২০১৫ সালের শেষদিকে পিপলস লিজিংয়ের দায়িত্ব নেয় নতুন পরিচালনা পর্ষদ। ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পিপলস লিজিংয়ের মোট সম্পদ ছিল ২ হাজার ২৯২ কোটি টাকা। আর দায়-দেনা ছিল ১ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ওই সময় দায়-দেনার চেয়ে সম্পদের পরিমাণ ৪৫৬ কোটি টাকা বেশি ছিল। এর তিন বছর পর ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটির সম্পদের পরিমাণ ১ হাজার ৫০৬ কোটি টাকায় নেমে আসে। বিপরীতে দায়-দেনা দাঁড়ায় ৩ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকায়। মাত্র তিন বছরে পিপলস লিজিংয়ের ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার বেশি স্রেফ ‘হাওয়া’ হয়ে গেছে। দায়-দেনা বাড়তে থাকার এক পর্যায়ে আলোচিত এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির অবসায়নের জন্য হাইকোর্টে আবেদন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বশেষ ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির মোট সম্পদের মূল্য ছিল ১ হাজার ২৯০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে দায়-দেনা ছিল ৩ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি থেকে লুট হয়ে গেছে প্রায় ২৬শ কোটি টাকা। হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত পাঁচ সদস্যের কারন উদঘাটন (ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং) কমিটির প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এ কে এম সাজেদুর রহমান খান এই কমিটির প্রধান। সম্প্রতি তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে প্রতিবেদনটি জমা দিয়েছে। গত বছর বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) বিষয়ে অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল একই কমিটি। ওই দুটি প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিআইএফসি ও আইএলএফএসএল থেকে অবৈধভাবে জামানতবিহীন ঋণ নিয়ে মোট ৩ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর মধ্যে আইএলএফএসএল থেকে ভারতে কারাবন্দি প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) এবং তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামেই নেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। আর বিআইএফসি থেকে বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) মান্নান ও তার প্রতিষ্ঠান নিয়ে গেছে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। বছরের পর বছর ধরে দুই প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট হলেও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তদন্ত প্রতিবেদনে সাবেক পাঁচ ডেপুটি গভর্নরসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের ২৪৯ কর্মকর্তাকে দায়ী করা হয়। সাবেক ডেপুটি গভর্নররা হলেন—সিতাংশু কুমার (এস কে) সুর চৌধুরী, এস এম মনিরুজ্জামান, মুরশিদ কুলি খান, আবু হেনা মো. রাজি হাসান ও মো. নজরুল হুদা। এ ছাড়া সাবেক নির্বাহী পরিচালক এ এইচ এম কায়-খসরু, মো. নওশাদ আলী চৌধুরী, মো. মাহফুজুর রহমান, শেখ আবদুল্লাহ, জোয়ার্দার ইসরাইল হোসেন, মো. শাহ আলম, এ টি এম নাসির উদ্দিন, শেখ আবদুল্লাহ, এ এন এম আবুল কাশেম, সিরাজুল ইসলামসহ বিভিন্ন কর্মকর্তার নাম আসে তদন্ত প্রতিবেদনে। পিপলস লিজিংয়ের তদন্তেও একই ব্যক্তিদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এতে পিপলস লিজিংয়ে ২০১৪ সালের বিশেষ পরিদর্শনের আগ পর্যন্ত সংঘটিত আর্থিক অনিয়ম এবং অবৈধ কর্মকাণ্ড রোধ ও নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা এবং পি কে হালদারের সহযোগী উজ্জ্বল কুমার নন্দী ও তার অনুসারীদের হাতে প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ, পরিদর্শন বিভাগসহ তৎকালীন জিএম ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের যার যার ক্ষমতা ও পদমর্যাদার ক্রমানুপাতে কর্মকালের ব্যাপ্তিভেদে দায়ী করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘২০১৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিশেষ পরিদর্শনের পর আগের পরিচালনা পর্ষদকে বাদ দেওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়। এরপর ২০১৫ সালের নভেম্বরে উজ্জ্বল কুমার নন্দী ও তার অনুসারীরা পিপলস লিজিংয়ের নিয়ন্ত্রণ নেয়। আর এর পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটি ক্রমাগত সম্পদ হারাতে থাকে। বাড়তে থাকে দায়-দেনা। চলতে থাকে লুটপাট।’
