রাজধানীর ইডেন কলেজের এক নেত্রী এবং কেন্দ্রীয় এক নেতার বিয়ে নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ উঠেছে। ওই নেত্রী বিয়ে হয়েছে দাবি করলেও ছাত্রলীগ নেতা বলছেন প্রতারণা। এমনকি তিনি ব্ল্যাকমেইলের শিকার হচ্ছেন বলেও দাবি করেন।
ওই তরুণীর ভাষ্য, ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনের ওই নেতা তাকে বিয়ে করেছেন। ফুয়াদ হোসেন শাহাদাত নামের ওই নেতার বিরুদ্ধে যিনি অভিযোগ করেছেন, তিনিও একই সংগঠনের ইডেন কলেজ শাখার নেত্রী। তবে বন্ধুত্বের বাইরে অন্য কোনো সম্পর্ক নেই দাবি করে শাহাদাত বলছেন, তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগই ভিত্তিহীন। বন্ধুত্বের বাইরে তাদের আর কোনো সম্পর্ক ছিল না; বরং অনেক দিন ধরে তাকেই মানহানিসহ নানা ধরনের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংস এবং টাকার জন্যেই মূলত তিনি এ ধরণের বিষয়ের অবতারনা করেছেন।
জানা গেছে, শাহাদাতের প্রতারণা ও নির্যাতনের অভিযোগ তুলে এর প্রতিকার চেয়ে গত ২৪ মে ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে লিখিত অভিযোগ করেন ওই তরুণী।
সেখানে বলা হয়, ফুয়াদ হোসেন শাহাদাতের সঙ্গে তার ১০ বছরের সম্পর্ক। এই দীর্ঘ সময়ে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া নানা ধরনের অন্যায়ের বিষয়ে তিনি গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে অবহিত করেন। ওবায়দুল কাদের বিষয়টি মীমাংসার জন্য ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে দায়িত্ব দেন। সে অনুযায়ী গত ৫ এপ্রিল মীমাংসার সময় নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এর দুদিন আগে পারিবারিকভাবে সমাধানের কথা বলে শাহাদাত তাকে বাসায় ডেকে নিয়ে যান।
ভুক্তভোগী তরুণীর দাবি, বাসায় যাওয়ার পর সমাধানের পরিবর্তে শাহাদাত তাকে এলোপাতাড়ি লাথি মারে এবং গুরুতর জখম করে। নিরুপায় হয়ে তিনি ৯৯৯-এ কল করেন। এরপর পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে। সেখান থেকে বেরিয়ে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফকে বিষয়টি জানান। পরে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেন। এ ঘটনায় তিনি মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।
তবে ছাত্রলীগ নেতা শাহাদাত ওই দিনে ৯৯৯ এ কল দেওয়ার প্রমাণ দেখিয়ে বিলেন, আমি পুলিশে ফোন করেছিলাম। একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি এড়ানোর জন্যে। এলাকায় আমার সম্মান আছে। রাজনীতি করি। বলা নেই, কওয়া নেই- একটা মেয়ে এসে স্ত্রী দাবি করলেই হয় না। সে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে চেষ্টা করেছে। এর থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্যেই আমি পুলিশে কল করি।
কালবেলার কাছে কিছু ভিডিও রয়েছে, সেখানে দেখা যায় ওই তরুণী সুস্থ অবস্থায় শোফায় বসে রয়েছেন। এ সময় সে দুটি মোবাইলও ভেঙে ফেলে। তবে ভিডিওতে ওই মেয়েকে সুস্থ দেখা যায়। মারধর কিংবা গায়ে হাত দেওয়ার দৃশ্য দেখা যায়নি।
এর আগে গত বছরের ৩ নভেম্বর একই থানায় ওই তরুণীর বিরুদ্ধে ফুয়াদ হোসেন শাহাদাত একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন।
এতে বলা হয়, ‘ওই নারীর সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে এবং সেই সূত্র ধরেই বিভিন্ন সময় দেখা-সাক্ষাৎ হয় এবং দুজনে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যান। বন্ধুত্বের সুবাদে সে তার মোবাইল ফোনে ছবি ধারণ করে এবং পরে সে তার বাসা ভাড়াসহ বিভিন্ন খরচ প্রদানে আমাকে বাধ্য করে। সে বিভিন্নভাবে আমার কাছ থেকে টাকা-পয়সা চেয়ে হুমকি দেয় যে, যদি আমি তাকে টাকা প্রদান না করি, তাহলে সে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমার ছবি বিভিন্নভাবে পোস্ট করে আমার সম্মানহানি করবে। সে যে কোনোভাবে তার দাবি না মানলে আমাকে আরও বিভিন্নভাবে ক্ষতি করার প্রতিনিয়ত হুমকি প্রদান করে আসছে।’
