‘ওয়াসার পানিতে এখনো তীব্র দুর্গন্ধ; খাওয়া যায় না, রান্নায়ও ব্যবহার করা যায় না। সরবরাহ কিছুটা বাড়লেও পানির মানে কোনো পরিবর্তন হয়নি।’ হতাশা আর ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর জুরাইনের বাসিন্দা মিজানুর রহমান। পানির মান নিয়ে এমন অভিযোগের পাশাপাশি রাজধানীর একটি বড় অংশে পানির সুবিধাই দিতে পারেনি ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। তারপরও পাঁচ বছরে ঢাকা ওয়াসা পানি বিক্রি করে রাজধানীবাসীর কাছ থেকে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। এবার মূল্যস্ফীতি সমন্বয়ের কথা বলে পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ১ জুলাই থেকে আবাসিক ও বাণিজ্যিক গ্রাহকদের ১০ শতাংশ হারে বাড়তি দাম গুনতে হবে। এ নিয়ে গত ১৬ বছরে ১৬ বার পানির দাম বাড়ানো হলো।
ওয়াসার বিগত পাঁচ বছরের আর্থিক হিসাব অনুযায়ী, রাজধানীবাসীকে পানি ও স্যুয়ারেজ সেবা দিয়ে সরকারি এই প্রতিষ্ঠান ধারাবাহিকভাবে বড় মুনাফা করছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষিত আর্থিক হিসাব অনুযায়ী মোট আয় ২ হাজার ৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে পানি বিক্রি করে আয় ১ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা আর স্যুয়ারেজ সেবা থেকে ৪৭৯ কোটি টাকা। পরিচালন ব্যয় ছিল ১ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। এই অর্থবছরে ওয়াসার পরিচালন মুনাফা ৬৪৭ কোটি টাকা। বছর শেষে ওয়াসার লোকসান দেখিয়েছে ৫২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঋণের সুদ বাবদ ব্যয় ছিল ১৪০ কোটি টাকা এবং অপরিচালন ব্যয় ১ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। অপরিচালন ব্যয়ের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়জনিত ক্ষতি ৯৬২ কোটি এবং পুনর্মূল্যায়নজনিত ক্ষতি ৩৮৬ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে।
২০২১-২২ অর্থবছর ওয়াসার আয় ১ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। পানি সরবরাহ থেকে প্রতিষ্ঠানের আয় হয় ১ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা আর স্যুয়ারেজ সেবা থেকে ৪৩৭ কোটি টাকা। পরিচালন ব্যয় ছিল ১ হাজার ৩২১ কোটি টাকা। এই অর্থবছরে ওয়াসার পরিচালন মুনাফা ৫৪২ কোটি টাকা। তবে এই অর্থবছর শেষে ওয়াসা লোকসান দেখিয়েছে ৩৭৮ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। অপরিচালন ব্যয়ের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়জনিত ক্ষতি ৬৮২ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির আয় ১ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা। পরিচালন মুনাফা ১৯১ কোটি টাকা হলেও ওয়াসা অর্থবছর শেষে মুনাফা দেখিয়েছে ৫০ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির আয় ছিল ১ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। পরিচালন মুনাফা ১৯১ কোটি টাকা হলেও ওয়াসা অর্থবছর শেষে মুনাফা দেখিয়েছে ৪৬ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির আয় ছিল ১ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা। পরিচালন মুনাফা ৬৮ কোটি টাকা হলেও ওয়াসা অর্থবছর শেষে মুনাফা দেখিয়েছে ৪০ কোটি টাকা।
একদিকে পানির মান ও সরবরাহ নিয়ে নানা অভিযোগ, অন্যদিকে লাভজনক অবস্থায় থাকার পরও এভাবে পানির দাম বাড়ানো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইন অনুযায়ী বিধি তৈরির আগেই পানির দাম নির্ধারণ করা যাবে না। বিধি প্রণয়ন ছাড়া পানির মূল্য নির্ধারণ ১৯৯৬ সালের ওয়াসা আইনের ২১ ও ২২ ধারার পরিপন্থি। আইনে বলা আছে, ‘বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে পানির দাম বাড়াতে হবে।’ কিন্তু ১৯৯৬ সালে আইন হওয়ার পর দীর্ঘ ২৮ বছরেও কোনো ধরনের বিধি তৈরি হয়নি। ফলে কীভাবে পানির দাম নির্ধারণ করা হবে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো বিধিবিধান নেই। এমন প্রেক্ষাপটে এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০২৩ সালের ১৬ মার্চ বিধি তৈরি ছাড়া পানির দাম নির্ধারণ অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এর বিরুদ্ধে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন জানায়। আপিল বিভাগ একই বছরের ২৩ মার্চ হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন। তবে পানির দাম বাড়ানোর ওপর নিষেধাজ্ঞার আদেশ বহাল রাখেন। এরপর ওয়াসা কর্তৃপক্ষ একটি নিয়মিত লিভ টু আপিল দায়ের করে আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় ফেলে রেখেছে। আইনজীবীরা বলছেন, পানির দাম বৃদ্ধির বিষয়টি এখন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। এ অবস্থয় পানির দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অবৈধ ও অযৌক্তিক।
তবে নগরবিদরা বলছেন, ঢাকা ওয়াসা বিদেশি ঋণে যেসব উচ্চাভিলাষী প্রকল্প নিয়েছে, সেগুলো থেকে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এর কারণ, বাস্তবতা বিবেচনায় প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়নি। পানি বিক্রয়ে ওয়াসা মুনাফা করলেও বিপুল বৈদেশিক ঋণের অপচয়মূলক ব্যবহারের কারণে লোকসানি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন প্রকল্পে ঢাকা ওয়াসার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া ঢাকা ওয়াসায় সিস্টেম লস ২০ শতাংশ। শুধু সিস্টেম লস কমাতে পারলে ওয়াসাকে পানির দাম হয়তো বাড়াতে হতো না। পানির দাম বাড়িয়ে ঢাকা ওয়াসা তার নিজের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের দায় জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ।
জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘ওয়াসা যে প্রতি বছর পানির দাম বাড়াচ্ছে, এটি একটি স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ। নিজেদের অনিয়ম, দুর্নীতি ও ব্যর্থতার বোঝা এবং তাদের সিস্টেম লসের বোঝা গ্রাহকের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত এই প্রতিষ্ঠানের কোনো জবাবদিহি নেই। নাগরিক সমাজ, ঢাকাবাসীসহ পরামর্শক ও গবেষকদের কোনো মতামতকে তারা গ্রহণ করে না। বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে ওয়াসাকে বিচারহীনভাবে তৈরি করে দেওয়া হয়েছে বছরের পর বছর ধরে। এই সুযোগে দুর্নীতি ও অপরাধ হয়েছে অবারিতভাবে।’
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা সাম্প্রতিককালে এক গবেষণা করে দেখলাম, ওয়াসার পানি সরবরাহ অপর্যাপ্ত। পানির গুণগত মান যে খারাপ এবং সেটি যে পান করার যোগ্য নয়, সেটিও ওয়াসার মহাব্যবস্থাপক প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী গ্রাহক বা তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে গণশুনানির মাধ্যমে মূল্য নির্ধারণ করার কথা। তারা সেটি করছে না।’
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া কালবেলাকে বলেন, ‘আপিল বিভাগের আদেশ সংশোধন না করে পানির মূল্য বৃদ্ধির কোনো সুযোগ নেই। পানির মূল্য বৃদ্ধির নতুন সিদ্ধান্ত অন্যায্য, অযৌক্তিক। কেননা হাইকোর্টের রায়ে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, বিধি প্রণয়ন না করে পানির মূল্যবৃদ্ধি বেআইনি। আমি মনে করি, এখানে আইনের লঙ্ঘন হয়েছে, যা অনুচিত। বিষয়টি আমরা উচ্চ আদালতের নজরে আনব।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসা পানি বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করে থাকলে পানির মূল্য পুনর্নির্ধারণ তথা কমানো উচিত। ওয়াসা হলো রাষ্ট্রের টাকায় পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান। নিশ্চয়ই ব্যবসা করবে না জনগণের সঙ্গে। এভাবে ১০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করলে এটা তো হবে জনগণকে জিম্মি করা।’
১৬ বছরে দাম বাড়ল ১৬ বার:
পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গত বুধবার পানির দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় ঢাকা ওয়াসা। আইন অনুযায়ী, প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে পানির দাম বাড়াতে পারে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে ওয়াসা বোর্ডের অনুমোদন নিতে হয়। আর ৫ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি করতে চাইলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। তবে ওয়াসা বোর্ডের একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, পানির দাম ১০ শতাংশ বাড়ানোর বিষয়ে তারা অবগত নন। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করেনি। ঢাকা ওয়াসার দাবি, ২০২১ সালের পর পানির দাম আর বাড়ায়নি তারা। ২০২২ সালেও দাম বাড়াতে চেয়েছিল ঢাকা ওয়াসা। তখন ওয়াসা কর্তৃক পানির দাম বাড়ানোর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করে ক্যাব।
ঢাকা ওয়াসার বোর্ড সদস্য ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব দীপ আজাদ বলেন, ‘পানির দাম বাড়ানোর বিষয়ে বোর্ডের সভায় আলোচনা হয়নি। এটি কোন প্রক্রিয়ায় হয়েছে, এটার ব্যাখ্যা আমি পাইনি। পরবর্তী বোর্ড সভায় এটি জানতে চাইব।’
পানির দাম বাড়িয়ে গ্রাহকের কাঁধে আরও চাপ বাড়ানো হলো বলে মনে করছেন ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি বলেন, ‘ওয়াসার ভুল নীতি ও দুর্নীতির কারণে এ অযৌক্তিক ব্যয়বৃদ্ধির পুরোটাই বহন করতে হচ্ছে ভোক্তাকে।’
ঢাকা ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক উত্তম কুমার রায় কালবেলাকে বলেন, ২০২১ সালের পর পানির দাম সমন্বয় হয়নি। ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ পানির দাম সমন্বয়ের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠি দিয়েছে। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ যতটুকু চেয়েছিল, মন্ত্রণালয় তার চেয়ে অনেক কম বাড়িয়েছে।
মুনাফার পরও পানির দাম কেন বাড়ছে—এমন প্রশ্নের জবাবে ওয়াসার এই কর্মকর্তা বলেন, আমরা এখনো সরকার থেকে আর্থিক সহযোগিতা পাচ্ছি। সামনে ওয়াসাকে ভর্তুকি আস্তে আস্তে শূন্যের কোঠায় নিয়ে যাবে সরকার। এজন্য আমাদের নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ওয়াসাকে ঢাকার বাইরে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নদী থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতদূর থেকে পানি আনতে প্রচুর অর্থের জোগান দেওয়া দরকার। আমরা ঋণ নিয়ে প্রকল্পগুলো করছি। এখন ওয়াসা সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এসব কারণে আমরা পানি দাম সমন্বয় করছি।
ওয়াসার প্রকল্পগুলো থেকে নেই আশানুরূপ ফল:
ঢাকা ওয়াসার প্রকল্পগেুলো বাস্তবায়ন চলছে ধীরগতিতে। এ কারণে ব্যয় বাড়ছে। বর্তমানে বিভিন্ন প্রকল্পে ঢাকা ওয়াসার বিদেশি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা। সাভারের তেঁতুলঝোড়া ভাকুর্তা ওয়েলফিল্ড প্রকল্প থেকে প্রতিদিন ২৫ কোটি লিটার পানি পাওয়ার কথা ছিল। হিমালয়ের চ্যানেল দিয়ে ভাকুর্তায় প্রচুর পানি আসে–এমন ধারণায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবির) কাছ থেকে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ২০১৮ সালে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছিল ওয়াসা। তবে সেখান থেকে পানি পাওয়া যায় লক্ষ্যের অর্ধেকেরও কম।
চীন থেকে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে একই সময়ে বাস্তবায়ন করা হয় পদ্মা-যশলদিয়া পানি শোধনাগার প্রকল্প। এ প্রকল্প থেকে বর্তমানে পানি পাওয়া যায় দৈনিক ৪৫ কোটি লিটারের পরিবর্তে ২০ কোটি লিটার।
ঢাকা ওয়াসার আরেকটি প্রকল্প চীন থেকে নেওয়া ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণে দাশেরকান্দিতে বাস্তবায়ন করা হয় স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট। তবে পয়ঃবর্জ্য যাওয়ার কোনো নেটওয়ার্ক তৈরি না করায় এই প্রকল্প থেকেও কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বরং এটির ব্যবস্থাপনা বাবদ বছরে ২০০ কোটি টাকা গুনতে হচ্ছে ঢাকা ওয়াসাকে।
