এবারের বাজেটের মূল লক্ষ্য হিসেবে মূল্যস্ফীতি কমানোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কথা বললেও মোবাইল ফোন, ইন্টারনেটসহ বেশকিছু পণ্যের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এখানে খেয়াল করতে হবে, যে আইটেমগুলোর ওপর কর বসানো হয়েছে, সেটা আলটিমেটলি রাজস্ব জিডিপির অনুপাত বাড়ানোর পরও মূল্যস্ফীতি কমাতে তেমন কোনো ভূমিকা রাখবে না। এতে শেষ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামাতে পারবে কি না, এ বিষয়ে সন্দেহ আছে। তবে বাজেটের মূল যে নীতি পরিবর্তনগুলো করা হয়েছে, সেগুলো ঠিকই আছে।
বাজেটের ঘাটতি ৫ শতাংশের নিচে অর্থাৎ ৪ দশমিক ৬ শতাংশে রাখার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটা যদি পারে, তাহলে সেটা ভালো একটা দিক হবে। সেটা আমি সমর্থন করি। আর রাজস্ব জিডিপির অনুপাতে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ অর্জনের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, আমার মনে হয় না, সেটা অর্জন হবে। এখানে আমার সংশয় রয়েছে। এবারের বাজেটে একজন অর্থনীতিবিদের হাত দিয়ে কাজ করানো হয়েছে—এটা বোঝা যায়। এটা ভালো একটা পরিবর্তন।
আগের অর্থমন্ত্রী যে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন, তা থেকে এবার আমরা একটু পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। এমনকি বাজেট বক্তৃতার ধরনেও বড় পরিবর্তন এসেছে, এটাও আমি মনে করি ভালো একটা পরিবর্তন। কারণ সাবেক অর্থমন্ত্রী তো ফাঁকিবাজি করতেন। বক্তৃতা দেওয়ার পরিবর্তে, সেখান থেকে এবারের অর্থমন্ত্রী অল্প সময়ে পুরো বাজেট বক্তৃতা পড়ে শুনিয়েছেন। এবারের বাজেটে আরও একটা ভালো দিক হচ্ছে, অনেক খাতে ব্যয় কমানো হয়েছে, যেমন—পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ৮৫ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৮০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। এরকম অনেক খাতে গত বছরের তুলনায় ব্যয় কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা ইতিবাচক বলেই আমি মনে করি।
সার্বিকভাবে আগামী বাজেটের যে চরিত্র, মোটামুটি সমর্থনযোগ্য। কোমল পানীয়, আইসক্রিম, কাজুবাদাম, সিগারেট, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোনসহ বেশকিছু পণ্যের ওপর কর বাড়ানো হয়েছে। রাজস্ব আয় বাড়াতে হলে তো কিছু পণ্যে কর বাড়াতেই হবে। তবে সেটা যেন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে না বাড়ে, তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেদিক থেকে আগামী বাজেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যে ১ শতাংশ কর কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। আগে যেখানে ২ শতাংশ ছিল, এবার সেখানে ১ শতাংশ করা হয়েছে। এটা একটা ভালো দিক। কারণ এতে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়বে না। আর যেসব পণ্যে কর বাড়ানো হয়েছে সেগুলো একেবারে সাধারণ মানুষ খুব বেশি ব্যবহার করে না। এদিক থেকে বিষয়টি সমর্থনযোগ্য।
আর একটি বিষয়ে আমি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ আশা করেছিলাম। সংসদ সদস্যদের গাড়ি শুল্কমুক্ত থাকবে না বলছে, কিন্তু কত শতাংশ করারোপ বা ভ্যাট বসানো হবে, তা বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করা হয়নি। তবে জানতে পেরেছি, ৪০ শতাংশ কর ও ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এটাও একটা ভালো দিক। দীর্ঘদিন ধরে তাদের শুল্কমুক্ত গাড়ি দেওয়ার যে সংস্কৃতি চালু রয়েছে আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। আর ব্যাংক খাতের সংস্কার নিয়ে আমি সুনির্দিষ্ট কিছু পাইনি। যদিও আমি আশা করেছিলাম, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ রাখা হবে। আশা করি ভবিষ্যতে সংসদে আলোচনায় বিষয়টি উঠে আসবে। কারণ ব্যাংক খাতে সুনির্দিষ্টভাবে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে আগামী দিনে আরও খারাপ পরিস্থিতির দিকে যাবে।
একইভাবে অর্থ পাচার এবং হুন্ডির বিষয়েও বাজেট বক্তৃতায় কোনো কিছু বলা হয়নি। হুন্ডির বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠোর হতে হবে। পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে, খেলাপি ঋণ কমাতে এবং ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু বাজেট বক্তৃতায় এ বিষয়ে কোথাও কিছু খুঁজে পাইনি।
ড. মইনুল ইসলাম: অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক