নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে কাঞ্চন পৌরসভার নির্বাচন ঘিরে গোটা এলাকায় আতঙ্কের পরিবেশ বিরাজ করছে। এরই মধ্যে বর্তমান মেয়র রফিকুল ইসলাম রফিকের সমর্থকরা ভোটারদের নানা হুমকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সংখ্যালঘু ও দরিদ্র ভোটারদের ডেকে ডেকে তার পক্ষের লোকজন হুমকি দিচ্ছেন, রফিকের ‘জগ মার্কায়’ ভোট না দিলে এলাকায় থাকা যাবে না, পরিণতি হবে ভয়াবহ। তার পক্ষে এলাকায় অস্ত্রধারীরা মহড়া দিচ্ছে বলেও স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ভোটাররা তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন কি না বা সুষ্ঠু ভোট হবে কি না, তা নিয়ে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
আগামী ২৬ জুন কাঞ্চন পৌরসভার নির্বাচন। এবারের নির্বাচনে রফিকুল ইসলাম রফিক ছাড়াও মেয়র পদে দেওয়ান আবুল বাদশা মোবাইল ফোন প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তিনি ওই পৌরসভার সাবেক মেয়র।
স্থানীয়রা বলছেন, শুরুর দিকে ভোটের মাঠ শান্তিপূর্ণ ছিল। তবে নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, পরিস্থিতি ততই উত্তপ্ত হচ্ছে। এরই মধ্যে বর্তমান মেয়র রফিকের ছোট ভাই শফিকুল ইসলাম শফি ও মেয়রের আরেক সহযোগী আমিনুল হক খোকন ও তাদের অনুসারীদের নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আতঙ্কিত হয়ে উঠছেন ভোটাররা। তারা এলাকায় চিহ্নিত সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত। কাঞ্চন এলাকার মূর্তিমান আতঙ্ক শফিক ও খোকনের বিরুদ্ধে হত্যা, দস্যুতাসহ নানা অভিযোগে ডজনখানেক মামলা রয়েছে। ভোটাররা তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিষয়ে নানা তথ্য মিললেও আতঙ্কে কেউ নিজের নাম-পরিচয় জানাতে চাচ্ছেন না।
কাঞ্চন পৌর এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, শফিক ও খোকনকে অস্ত্র ও টাকা-পয়সা দিয়ে সহযোগিতা করে আসছে ক্যাসিনো জুয়াড়ি হিসেবে পরিচিত মেয়র রফিকের আরেক ভাই বিদেশে পলাতক তারিকুল ইসলাম মোঘল। এই ভাইয়ের বিরুদ্ধেও নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে। মোঘলের টাকায় এরই মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ভাড়াটে সন্ত্রাসী এনে কাঞ্চন এলাকায় আতঙ্ক তৈরি করা হচ্ছে। সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে বিভিন্ন ভোটারের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মহড়া দিচ্ছে। অপরিচিত মুখ দলবেঁধে রফিকের পক্ষে এলাকায় মিছিল-সমাবেশ করছে।
একজন প্রার্থীর পক্ষে ভোটারদের হুমকি দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রূপগঞ্জ থানার ওসি দীপক চন্দ্র সাহা কালবেলাকে বলেন, কেউ ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট করার চেষ্টা করলে ছাড় দেওয়া হবে না। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন করতে পুলিশ তৎপর রয়েছে। তিনি বলেন, কোনো প্রার্থী বা তার লোকজন ভোটারকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কাঞ্চন এলাকায় ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রফিকের পুরো পরিবার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত। দীর্ঘ বছর ধরে এই পরিবারের লোকজন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালালেও এলাকার সাধারণ মানুষ আতঙ্কে প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। রফিক ও তার ভাইয়েরা এলাকার নিরীহ মানুষের জমিজমা, ভিটেমাটি দখলের পর তা বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