এসব প্রকল্পে নেওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে এরই মধ্যে। ২০২৩ সালের এক অডিট রিপোর্ট থেকে দেখা গেছে, দাশেরকান্দি প্রকল্পে প্রতি বছর ওয়াসাকে ঋণের কিস্তি দিতে হচ্ছে ৪৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। পদ্মা-যশলদিয়া প্রকল্পে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে ৫৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা। ভাকুর্তা প্রকল্পে পরিশোধ করতে হচ্ছে ৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি নগরবিদ আদিল মুহাম্মদ খান কালবেলাকে বলেন, ওয়াসা কিছু প্রকল্প নিয়েছে যেগুলো অনেকটা হাতি পালার মতো। খরচ হচ্ছে; কিন্তু লাভ হচ্ছে না। ঋণ করে টাকা নিয়ে প্রকল্পের জন্য ব্যয় করা হচ্ছে। তিনি বলেন, শুধু উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিলেই হয় না। বাস্তবভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হয়। তা নেওয়া হলে গ্রাহকদের মাথায় এই চাপ পড়ত না। এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষ বিপদে আছে। এখন পানির দাম বাড়ানো মানুষের বিপদকে আরও বৃদ্ধি করবে।
পাঁচ বছরে প্রশিক্ষণ ব্যয় ১৪৬ কোটি টাকা:
গত পাঁচ অর্থবছরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ ব্যয় বাবদ ওয়াসা খরচ করেছে ১৪৬ কোটি ২১ লাখ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৬১৪ জনের প্রশিক্ষণে খরচ হয়েছে ৪৪ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছর প্রশিক্ষণে খরচ হয়েছে ২৫ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রশিক্ষণে খরচ হয়েছে প্রায় ২৫ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রশিক্ষণে খরচ হয়েছে ৩০ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে খরচ হয়েছে ২১ কোটি ৪১ লাখ টাকা।
পাঁচ প্রকল্পে কয়েক হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ:
ওয়াসার পাঁচটি প্রকল্পে কয়েক হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। পদ্মা-জশলদিয়া প্রকল্পে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার, গন্ধরবপুর পানি শোধনাগার প্রকল্পে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার, দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পের প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার, সায়েদাবাদ পানিশোধনাগার ফেজ-২-এর পরিচালনা ও রক্ষাবেক্ষণে প্রতি বছর প্রায় ১৫ কোটি টাকার দুর্নীতি এবং ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে বলে গত বছর আদালতকে জানিয়েছিলেন দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।
পারফরম্যান্স বোনাসের নামে ওয়াসা বিলিয়েছে ৮৯ কোটি টাকা:
৮টি অর্থবছরে উৎসাহ ভাতার নামে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে সর্বমোট ৮৯ কোটি ২৬ লাখ ২০ হাজার ১৬২ টাকা বিলিয়েছে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। ওয়াসার এমডি হিসেবে তাকসিম এ খান দায়িত্ব নেওয়ার দুই বছরের মাথায় ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে এই বোনাস চালু করা হয়। প্রথম ৫টি অর্থবছরে ১টি করে মূল বেতনের সমপরিমাণ টাকা পারফরম্যান্স বোনাস হিসেবে দেওয়া হলেও, ২০১৮-২০১৯-এ ৪টি, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৪টি এবং ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ৩টি করে উৎসাহ ভাতা দেওয়া হয়েছে।
৩৪৮ কোটি টাকা লুট ৪৬ কর্মীর:
ঢাকা ওয়াসার ৪৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের ৩৪৮ কোটি ৪৭ লাখ ১ হাজার টাকা লুট করেছেন। সূত্র বলছে, ২০০৮ সালের ১৬ মার্চ থেকে ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে ওয়াসার ৪৬ জন মিলেমিশে মোট ৩৪৮ কোটি ৪৭ লাখ ১ হাজার টাকা লোপাট করেন।