দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্প ও প্রযুক্তি উন্নয়নে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন গবেষণাগার স্থাপন করতে চায় বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর)। গবেষণার জন্য সেখানে বহুতল আবাসিক, প্রশাসনিক এবং ল্যাবরেটরি ভবন নির্মাণ করা হবে। এজন্য একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব করেছে বিসিএসআইআর। প্রকল্প প্রস্তাবে জমি অধিগ্রহণ, সম্মানী, আপ্যায়ন এবং বিদেশ ভ্রমণসহ বেশ কিছু খাতে অত্যধিক এবং অবাস্তব ব্যয় ধরা হয়েছে।
জানা গেছে, ‘বিসিএসআইআর গোপালগঞ্জ গবেষণাগার’ স্থাপন শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার ২১নং গেড়াখোলা মৌজার একটি জমি নির্বাচন করা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট খরচ ধরা হয়েছে ১ হাজার ৭৫৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পটির বাস্তবায়ন মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত।
গবেষণাগার স্থাপনের জন্য কাশিয়ানী উপজেলার গেড়াখোলা নামক এলাকার ৫০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। প্রস্তাবিত জমি অধিগ্রহণ বাবদ খরচ ধরা হয়েছে ১৫০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি একর জমির দাম ধরা হয়েছে ৩ কোটি টাকারও বেশি। অথচ জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ৫০ একর জমির দাম ৩২ কোটি ৮০ লাখ ২৭ হাজার ৯৫০ টাকা। সেই হিসাবে জেলা প্রশাসনে নির্ধারিত দামের চেয়ে ১১৮ কোটি টাকা বেশি চাওয়া হয়েছে।
জমির মূল্য নির্ধারণের বিষয়ে জানতে চাইলে গোপালগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ফারহানা জাহান উপমা কালবেলাকে বলেন, কাশিয়ানী উপজেলার গেড়াখোলা মৌজা দর অনুযায়ী জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওই জমির মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের জমির মূল্য নির্ধারণ প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, কাশিয়ানী উপজেলার গেড়াখোলা মৌজা রেট অনুযায়ী প্রতি শতাংশ জমির বাজারমূল্য ২১ হাজার ৮৬৮ টাকা। অর্থাৎ ১০০ শতাংশ বা এক একর জমির দাম ২১ লাখ ৮৬ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ৫০ একর জমির দাম হয় ১০ কোটি ৯৩ লাখ ৪২ হাজার ৬৫০ টাকা। জমি অধিগ্রহণ বাবদ তিনগুণ দাম হিসাব করলে আসে ৩২ কোটি ৮০ লাখ ২৭ হাজার ৯৫০ টাকা। এর সঙ্গে ৩ শতাংশ হারে অধিগ্রহণ কর যোগ করে হিসাব করলে দাঁড়ায় ৩৩ কোটি ৭৮ প্রায় ৩৪ কোটি কোটি অর্থাৎ ৩২ কোটি টাকা। কিন্তু বিসিএসআইআর গবেষণাগার স্থাপনের জন্য ৫০ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য ১৫০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা প্রস্তাব করেছে। অর্থাৎ জেলা প্রশাসনের মৌজা রেটের চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ বেশি টাকা চেয়েছে বিসিএসআইআর। জমি অধিগ্রহণ বাবদ এত অত্যধিক ব্যয় প্রস্তাব নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে।
বিসিএসআইআর বলছে, একটি পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগার স্থাপনের লক্ষ্যে বিসিএসআইআর গোপালগঞ্জ গবেষণাগার স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এজন্য ৫০ একর জমি প্রয়োজন। জমি অধিগ্রহণের ব্যয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে জমির দাম হিসাব করতে ভুল হয়েছে। এটা সংশোধন করা হবে। যদিও তারা জেলা প্রশাসনের মৌজা রেট অনুযায়ী ওই জমির নির্ধারিত মূল্য সম্পর্কে আগেই অবগত ছিল।
শুধু জমি অধিগ্রহণ নয়, জমি উন্নয়নেও অত্যধিক খরচ ধরা হয়েছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পের ব্যয় বিভাজন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অধিগ্রহণকৃত জমি উন্নয়নে খরচ ধরা হয়েছে ১৭১ কোটি ৪৩ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। আর ভূমি উন্নয়ন কর ধরা হয়েছে ১১ কোটি ৩০ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। এ ক্ষেত্রেও কয়েকগুণ বেশি টাকা চাওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া আলোচ্য প্রকল্প বাস্তবায়নে সম্মানী বাবদ ৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কর্মকর্তাদের আপ্যায়নে খরচ ধরা হয়েছে ৭০ লাখ টাকা। অর্থাৎ কর্মকর্তাদের সম্মানী এবং আপ্যায়নে খরচ ধরা হয়েছে ৪ কোটি ২৮ লাখ টাকা, যা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে দুই ধাপে বিদেশ যাওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ এবং ল্যাবরেটরি দেখার জন্য ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করবেন কর্মকর্তারা।