ওই এলাকার স্থানীয় তারইল, রানীপুরা, কালাদী, চরপাড়া, দীঘলিয়াসহ আশপাশের এলাকার লোকজন বলছেন, এক সময় রফিকের পরিবারের কিছুই ছিল না। তার বাবা মরহুম হারুন তাঁত কারখানায় একজন সাধারণ শ্রমিক ছিলেন। বাবার দেখানো পথে রফিকও তাঁত কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি শ্রমিক নেতা মোক্তার দেওয়ানকে প্রকাশ্য দিনদুপুরে কুপিয়ে হত্যা করে আলোচনায় আসেন। এরপর নিজেই হয়ে যান শ্রমিক নেতা।
রফিকের উত্থানের বিষয়ে স্থানীয় লোকজন বলেন, শ্রমিক নেতা হওয়ার পর বিভিন্ন মিছিল-মিটিংয়ে ভাড়ায় লোক পাঠাতেন রফিক। এতে বিভিন্ন নেতার সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। নেতাদের আশীর্বাদে তিনি কাঞ্চন পৌর যুবলীগের সভাপতির পদটি বাগিয়ে নেন। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে নিজস্ব একটি বলয় গড়ে তোলেন। বখাটেদের নিয়ে গড়ে তোলেন একটি গ্রুপ, যাদের কাজই ছিল বিভিন্ন এলাকায় টহল দিয়ে নিরীহ মানুষদের তুলে এনে নিজের টর্চার সেলে আটকে ভয়ভীতি এবং নির্যাতন চালানো।
অভিযোগ রয়েছে, শ্রমিক নেতা মোক্তারকে হত্যার পর ২০১০ সালে রফিক-শফিকের বাহিনী কাঞ্চন টোল প্লাজার সামনে ডাকাতি করতে গিয়ে এক ট্রাক ড্রাইভারকে গুলি করে হত্যা করে। ২০১২ সালে শফিক-খোকনের নেতৃত্বে কাঞ্চন পৌর মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সামসুন্নাহার নীলার ছেলে ও ছাত্রলীগ নেতা রাসেলকে বাড়ির ভেতরে মায়ের সামনে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৪ সালের পৌর নির্বাচনেও কাঞ্চন পৌরসভায় মেয়র প্রার্থী ছিলেন রফিকুল ইসলাম রফিক। ভোটের দিন পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের তারইল এলাকায় প্রতিপক্ষ প্রার্থীর এক কর্মীকে ভোটকেন্দ্রের সামনেই হত্যা করে শফিক ও তার বাহিনীর সদস্যরা। যদিও ওই নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। তবে স্থানীয় নেতাদের শেল্টারে তার দাপট কমেনি তাতেও। ২০১৯ সালে পৌর মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। এর পরপরই বেড়ে যায় রফিক, মোঘল ও শফিক বাহিনীর অপকর্ম। তারা নিজ বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে সংখ্যালঘুদের জমি দখল, পণ্যবাহী ট্রাক আর শীতলক্ষ্যা নদীতে চলাচলরত জাহাজ ও বালুবাহী বাল্কহেডে চাঁদাবাজি, নদীর মাটি কাটা, কৃষকের জমির মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রি, বিভিন্ন আবাসন প্রতিষ্ঠান আর বালু ভরাটের ড্রেজারে চাঁদাবাজি, মাদক ও অস্ত্রের ব্যবসা করে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে যান।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা কালবেলাকে বলেন, ভোটারদের মনোভাব বুঝতে পেরে নির্বাচনকে বানচাল করতে উঠেপড়ে লেগেছে রফিকের ভাই শফিক ও খোকন বাহিনী। তারা প্রতিদিন বিভিন্ন ওয়ার্ডে গিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা করার পাশাপাশি সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে পৌর এলাকায় মোটরসাইকেল মহড়া দিচ্ছে। এরই মধ্যে ভোট দিতে অস্বীকার করায় পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের রানীপুরা এলাকায় মোক্তার হোসেন নামে এক ভোটারের ওপর হামলা চালায়। ৮নং ওয়ার্ডের কলাতলী এলাকায় অন্য মেয়র প্রার্থী বাদশার ভাতিজা দেওয়ান বাবুলসহ ৮ জনকে কুপিয়ে জখম করা হয়।
এসব অভিযোগের বিষয় জানতে চাইলে মেয়র প্রার্থী রফিকুল ইসলাম রফিক কালবেলার কাছে দাবি করেন, তার কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপ নেই। তার ভাইয়েরাও সন্ত্রাসী কাজে যুক্ত নয়। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর লোকজন তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে।