ভোজ্যতেল আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা শেষ হওয়ার তিন দিনের মাথায় প্রতি লিটারে বোতলজাত, খোলা ও পাম অয়েলের দাম ৯ থেকে ১৮ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এ সিদ্ধান্ত এমন এক সময় নেওয়া হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে যখন ভোজ্যতেলের দাম সর্বনিম্ন অবস্থায় অর্থাৎ ২০২১ সালের শুরু অবস্থায় রয়েছে। বিশ্ববাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম ১ হাজার ৩০০ মার্কিন ডলারের মধ্যে রয়েছে। তবে দাম কমলেও আমদানি ব্যয় ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যয় বাড়ার কারণে তার কোনো প্রভাব পড়েনি, উল্টো বেড়েছে। আমদানিকারকরা বলছেন, ভ্যাট সুবিধা প্রত্যাহার হওয়ায় লিটারে ২৮ টাকা দাম বাড়ার কথা থাকলেও সরকার ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব পুরোটা গ্রহণ করেনি।
ট্যারিফ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা শেষ হওয়ায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। অন্যদিকে বাজারে চিনির দাম বাড়তে থাকলেও পণ্যটির দাম নির্ধারণে এখন পর্যন্ত ট্যারিফ কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো দাম ঠিক করা হয়নি।
সরকারি তথ্যমতে, বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২০ লাখ টন। এর মধ্যে স্থানীয় উৎপাদিত ২ লাখ ৩ হাজার টনের মতো। বাকিটা আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। অন্যদিকে বছরে চিনির চাহিদা ২০ লাখ টান, দেশে উৎপাদন মাত্র ৩০ হাজার টন।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে ২০২০ সালে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৮৩৮ ডলার এবং ২০২১ সালে ছিল ১ হাজার ৩০০ থেকে ৩৯০ ডলার। ২০২২ সালে ২ হাজার ডলার পৌঁছালেও চলতি বছরের শুরু থেকে ধারাবাহিকভাবে দাম কমতে থাকে। তবে ২০২১ সালে এক ডলারের বিপরীতে ব্যয় হতো ৮৬ টাকা, বর্তমানে প্রতি ডলারে দিতে হচ্ছে ১১০ থেকে ১১৫ টাকা। যদিও আমদানিকারকরা প্রতি ডলারের বিপরীতে দিতে হচ্ছে ১০৭ টাকা এবং রপ্তানিকারকরা প্রতি ডলারের জন্য পাচ্ছেন ১০৬ টাকা।
এদিকে ২০২২ সালের মার্চে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়াতে থাকলে প্রথম দফায় বোতলজাত সয়াবিন তেলের লিটারের দাম ঠিক করা হয় ১৬৮ টাকা, যা পরে ২০৫ টাকায় ওঠে। এর মধ্যে ভ্যাট প্রত্যাহার হলেও ডলার ও এলসি জটিলতার ইস্যুতে সেই অর্থে দাম কমায়নি ব্যবসায়ীরা। এই সময়ে দামের উত্থান ও স্বল্প পতনে সর্বশেষ ৩ মে পর্যন্ত প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১৮৭ টাকা, খোলা সয়াবিনের লিটার ১৬৭ এবং ৫ লিটারের দাম ছিল ৯০৬ টাকা। এ ছাড়া পাম অয়েলের লিটার ছিল ১১৭ টাকা। এখন ভ্যাট পুনর্বহালের অজুহাতে বোতলজাত সয়াবিন তেলের জন্য ভোক্তাকে এক লিটারের জন্য ১৯৯ টাকা। ৫ লিটার ৯৬০ টাকা, খোলা সয়াবিনের লিটারে ১৭৬ টাকা এবং পাম অয়েলের লিটারে ১৩৫ টাকা করে দিতে হবে।
মূলত গতবছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারেওে ভোজ্যতেলের দাম অস্বাভাবিক বাড়াতে থাকে। বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যবসায়ীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর মার্চে ভোজ্যতেল আমদানিতে ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ কমিয়ে পরবর্তী তিন মাসের জন্য ৫ শতাংশ করা হয়। এরপর কয়েক দফায় সময় বৃদ্ধি করে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত মেয়াদ শেষ হলে সরকার আর কোনো সময় বাড়ায়নি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন মনিটরিং সেল-সংক্রান্ত কমিটির সহকারী প্রধান মো. মাহমুদুল হাসান কালবেলাকে বলেন, ভোজ্যতেলের বিষয়ে আমাদের কাছে কোম্পানিগুলো প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ২০৫ টাকা করার প্রস্তাব করে। তাদের প্রস্তাবের বিষয়ে আমরা আন্তর্জাতিক বাজার, ডলারের দাম, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ উৎপাদন ব্যয় সমন্বয় করে একটি প্রস্তাবনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দিয়েছি। মন্ত্রণালয় থেকে এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তে এমন সময় নেওয়া হয়েছে, যখন আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে সে বিষয়টি কতটুকু গুরুত্ব পেল—এ প্রশ্নে ট্যারিফ কমিশনের এই কর্মকর্তা বলেন, হ্যাঁ, এ কথা সত্য, আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে ভোজ্যতেলের দাম কমতির দিকে। কিন্তু আমদানি ব্যয় ও অভ্যন্তরীণ ব্যয় বাড়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে ভোজ্যতেল আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতির যে সুবিধা ছিল, তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। নতুন দামে সে বিষয়টিও গুরুত্ব পেয়েছে।
চিনির দাম নির্ধারণের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চিনির দামের বিষয়ে ট্যারিফ কমিশিন এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। বাজার পর্যবেক্ষণ করে পরে সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
ভোজ্যতেল প্রসঙ্গে টিকে গ্রুপের ফাইন্যান্স অ্যান্ড অপারেশনস বিভাগের পরিচালক শফিউল আথের তসলিম কালবেলাকে বলেন, দাম বাড়ার কারণ সম্পর্কে আমরা সমিতির চিঠিতে বলেছি। আমদানি পর্যায়ে যে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা ছিল, তা এখন আর নাই। এ ছাড়া পণ্য আমদানিতে পরিবহন ব্যয় ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। পরে দাম আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোরবানির ঈদের আগে বাজারে চাহিদামতো তেল রয়েছে। দাম বাড়ার কোনো আশঙ্কা নেই।