চলতি বছরের এপ্রিলে শাহবাগ থানায় করা আরেকটি জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘গত ৩ এপ্রিল ওই নারী হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে কল দিয়ে শাহাদাতকে বলেন, তার (নারী) কথা যদি শাহাদাত না শোনেন এবং কথামতো যদি কাজ না করেন, তাহলে তিনি তার কণ্ঠ নকল করে এআই বা অ্যাপের মাধ্যমে অপ্রীতিকর মন্তব্য ছোট ছোট অডিও ক্লিপ বানিয়ে সবার কাছে পাঠাবেন। কণ্ঠ ক্লোন করে এসব ক্লিপ বানানো হবে গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে নিয়ে, যাতে প্রয়োগ করা হবে খারাপ ও অশ্লীল শব্দ।’
দুজনের অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের সূত্র ধরে মোবাইল ফোনের বেশ কিছু স্ক্রিনশট এবং কল রেকর্ডের অডিও পাওয়া গেছে।
ফুয়াদ হোসেন শাহাদাতের একটি স্ক্রিনশট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি ওই নারী হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠিয়ে বলছেন, আমাকে বিয়ে করবা নাকি করবানা। আই নিড এ্যানসার।
তিনি আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে হোয়াটসঅ্যাপে যেই ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েছে সেখানে তিনি বলেন, শাহাদাত ২০২৩ সালে তাকে বিয়ে করবে এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দপ্তর সেলে যেই অভিযোগপত্র দিয়েছেন সেখানে তিনি উল্লেখ করেন ২০১৬ সালে শাহাদাত তাকে বিয়ে করেছেন। অথচ এরপ্রেক্ষিতে কোনো তথ্য প্রমাণ বা কাবিন নামা কালবেলার হাতে দিতে পারেননি।
এছাড়া আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতা এবং সাংবাদিকদের কাছে একটি আলট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট পাঠানো হয়। তবে তথ্য বলছে, ওই রিপোর্টটি সত্য নয় বানানো।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযোগকারী ওই তরুণী কালবেলাকে বলেন, ‘অভিযোগপত্র ও জিডিতে যা লিখেছি তার সবই সত্য। শাহাদাতের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে ২০১৬ সালে। বিয়েতে তার দুজন বন্ধু সাক্ষী ছিল, আমি তাদের ভালোভাবে চিনি না, যোগাযোগও নেই। বিয়ের সব কাগজপত্র শাহাদাতের কাছে। এজন্য আমি কোনো প্রমাণ দেখাতে পারছি না।
অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা ফুয়াদ হোসেন শাহাদাত কালবেলাকে বলেন, ‘আমি যে তাকে বিয়ে করেছি, সে বিষয়ে কোনো প্রমাণ সে কখনোই দেখাতে পারবে না। সে মেডিকেল রিপোর্টসহ যত ডকুমেন্ট সামনে এনেছে তার সবই নকল ও বানানো। কবে, কোন থানায়, কার সাক্ষীতে এবং কোন কাজির মাধ্যমে বিয়ে হয়েছে, সেটিই সে বলতে পারবে না।’
শাহাদাত আরও বলেন, ‘অভিযোগে সে বলেছে, আমি নাকি তাকে মারধর করেছি। আমি ওইদিন বাসায়ই ছিলাম না। ৯৯৯-এ কল দিয়ে তাকে বাসা থেকে বের করেছি। এখন সে বলছে, সে নাকি ৯৯৯-এ কল দিয়েছে। এর আগেও গত বছরের নভেম্বরে বাসায় গিয়ে সে ভাঙচুর করেছে এবং আমার মাকেও হুমকি দিয়েছে। সে আমার ফ্যামিলিটিকে নাই করে ফেলছে। টাকা-পয়সা থেকে শুরু করে আইফোন এমন কিছু নাই যে, সে আমার কাছ থেকে নেয়নি।’
সার্বিক বিষয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান কালবেলাকে বলেন, ‘গত ২৪ মে এ বিষয়ে আমরা একটি অভিযোগ পেয়েছি। ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে সাংগঠনিক ব্যস্ততা থাকায় এ নিয়ে কাজ করতে পারিনি। শিগগির আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব এবং তদন্তসাপেক্ষে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের মোবাইল ফোনে কল করে তাকে পাওয়া যায়নি।