ডিপিপি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আলোচ্য প্রকল্প বাস্তবায়নকালে বিদেশ প্রশিক্ষণের জন্য ৫ কোটি ১১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা চাওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আলাদা করে বিদেশ ভ্রমণেও যেতে চায় বিসিএসআইআরের কর্মকর্তারা। এজন্য খরচ ধরা হয়েছে ৪ কোটি ৫১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশে প্রশিক্ষণ এবং ভ্রমণে খরচ হবে ৯ কোটি ৬৩ লাখ ৭২ হাজার টাকা।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগে সম্প্রতি আলোচ্য প্রকল্প প্রস্তাবের ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই সভায় প্রস্তাবিত প্রকল্পের অত্যধিক জমি অধিগ্রহণ ব্যয়, জমি উন্নয়ন, বিদেশ ভ্রমণ, সম্মানী ও আপ্যায়নসহ বিভিন্ন খাতের ব্যয় প্রস্তাব এবং অত্যধিক ভবন নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
পিইসি সভা সূত্রে জানা গেছে, মূল্যায়ন কমিটির সভায় বিভিন্ন খাতে অযৌক্তিক এবং অত্যধিক ব্যয় প্রস্তাবসহ খুঁটিনাটি বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সভায় জমি অধিগ্রহণ খাতে বিসিএসআইআরের প্রস্তাবিত ব্যয় বাদ দিয়ে জেলা প্রশাসনের দেওয়া দর অনুযায়ী জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া প্রকল্প থেকে বিদেশ ভ্রমণ খাত বাদ দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য যেসব খাতে অতিরিক্ত ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে সেগুলো যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে
আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) মো. আব্দুর রউফ কালবেলাকে বলেন, প্রকল্পটি এখনো অনুমোদন হয়নি। যাচাই-বাছাই করে সংশোধন করতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রস্তাব করলেই তো অনুমোদন হয়ে যাচ্ছে না। জেলা প্রশাসন যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেই দামেই জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। নিয়ম অনুযায়ী মৌজা রেটের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, বিদেশ ভ্রমণ, ভবন নির্মাণসহ যেসব খাতে অতিরিক্ত ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলো যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে।
জমি অধিগ্রহণসহ অন্যান্য খাতে অতিরিক্ত ব্যয় প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে বিসিএসআইআরের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আফতাব আলী শেখ কালবেলাকে বলেন, এটা প্রাথমিক প্রস্তাব, যারা ডিপিপি তৈরি করেছে তারা হয়তো না বুঝে ভুল করেছে। জেলা প্রশাসন থেকে যে রেট দেওয়া হয়েছে, সেই রেটেই জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এক টাকাও বেশি হবে না। এ বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পরিকল্পনা কমিশন বেশ কিছু খাতে কাটছাঁট করতে বলেছে। সেগুলো বাদ দিয়ে ডিপিপি সংশোধন করা হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যয় কমানো হবে। কোনো ক্ষেত্রে অতিরিক্ত খরচ হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী (টিআইবি) পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, এটি একটি উচ্চাভিলাসী প্রকল্প প্রস্তাব বলে মনে হচ্ছে। একই সঙ্গে যে ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে সেটা বাজারমূল্যের সঙ্গে অসামঞ্জস্য এবং অবাস্তব। এক্ষেত্রে মনে হয়, প্রকল্প প্রণয়ন এবং বাজেট নির্ধারণে বিসিএসআইআরের কর্মকর্তাদের অদক্ষতা রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য পূরণের চেয়ে নিজেদের সুবিধা আদায়ে অসৎ উদ্দেশ্য থাকে, এখানেও সেটা হয়েছে কি না সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। পাশাপাশি এমন অতিরিক্ত এবং অবাস্তব প্রস্তাব কেন করা হয়েছে সেজন্য সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। সার্বিকভাবে প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা বুঝে সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করে, তারপর প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন কালবেলার কাশিয়ানী উপজেলা (গোপালগঞ্জ) প্রতিনিধি মিল্টন হোসেন খান