উজ্জ্বল কুমার নন্দী জালিয়াত চক্রের হোতা ও বর্তমানে ভারতের কারাগারে আটক পি কে হালদারের সহযোগী। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘২০০৩ সাল থেকে ২০১৪ সালের বিশেষ পরিদর্শনের আগে প্রতি বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে পিপলস লিজিংয়ে বিশদ পরিদর্শন পরিচালিত হয়েছে। ডিএফআইএমের ভিজিলেন্স সেলে পিপলস লিজিংয়ের বিভিন্ন ধরনের সাময়িক আর্থিক প্রতিবেদন নিয়মিতভাবে আসত। কিন্তু ২০১৪ সালের বিশেষ পরিদর্শনের আগে কখনই এসব অনিয়মের কোনোটিই উদঘাটিত হয়নি। এগুলো সংশ্লিষ্ট বিভাগ, সেল বা শাখার ব্যর্থতা।’ তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বিশেষ পরিদর্শনসমূহের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে অনিয়ম উদঘাটন ও সুষ্ঠু পরিচালনার চেয়ে পরিচালনা পর্ষদ পি কে হালদারের লোকদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার লক্ষ্যেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব বিশেষ পরিদর্শন পরিচালনা করা হয়।’ তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনযায়ী, ১৯৯৬ সালে প্রায় ৫০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে পিপলস লিজিং গঠন করা হয়। একই বছর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স গ্রহণ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। এরপর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি হিসেবে আমানত গ্রহণ ও ঋণ প্রদান করে আসছে। এরই মধ্যে পিপলস লিজিংয়ের ৬ জন পরিচালক বিপুল অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন মর্মে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিএফআইএম ২০১৪ সালে পিপলস লিজিংয়ে বিশেষ পরিদর্শন পরিচালনা করে। ওই পরিদর্শন থেকে দেখা যায়, ঋণের আড়ালে নিয়মবহির্ভূতভাবে পিপলস লিজিংয়ের পরিচালক শামসুল আলামিন গ্রুপ ও তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বিপুল পরিমাণ অর্থ যার তৎকালীন বকেয়া স্থিতি ২৯৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা, অন্য পরিচালক মতিউর রহমান ১১৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা, খবির উদ্দিন মিঞা ১০৭ কোটি ২৯ লাখ টাকা, বিশ্বজিৎ কুমার রায় ৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা এবং ইউসুফ ইসমাইল ১৯ কোটি ৩৭ রাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়া চলমান থাকা অবস্থায় ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিএফআইএমের আরেকটি বিশেষ পরিদর্শনে গ্রিন রোডের ৬৬ দশমিক ৫৩ কাঠা জমি কেনাবেচার নামে ক্যাপ্টেন (অব.) মোয়াজ্জেম এবং অন্যান্য পরিচালক মিলে ১২৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে উদঘাটিত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩-এর ২৬ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৫ সালের ৯ জুলাই পিপলস লিজিংয়ের তৎকালীন পরিচালক আরাফিন সামসুল আলামিন, মতিউর রহমান, খবিরউদ্দিন, হুমায়রা আলামিন ও নার্গিস আলামিনকে অপসারণ করে। পরে ওই বছরের ১৮ নভেম্বর কোম্পানির চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম হোসেন পদত্যাগ করেন। একই দিনে উজ্জ্বল কুমার নন্দী ও তার অনুসারীরা চেয়ারম্যান ও পরিচালক নিযুক্ত হয়ে পিপলস লিজিংয়ের নিয়ন্ত্রণ নেন। ওই সময় পর্যন্ত কোম্পানির দায়-দেনার চেয়ে সম্পদের পরিমাণ ৪৫৬ কোটি টাকা বেশি ছিল। তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, দায়িত্ব নেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই উজ্জ্বল কুমার নন্দী ও তার অনুসারীরা আগের বছরগুলোর পুঞ্জীভূত ক্ষতি দেখিয়ে পিপলস লিজিংয়ের ৯২৩ কোটি টাকা গায়েব করে ফেলে। ফলে আগের পরিচালনা পর্ষদের রেখে যাওয়া মোট সম্পদ কমে সপ্তাহের ব্যবধানে হয়ে যায় ১ হাজার ৯৮৩ কোটি। আর দায়-দেনা বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। তদন্ত কমিটির মতে, ‘এত কম সময়ের ব্যবধানে ৯২৩ কোটি টাকার ক্ষয়-ক্ষতির হিসাব কোনোভাবেই করা সম্ভব ছিল না।’ এর পর থেকে উজ্জ্বল কুমার নন্দী ও তার অনুসারীদের হাতে পিপলস্ লিজিংয়ের লোকসান ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকে। যার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক পিপলস লিজিং অবসায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে হাইকোর্ট বিভাগে ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন ম্যাটার নং-০১/২০১৯ দায়ের করে, যা এখনো চলমান। তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পিপলস লিজিংয়ের বিভিন্ন উৎস থেকে সৃষ্ট দায়-দেনার পরিমাণ ২ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। এই টাকা জনতা, সোনালী, বিডিবিএল, আইসিবি ইসলামিক, রূপালী, অগ্রণী, আইএফআইসি, মার্কেন্টাইল, বেসিক, এক্সিম, এনআরবিসি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল, সোশ্যাল ইসলামী, আল আরাফাহ ইসলামী, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, উত্তরা, মধুমতি, স্ট্যান্ডার্ড, প্রিমিয়ার, পূবালীসহ বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কখনো কলমানি হিসেবে, কখনো বা আমানত হিসেবে সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া আমানত হিসেবে সাধারণ গ্রাহকদের কাছ থেকে ৮০৩ কোটি টাকা ও বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৪১৯ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়। পরে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ চড়া সুদে নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে ঋণের নামে ঋণ দিয়ে ওই টাকা লুট করে নেয়। এর ফলে একদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ঋণখেলাপি হিসেবে পিপলস লিজিংয়ের তালিকা যেমন যায়নি, তেমনি খুব সহজেই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা লুটপাট চালিয়ে গেছেন। এক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংক এবং যেসব ব্যাংক থেকে আমানত সংগ্রহ করা হয়েছ, সেসব ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। অনুসন্ধান কমিটি মনে করে, ‘ব্যাংকগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে পিপলস লিজিংয়ের দায়িত্বশীলরা লুটপাট করেছেন। ব্যাংকের সহযোগিতা ছাড়া এভাবে লুটপাট কোনোভাবেই সম্ভব হতো না।’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘উজ্জ্বল কুমার নন্দী গং পিপলস লিজিংয়ের পরিচালনায় আসার পর থেকে তিন বছরে বিভিন্ন উৎস থেকে ২ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করে। এর বিপরীতে বিনিয়োগ করে মাত্র ১২৬ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি-জুন পর্যন্ত ঋণ-লিজ-অগ্রিম থেকে আদায় হয়েছিল ২৮০ কোটি টাকা, যার মধ্যে ১৭৫ কোটি টাকা ফাস ফাইন্যান্স এবং ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের দায় সমন্বয় করা হয়েছে। বিপুল পরিমাণ আমানত সংগ্রহ ও মোটা অঙ্কের ঋণ-অগ্রিম আদায়ের পরও কোম্পানির আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়া বা তারল্য সংকট তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক ব্যাপার।’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আগের বছরগুলোর পুঞ্জীভূত ঘাটতির নামে নব-উদ্ভাবিত কারসাজির মাধ্যমে উজ্জ্বল কুমার নন্দী ও তার সহযোগীরা পিপলস লিজিংয়ের দেউলিয়া দশা করেছে। তারা আগের চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ঋণ আদায় ও সমন্বয়ের ক্ষেত্রেও কোম্পানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে অন্যায়ভাবে নিজেরা লাভবান হয়েছেন। এ ধরনের কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে পিপলস লিজিংকে শেষ পর্যন্ত অবসায়নের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। এসব আর্থিক অনিয়ম ও অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সব পরিচালক প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। সেই সঙ্গে ক্রেডিট কমিটি, অডিট কমিটি ও এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্যরাও দায়ী। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের এমডি, ডিএমডি, হেড অব ক্রেডিট, হেড অব অ্যাকাউন্টস, হেড অব ফাইন্যান্স, হেড অব আইটি, কোম্পানি সচিব পর্যন্ত কর্মকর্তারা যার যার ক্ষমতা ও পদমর্যাদার ক্রমানুযায়ী দায়ী।’ পিপলস লিজিংয়ে লুটপাট চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতার জন্য রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি (আরজেএসসি) এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) দায়ী করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পিপলস লিজিংয়ে ২০১৫ সালের নভেম্বরে নির্ধারিত সর্বনিম্ন সদস্য সংখ্যার ঘাটতির কারণে পর্ষদ অকার্যকর হয়ে পড়লেও ওই পর্ষদ সভার মাধ্যমে উজ্জ্বল কুমার নন্দীদের বেআইনিভাবে পর্ষদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আরজেএসসি ও বিএসইসি এ বিষয়ে কোনো প্রশ্নও তোলেনি এবং পদক্ষেপও গ্রহণ করেনি। পিপলস লিজিংয়ের জালজালিয়াতি এবং অর্থ আত্মসাৎ অপকর্মের সঙ্গে জড়িত নাম সর্বস্ব প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি আনান কেমিকেল, ড্রাইনুন অ্যাপারেলস, লিপ্রো ইন্টারন্যাশনাল, জেনিথ হোল্ডিংস, জেফায়ার হোল্ডিংস, প্যারামাউন্ট প্রোপার্টিজ আরজেএসসির রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার কারণেই এ ধরনের অপকর্ম করার সুযোগ পেয়েছে। এসব প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির অনেকের নিজস্ব কোনো অফিস নেই। আরজেএসসি সুষ্ঠুভাবে যাচাই-বাছাই না করেই কোম্পানিগুলোকে রেজিস্ট্রেশন দিয়েছে। পিপলস লিজিংয়ের শেয়ার ক্রয় ছাড়া আনান ও ড্রাইনের আর কোনো ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়নি। পিপলস লিজিং থেকে কারসাজির মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া ছাড়া লিপ্রো ইন্টারন্যাশনাল, জেনিথ হোল্ডিংস, জেফায়ার হোল্ডিংস ও প্যারামাউন্ট প্রোপার্টিজের কোনো ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়নি। অথচ আরজেএসসি এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তারা সময়মতো পদক্ষেপ নিলে পিপলস লিজিং থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের ঘটনা নাও ঘটতে পারত।’ জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী ব্যারিস্টার খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ কালবেলাকে বলেন, ‘পিপলস লিজিং সম্পর্কিত তদন্ত প্রতিবেদন আমি এখনো হাতে পাইনি। তদন্ত কমিটি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে এটি জমা দিয়েছে কি না—তা আমার জানা নেই। আগের দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করা হয়েছে। বেঞ্চ নির্ধারণ হলেই এ বিষয়ে শুনানি হবে।’ অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশগুলো: পিপলস লিজিংয়ে সব অনিয়ম ও অবৈধ কর্মকাণ্ড সংঘটনে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণসহ প্রতিবেদনে মোট ১৮ দফা সুপারিশ করেছে অনুসন্ধান কমিটি। সুপারিশে বলা হয়েছে, আর্থিক লুটপাটের সঙ্গে জড়িতদের ভবিষ্যতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সব রকম নিয়োগ লাভে অযোগ্য করার ব্যবস্থা নিতে হবে; নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে এবং সাধারণ মানুষের টাকার ঝুঁকি বৃদ্ধি বন্ধে আন্তঃব্যাংক লেনদেনের মতো কার্যক্রম পরিচালনা পুরোপুরি পরিহার করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি; আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বন্ড ও এ ধরনের ইনস্ট্রুমেন্ট ইস্যুর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি তহবিল সংগ্রহ করতে হবে; আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোথা থেকে কীভাবে তহবিল সংগ্রহ করছে এবং কোথায় কীভাবে কার স্বার্থে ব্যবহার করছে, তার বিস্তারিত তথ্য যাচাই ও বিশ্লেষণ করার এবং সেই সঙ্গে বড় অঙ্কের ঋণের ব্যবহারের প্রকৃত অবস্থা এবং সুবিধাভোগী শনাক্ত করা ও বাস্তব অস্তিত্ব যাচাই করার নির্দেশনা সংবলিত পরিদর্শন গাইডলাইন প্রণয়ন করতে হবে। ব্যাংক ও আইসিবির মতো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কলমানি, মেয়াদি আমানত, মেয়াদি ঋণ ইত্যাদি খাতে অর্থ সরবরাহ ও আদায়ের কার্যক্রম খতিয়ে দেখার জন্য ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগকে গুরুত্ব দেওয়ার নির্দেশনা প্রদান করতে হবে; আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩-এর ১৮ ধারায় উল্লেখিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার কাছ থেকে কত ঋণ গ্রহণ করতে পারবে তার সর্বোচ্চ পরিমাণ, ঋণ পরিশোধের সর্বোচ্চ সময়সীমা, বিভিন্ন শ্রেণির ঋণের হিসাবায়ন পদ্ধতি, ঋণের সর্বোচ্চ সীমা, বাংলাদেশ ব্যাংকে রাখা রিজার্ভ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায় পরিশোধের সক্ষমতার মতো যৌক্তিক পর্যায়ে ইক্যুইটি উন্নীত করাসহ জনস্বার্থে মুদ্রানীতির উন্নতির জন্য অন্যান্য বিষয় নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
মন্তব্য করুন