। সে বিবেচনায় অনেকের কাছে বেগম জিয়া তুলনামূলক ভালো। তবে অতীতের কর্মকাণ্ড বিবেচনায় আমার মনে হয় না, খালেদা জিয়া এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে রাজি হবেন। আমি মনে করি, তিনি এই সরকারের অধীনে নির্বাচন করে আত্মাহুতি দেবেন না, বিএনপির জন্য সর্বনাশ ডেকে আনবেন না।
নুরুল আমিন বেপারী বলেন, যদি আন্দোলন বেগবান করা হয়, তাহলে এই সরকার মাথানত করে বিএনপি ও জনগণের দাবি মেনে নেবে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বোচনের প্রেক্ষাপট এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রশ্নে বর্তমানে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিকভাবে যে প্রেসার আসছে, তা আরও প্রকট হবে, যদি বিএনপি মাঠ পুরোপুরি দখলে রাখতে পারে। তবে বিএনপিকে এ ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।